সমাবর্তনের সাতকাহন

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

ভারতবর্ষ ও ইউরোপ মানবজীবনের অনেক আবিস্কার-উদ্ভাবনীর সূতিকাগার। সংস্কৃত, সংযুক্ত-আবর্তন বা সমাবর্তনের প্রসঙ্গ উল্লেখ আছে উপনিষদে। গুরুগৃহ থেকে বেদ অধ্যয়নের পর গার্হস্থ্য জীবনে প্রত্যাবর্তনকালে গুরু বা আচার্য শিষ্যের উদ্দেশে যে অভিভাষণ দিতেন, তাই সমাবর্তন। তবে গুরুগৃহে অধ্যয়নের পর শিষ্যরা সবাই যে গার্হস্থ্য জীবনে ফিরে যেতেন, তা নয়। অনেকেই প্রব্রজ্যাও গ্রহণ করতেন, গৃহী হতেন না। অন্যদিকে ইউরোপে, বিশেষ করে ইংল্যান্ডে দেখা যায়, মধ্যযুগে গির্জাই ছিল জ্ঞানচর্চা বা শিক্ষার প্রধান কেন্দ্র।  বুধবার (২৭ নভেম্বর) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। 

নিবন্ধে আরও বলা হয়, এই শিক্ষাব্যবস্থায় দ্বাদশ শতাব্দীতে যখন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ডিগ্রি দেওয়ার জন্য 'কনভোকেশন' বা 'সমাবর্তন' প্রথার সূচনা করে, তাও অনুষ্ঠিত হয় ওই গির্জাতে। পরে সারাবিশ্বে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ডিগ্রি কিংবা ডিপ্লোমা প্রদান অনুষ্ঠান হিসেবে ওই সমাবর্তন প্রথা চলে আসছে। পাশ্চাত্য দেশগুলোতে প্রতিবছরই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ডিগ্রি প্রদান করতে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সমাবর্তনে নিজ নিজ ক্ষেত্রে খ্যাতিমান ব্যক্তিরা সমাবর্তন বক্তা হিসেবে সনদ পাওয়া ব্যক্তিদের উদ্দেশে দিকনির্দেশনামূলক বক্তৃতা দেন। গ্র্যাজুয়েটরা সেখান থেকে ভবিষ্যৎ পথের সন্ধান খুঁজতে থাকেন। দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমাবর্তন চিত্র করুণ।

একটু ব্যতিক্রম কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৯ পর্যন্ত প্রায় অর্ধশত সমাবর্তন অনুষ্ঠান হয়েছে। প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয় কার্জন হলে ১৯২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। ৩৯ জন গ্র্যাজুয়েটকে সনদ দেওয়া হয় ওই অনুষ্ঠানে। স্যার পি জে হার্টস তখন উপাচার্য এবং সমাবর্তন বক্তা ছিলেন স্যার এ জে আর বুলওয়ার লিটন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘ নয় দশকের উল্লেখযোগ্য সমাবর্তন বক্তাদের মধ্যে ছিলেন জন এন্ডারসন, স্যার যদুনাথ সরকার, খাজা নাজিমুদ্দিন, স্যার জে এ হারবার্ট, স্যার ডেভিড হ্যারিসন, এ কে ফজলুল হক, ড. কুদরাত-এ-খুদা, অমর্ত্য সেন প্রমুখ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৩৬ সালের সমাবর্তনে সর্বোচ্চ ছয়জনকে ডিলিট ডিগ্রি দেওয়া হয়। তারা হলেন- বিজ্ঞানী প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার, কবি আল্লামা মুহাম্মদ ইকবাল, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও শিক্ষাবিদ স্যার এ এফ রহমান।

উল্লেখ্য, ওই সমাবর্তনের সমাবর্তন বক্তা ছিলেন স্যার যদুনাথ সরকার। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন সমাবর্তন বক্তা হিসেবে অভিভাষণ দেন ১৯৯৯ সালের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে, যেখানে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে 'ডক্টর অব লজ' ডিগ্রি দেওয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই বছরে গড়ে একবার করে সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হলেও দেশের অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এই চিত্র একেবারেই উল্টো। ১৯৫৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৬১ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৬২ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৭০ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এর মধ্যে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দশবার সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা আরও খারাপ। স্বাধীনতা-উত্তরকালে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও শতকরা হিসেবে ৮০ ভাগেরই কোনো সমাবর্তন অনুষ্ঠান হয়নি। ১৯৭৩ সালে প্রণীত বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশে বলা আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে চিন্তার স্বাধীনতা ও মুক্তবুদ্ধির চর্চার পরিবেশ সংরক্ষিত হবে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দলীয় রাজনীতির সূত্রে সন্ত্রাস জায়গা করে নিয়েছে। মাঝেমধ্যেই সংঘর্ষে লিপ্ত হয় ছাত্র সংগঠনগুলো।

প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে থাকে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্রতা বিনষ্ট হচ্ছে। স্বপ্নভঙ্গ হচ্ছে জাতির। পাশ্চাত্য দেশগুলোর মতো প্রতিবছর না হলেও দুই বা তিন বছর পরপর নির্ধারিত একটি সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেন সমাবর্তন অনুষ্ঠানের আয়োজন চলে, তার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। আগামী ৩০ নভেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একাদশ সমাবর্তন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। ওই সমাবর্তন থেকে হার্বার্ট বাটার ফিল্ডের ভাষায় সভ্যতার শেষ দুর্গ হিসেবে গড়ে ওঠার দিকনির্দেশনা পাক শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। শিক্ষাঙ্গনে বিরাজমান ক্রান্তিকালে এর চেয়ে বড় প্রত্যাশা আর কী হতে পারে? বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন শিক্ষক হিসেবে এ আশাই পোষণ করছি।

লেখক: গবেষক ও অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল - dainik shiksha সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.003108024597168