সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা চালু রেখেই সংকট দূর করা হোক

দৈনিক শিক্ষাডটকম ডেস্ক |

২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে প্রথমবারের মতো সাধারণ ও বিজ্ঞান প্রযুক্তি ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। গত শিক্ষাবর্ষে ২৪ টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অংশগ্রহণ করে। গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের মধ্যে এক নতুন আশা সৃষ্টি হয়।

কিন্তু বাস্তবে সেই আশা পূরণ হয়নি বলে মনে হচ্ছে। গুচ্ছ পদ্ধতির মূল লক্ষ্য ছিল শিক্ষার্থীদের আর্থিক কষ্ট লাঘব করা, ভোগান্তি দূর করা, সময় সাশ্রয় করা ও হয়রানি বন্ধ করা। পরীক্ষার্থীদের সুবিধা দিতে গুচ্ছ পদ্ধতি প্রণয়ন করা হলেও, এটি নিয়ে সুবিধার চেয়ে বিতর্ক ও সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে অনেক ক্ষেত্রে।  অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়ম বা দুর্নীতি করে শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এমনকি আমার কর্মস্থল জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় অনিয়মের অভিযোগের তদন্ত চলমান। বৃহস্পতিবার (১৪ নভেম্বর) দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়

নিবন্ধে আরো জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে এ বিষয়ে আলোচনা ও সমালোচনা চললেও, এর আগে কোনো কার্যকর পরিবর্তন দেখা যায়নি। শিক্ষার্থীদের কিছুটা হয়রানি বন্ধ হলেও, আমাদের সকল প্রত্যাশা এখনো পূরণ হয়নি। কিছু বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব পদ্ধতিতে ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক ভর্তি পরীক্ষা বাস্তবায়নের জন্য একটি কমিটি গঠন করেছে। এজন্য গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিচ্ছে যে, এবার গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা থাকবে কিনা। দ্রুত শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের এই বিষয়ে নির্দেশনা থাকা উচিত।

প্রথম গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি আবেদন ফি প্রথমে ছিল ৬০০ টাকা। পরে সেটা বৃদ্ধি করে ১ হাজার দুইশত টাকা করা হয়েছে। গুচ্ছ কর্তৃপক্ষ বলেছিল, একবারই টাকা দিতে হবে। পরবর্তীতে স্ব-স্ব বিশ্ববিদ্যালয় সার্কুলার দিয়ে শিক্ষার্থীদের ভর্তি করাবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয় আলাদা আলাদা ভর্তির বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। সেখানে দেখা গেছে প্রতি ইউনিটে আবার ভর্তি ফি দিতে হবে। যেমন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬৫০ টাকা দিতে হবে প্রতি ইউনিটে আবেদনের জন্য। তাহলে যদি কোনো শিক্ষার্থী ৫ ইউনিটে আবেদন করে, তার খরচ হবে তিন হাজার দুইশত পঞ্চাশ টাকা। এভাবে যদি সে কমপক্ষে ৫ টি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করে, ব্যয় হবে ১৬,২৫০ টাকা। অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের কোনো আর্থিক সাশ্রয় হয়নি। বরং বেশি খরচ হয়।  

এছাড়াও প্রথম গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় ‘বি’ এবং ‘সি’ ইউনিটের ফলে গরমিলের অভিযোগ রয়েছে। কিছু শিক্ষার্থী যে বিষয়ে উত্তর করেনি তাকে সেটাতে মার্কস দেয়া হয়েছে, আর যে বিষয়ে ভালো পরীক্ষা দিয়েছে সেটাতে খালি দেখাচ্ছে। কর্মদিবসে পরীক্ষার তারিখ হওয়ায় তীব্র যানজট, নিজের পছন্দের কেন্দ্রে পরীক্ষা দিতে না পারা এবং অন্যান্য অসংগতিতে অনেক স্বপ্নের গুচ্ছ ভর্তিই তীব্র ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে লাখ লাখ ভর্তি ইচ্ছুক শিক্ষার্থীর জন্য। পছন্দক্রম অনুযায়ী কেন্দ্র না পড়ায় ভর্তিচ্ছুদের বড় একটি অংশ আসনবিন্যাসের পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। এমন কেন্দ্রে আসন পড়েছে, যেখানে অনেকে অতীতে কখনো যায়নি। এছাড়া পছন্দমতো যদি আসন না-ই দিতে পারে, তা হলে পছন্দক্রম পদ্ধতি রাখার মানে হয় না। ফলে ভোগান্তি, হয়রানি ও অর্থ খরচ কমাতে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা আয়োজন করা হলেও, প্রকৃতপক্ষে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি বেড়েছে।

এখন প্রশ্ন হলো, গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা কতটা শিক্ষার্থীবান্ধব, তা নিয়ে নানা মহলে গুঞ্জন চলমান।  যেসব অভিযোগ এবং সমস্যাগুলো রয়েছে, তা দ্রুত সমাধান করতে হবে এবং প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদা ভর্তি বিজ্ঞপ্তি না দিয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করে কেন্দ্রীয়ভাবে ভর্তি সম্পন্ন করা উচিত। তাহলেই হয়রানি কমবে শিক্ষার্থীদের। গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় এক বিশ্ববিদ্যালয়ের কারণে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়েরও দুর্নাম হচ্ছে। যেমন গুচ্ছ পদ্ধতিতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্বকীয়তা বজায় রাখতে পারছে না। অতীতে  কোনো সময়ে অভিযোগ ছিল না একক ভর্তি পরীক্ষায়। কখনও কোনো ভুল বা অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কিন্তু গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় অন্যান্য কেন্দ্রের অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে বারবার। এক সময় শীর্ষস্থানীয় মেধাবীরা বাকৃবিতে ভর্তি হতে পারত। কিন্তু গুচ্ছ পদ্ধতিতে কম জিপিএধারীরাও ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছে, যা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বকীয়তা নষ্ট করছে। 

গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আঞ্চলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচিতি লাভ করবে বলে মনে হচ্ছে। কারণ, এখন আর কেউ নিজের এলাকা রেখে অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতে যাবে না। ফলে, আগে একটি বিভাগে অনেক জেলার ছেলেমেয়ে থাকত এবং তাদের মধ্যে সংস্কৃতি ভাষাগত যে পরিবর্তন হতো, সেটা আর এখন সম্ভব হচ্ছে না। গুচ্ছ পদ্ধতির ফলে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশি ভর্তি হচ্ছে। ফলে, সাংস্কৃতিক ভিন্নতা কমে যাচ্ছে। গুচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় বা অনুষদের নিজস্ব প্রশ্ন কাঠামোতে ভর্তি পরীক্ষা নেয়া যাচ্ছে না বলে মেধাবী শিক্ষার্থীদের যাচাইয়ের সুযোগ কমে যাচ্ছে বলে মনে করছেন কেউ কেউ। গুচ্ছে কারিগরি ত্রুটির কারণে শিক্ষার্থীদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের স্বকীয়তা হারাচ্ছে।

প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা আলাদা হওয়া উচিত বলে মনে করেন শিক্ষকরা। গুচ্ছের পূর্বে ভর্তি পরীক্ষা স্বচ্ছ ও অনন্য ছিল। এখন গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় আমাদের মান বজায় রাখা কঠিন। ফলে, প্রকৃত মেধাবীরা বঞ্চিত হচ্ছে। আলাদা ভর্তি পরীক্ষা নিলে মেধার সর্বোচ্চ মূল্যায়ন সম্ভব হবে। গুচ্ছ ভর্তি পদ্ধতি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব মানদণ্ড ও স্বকীয়তা বজায় রাখতে বাধা সৃষ্টি করছে।  অনেক বিশ্ববিদ্যালয় মনে করছে, তারা তাদের নিজস্ব  মান অনুযায়ী মেধাবী শিক্ষার্থী বাছাই করতে চায়, যা গুচ্ছ পদ্ধতিতে সম্ভব হয় না।  তাই অনেক বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা থেকে বের হয়ে যেতে চায়। কিন্তু সকল বাধা বিপত্তি দূর করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, যাতে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় শতভাগ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে এই পদ্ধতি বহাল রাখা যায়।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির আবেদনে এত টাকা রাখার সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই ঠিক হচ্ছে না। তাই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নিকট অনুরোধ থাকবে, যাতে ভর্তি আবেদন ফি ইউনিট প্রতি ৫০-১০০ টাকা হয়। দেশে অনুমোদিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ৫৪টি। ২৪টি সাধারণ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি  বিশ্ববিদ্যালয়ের  গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন হয় । ৩টি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ধরনের গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা এবং এছাড়াও কৃষি ও কৃষিপ্রধান ৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। অন্যদিকে, ঢাকাসহ বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা আলাদা তারিখে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ফলে, শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি প্রকৃতপক্ষে তেমন হ্রাস পাচ্ছে না। অর্থাৎ গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা সফল হবে তখনই, যখন একটি গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় অন্তর্ভুক্ত হবে সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বোপরি, এমন অবস্থায় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা মনে করছেন, ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে দীর্ঘদিনের যে ভোগান্তি ও অর্থের অপচয়সহ নানা সমস্যা ছিল, সেগুলো কিছুটা হলেও গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় নিরসন হয়েছে। তাই গুচ্ছ থেকে বেরিয়ে নয়, বরং সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার এই কার্যক্রম চালু রেখেই সামনে আসা সমন্বয়হীনতা ও  সংকট দূর করা হোক।

লেখক : ড. মো.শফিকুল ইসলাম, সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
এমপিওভুক্তির নতুন আদেশ জারি - dainik shiksha এমপিওভুক্তির নতুন আদেশ জারি জবিতে ভর্তির প্রাথমিক আবেদন শুরু ১ ডিসেম্বর - dainik shiksha জবিতে ভর্তির প্রাথমিক আবেদন শুরু ১ ডিসেম্বর শিক্ষা প্রশাসনে বড় বদলি - dainik shiksha শিক্ষা প্রশাসনে বড় বদলি কুবির বঙ্গবন্ধু হল ও শেখ হাসিনা হলের নাম পরিবর্তন - dainik shiksha কুবির বঙ্গবন্ধু হল ও শেখ হাসিনা হলের নাম পরিবর্তন ডিআইএ পরিচালক কাজী কাইয়ুম শিশিরকে বদলি - dainik shiksha ডিআইএ পরিচালক কাজী কাইয়ুম শিশিরকে বদলি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আন্দোলনে শহীদদের স্মরণসভা - dainik shiksha সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আন্দোলনে শহীদদের স্মরণসভা সরকারি কলেজ প্রদর্শকদের পদোন্নতির খসড়া প্রকাশ - dainik shiksha সরকারি কলেজ প্রদর্শকদের পদোন্নতির খসড়া প্রকাশ এমপিওভুক্ত হচ্ছেন আরো ১১ হাজার শিক্ষক - dainik shiksha এমপিওভুক্ত হচ্ছেন আরো ১১ হাজার শিক্ষক পঞ্চমে ফিরছে বৃত্তি পরীক্ষা, বার্ষিকে ৪ স্তরে মূল্যায়ন - dainik shiksha পঞ্চমে ফিরছে বৃত্তি পরীক্ষা, বার্ষিকে ৪ স্তরে মূল্যায়ন কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0033798217773438