সময়মতো এসএসসি পরীক্ষা নেয়া শুধু অতি স্বপ্নবাদীর পক্ষেই সম্ভব!

আমিরুল আলম খান |

কিংকর্তব্যবিমূঢ় জাতি হিসেবে বাঙালির খ্যাতি আছে। এখন এমন এক ধাঁধা আমাদের সামনে উপস্থিত যে আমরা কী দেখি আর কী শুনি, তার অর্থ উদ্ধারে আমরা ব্যর্থ। শিক্ষা ও পরীক্ষা কোনটা বেশি মূল্যবান কাজ, তা তামাম দুনিয়ায় আজ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। অনেক শিক্ষামনোবিদের মতে, পরীক্ষা হলো শিক্ষার ‘আবশ্যকীয় আপদ’ (নেসেসারি ইভিল)। এ এমন এক মণিহার, যা ‘পরতে গেলে বাধে, ছিঁড়তে গেলে বাজে’। তাই বাঙালি কখন পরীক্ষার পক্ষে, আর কখন বিপক্ষে, তা বোঝা মুশকিল, সুরাহা তো দূরঅস্ত।

করোনায় সারা পৃথিবী স্তব্ধ। কিন্তু বাংলাদেশে একমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া সবকিছুই খোলা। বলা যায়, জীবনযাত্রা আগের মতোই প্রায় স্বাভাবিক। এর মধ্যে দুটো খবর আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের মাধ্যমিক পরীক্ষা (এসএসসি) যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হবে—এমন আশা প্রকাশ করেছেন। আবার আগামী ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটি বৃদ্ধির, অর্থাৎ না খোলার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিংকর্তব্যবিমূঢ় জাতি হিসেবে বাঙালির খ্যাতি আছে।

এখন এমন এক ধাঁধা আমাদের সামনে উপস্থিত যে আমরা কী দেখি আর কী শুনি, তার অর্থ উদ্ধারে আমরা ব্যর্থ। শিক্ষা ও পরীক্ষা কোনটা বেশি মূল্যবান কাজ, তা তামাম দুনিয়ায় আজ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। অনেক শিক্ষামনোবিদের মতে, পরীক্ষা হলো শিক্ষার ‘আবশ্যকীয় আপদ’ (নেসেসারি ইভিল)। এ এমন এক মণিহার, যা ‘পরতে গেলে বাধে, ছিঁড়তে গেলে বাজে’। তাই বাঙালি কখন পরীক্ষার পক্ষে, আর কখন বিপক্ষে, তা বোঝা মুশকিল, সুরাহা তো দূরঅস্ত।

শিক্ষাশাস্ত্রে ‘ডিম আগে না মুরগি আগে’—এই দার্শনিক তত্ত্বের মীমাংসা হয়নি। কোনকালে হবে, সেটা দুরাশা, তা জানি। তবে এ ক্ষেত্রে বাঙালির সাফল্য অন্য যেকোনো জাতি অপেক্ষা কিঞ্চিৎ বেশি বলেই তাবৎ দুনিয়ার মানুষ স্বীকার করে। অন্তত গত এক দশকে ‘সবার ওপরে পরীক্ষা সত্য, তাহার ওপরে নাই’ তত্ত্ব প্রকাশ ও বিস্তারে বাংলাদেশ দুনিয়ায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। লেখাপড়া হোক কিংবা না হোক, পরীক্ষাই এ দেশে শেষ নিদান। এখন শিশুর জন্মের সম্ভাবনাকালেই মা-বাবার পরীক্ষা শুরু কোন দামি স্কুলে অনাগত সন্তানের হাতেখড়ি হবে তা-ই নিয়ে। সে পরীক্ষায় মধ্যবিত্তের সমস্যা ক্রমেই জটিল হচ্ছে। 

উচ্চ ও নিম্নবর্গীয় মানুষের অন্তত এই হাতেখড়ি স্তরে কোনো চিন্তা করতে হয় না। কারণ, কারও বিত্ত বেশি বলেই তারা নিশ্চিন্ত; কারও বিত্তের অভাবই নিশ্চিন্ত হওয়ার আসল কারণ। কিন্তু মধ্যবিত্তের স্বপ্ন যেমন বেশি, সমাজে তাদের নিয়ে ঝড়ঝঞ্ঝাও বেশি। মিডিয়া উথাল-পাতাল করে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণিই। বাঙালি মধ্যবিত্তের সমস্যা এত বেশি যে, যে মতের সরকারই গদিতে থাকুক, সে সরকার এবং দলের মাথা বিগড়ে যায়। ফলে, আবোল-তাবোল কথা বলাই সরকারের দস্তুর হয়ে ওঠে।

এ বছরের প্রথম দিন থেকেই বাংলাদেশ করোনার ভয়ে ভীত হয়ে পড়ে। তখনো চীনের বাইরে করোনা ছড়ায়নি। কিন্তু মিডিয়ার প্রচার মহিমায় আমাদের নিদ্রা টুটে যায়। ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষার সব দরজা বন্ধ করা ছাড়া উপায় ছিল না। স্বয়ং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বারবার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করছিল। পাল্লা দিয়ে মিডিয়া থেকে আতঙ্ক ছড়াচ্ছিল।

সেই ১৭ মার্চ থেকে আজ পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ঝাঁপি বন্ধ, তা খোলা যায়নি। মনে হয় না আগামী গ্রীষ্মের আগে তা খোলার কোনো সম্ভাবনা আছে। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রীর মাধ্যমিক পরীক্ষা না পেছানোর আশাবাদের কী হবে, তা-ই নিয়ে গাঁ-গ্রামের চায়ের দোকান এখন সরগরম। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বলছেন, করোনা শীতকালে কী রূপ নেবে, এক আল্লাহ মাবুদ ছাড়া সে কথা কেউ জানে না। তিনি সবার প্রতি সাবধানবাণী উচ্চারণ করে বলছেন, মোটেই অবহেলা করা যাবে না। শীতকালে করোনা যেন করাল মূর্তিতে আসতে না পারে, সে জন্য সবাইকে প্রস্তুত থাকতে হবে। 

এরই মধ্যে ইউরোপের বেশ কিছু দেশ আবার লকডাউনে চলে গেছে। যদিও সেসব দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে শীতকাল শুরু হয়নি; চলছে শরৎকাল। যেসব ধারণা বিভিন্ন মাধ্যমে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, তা হলো মানবজাতিকে করোনার সঙ্গেই বসবাস করতে হবে। আর আগামী গ্রীষ্মের আগে করোনার টিকা আমজনতার নাগালে আসার কোনোই সম্ভাবনা নেই। ওষুধ নিয়েও তেমন মাথাব্যথা যেন কারও নেই।
তা যদি হয়, তাহলে প্রায় ২৫ লাখ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর পরীক্ষা নেয়া কত খানি বাস্তবসম্মত চিন্তা?

মনে রাখতে হবে, মাত্র সেদিন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা না নেয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে শিক্ষামন্ত্রী মুখ পুড়িয়েছেন। সারা দেশ গর্জে উঠেছে। তাই পরীক্ষা বাদের চিন্তা মাথা থেকে ছেঁটে ফেলার কথা তিনি বাদ দিয়েছেন। আরও একটা জবরদস্ত কারণ থাকতে পারে। সেটা হলো জনগণের চোখ অন্যদিকে ঘোরানো। রাজনীতিতে এটা হামেশাই ঘটে। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা হবে না বলায় যারা চেঁচাচ্ছে, এবার মাধ্যমিক পরীক্ষা নেয়া হবে ফেব্রুয়ারিতেই এ কথায় কারা কী বলেন, সেটা হয়তো ওজন করে দেখতে চান শিক্ষামন্ত্রী।

এ দেশে নবম ও দশম শ্রেণিতে অধ্যয়নের শিখনফল যাচাই করা হয় মাধ্যমিক পরীক্ষার মাধ্যমে। সেটি আবার সার্টিফিকেট পরীক্ষা। এক দশক আগপর্যন্ত এটিই ছিল পড়ুয়াদের জীবনে প্রথম সার্টিফিকেট অর্জনের পরীক্ষা। এখন অবশ্য পঞ্চম ও অষ্টমে আরও দুটো সার্টিফিকেট আমাদের সন্তানদের ফাইলে জ্বলজ্বল করে। ২০২১ সালে যারা মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসবে, তাদের বাক্সে সে দুটো সার্টিফিকেট জমা আছে। তবে ২৪ + ১ মোট ২৫ মাসের শিক্ষাকালের মাত্র সাড়ে ১৪ মাস তারা লেখাপড়ার সুযোগ পেয়েছে। এখন যদি ‘যথাসময়ে’, অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি মাসে তাদের মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসতে হয়, তাহলে ওই সাড়ে ১৪ মাসের বিদ্যা নিয়েই বসতে হবে। বাকি সাড়ে ১০ মাসের শিক্ষা থেকে তারা বঞ্চিত থাকবে। 

তবে এখানে স্মৃতি-বিস্মৃতির হিসাব কষলে ভিন্ন চিত্র পাব আমরা। কথায় বলে, মানুষ ছয় মাসে যা শেখে, নয় মাস তা ভোলে। কাজেই অর্জিত জ্ঞানের এই ‘অবনতি’ আমাদের হিসেবের মধ্যে আনতে হবে। ফেব্রুয়ারি নাগাদ আমাদের শিশুদের ঝুলিতে যে বিদ্যা জমা থাকবে, তা বড়জোর পাঁচ থেকে ছয় মাসের। আবার ফেব্রুয়ারি মানে মাঘের শেষার্ধ। কথায় বলে, ‘মাঘের শীত বাঘের গায়’। দলিলি হিসাবে সেটা শীত ঋতুর অধীন। তাই মনে হয় না অন্তত মে মাসের আগে কিছু চালু করা সম্ভব হবে। অতএব, আমাদের হিসাবে মাঘের শীতে মাধ্যমিক পরীক্ষা অনুষ্ঠানের সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ।

এরই মধ্যে বিশ্বব্যাংক আর জাতিসংঘের দুটো বড় অঙ্গসংগঠন ইউনিসেফ এবং ইউনেসকো জানিয়ে দিয়েছে, করোনা পরিস্থিতি যা-ই হোক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না খুলে উপায় নেই। এমনিতেই জগৎ এখন ডিজিটাল ডিভাইডেড। প্রযুক্তির ব্যবহারে গরিব দেশগুলো ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে। আমাদের এই দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ অন্যদের, বিশেষ করে শ্রীলঙ্কা, ভারত ও পাকিস্তান থেকে নাকি অনেক পিছিয়ে। তা-ই যদি সত্যি হয়, তাহলে এটা রীতিমতো শঙ্কার।

করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশে দূরশিক্ষণ কার্যক্রম বা অনলাইন শিক্ষাদানের সিদ্ধান্ত নিতেই কেটে গেছে প্রায় তিন মাস। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা তথাকথিত সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর। প্রাথমিক, মাধ্যমিক স্তরে অনলাইন শিক্ষাক্রম যেটা সংসদ টিভিতে চলছে, তা নিতান্ত দায়সারা গোছের। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিজস্ব উদ্যোগে যে ক্লাস চালাচ্ছে, তাতেও গলদ প্রচুর। তবে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা কলেজগুলোর। কলেজ স্তরে অনলাইন ক্লাস একেবারে জঘন্য। সেটা দেখভাল করারও কেউ নেই।

ওদিকে মানুষের আর্থিক সংকট বাড়ছে। আয় কমছে হু হু করে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জিনিসের দাম। এর মধ্যে প্রচুর লাভ করা সত্ত্বেও সরকার মোবাইল অপারেটরদের বাধ্য করতে পারেনি ইন্টারনেট সেবার চার্জ কমাতে। বরং ফোর-জি, ফাইভ-জির নামে চলছে রীতিমতো বর্গি শোষণ।

পরিস্থিতি যখন এমন, তখন আগামী ফেব্রুয়ারিতে মাধ্যমিক পরীক্ষা নেয়া যাবে—এ কথা চিন্তা করা অতি স্বপ্নবাদীর পক্ষেই সম্ভব।

লেখক : আমিরুল আলম খান, সাবেক চেয়ারম্যান, যশোর শিক্ষা বোর্ড


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
কাল থেকে শিক্ষা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চলবে সব প্রাথমিক বিদ্যালয় - dainik shiksha কাল থেকে শিক্ষা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চলবে সব প্রাথমিক বিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান বাড়ানোর নির্দেশ রাষ্ট্রপতির - dainik shiksha বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান বাড়ানোর নির্দেশ রাষ্ট্রপতির ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দাবিতে দেশজুড়ে সংহতি সমাবেশ - dainik shiksha ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দাবিতে দেশজুড়ে সংহতি সমাবেশ সব মাদরাসার ওয়েবসাইট ও তথ্য হালনাগাদের নির্দেশ - dainik shiksha সব মাদরাসার ওয়েবসাইট ও তথ্য হালনাগাদের নির্দেশ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক : দুই মন্ত্রণালয় যা করবে - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক : দুই মন্ত্রণালয় যা করবে নার্সিং-মিডওয়াইফারি ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ - dainik shiksha নার্সিং-মিডওয়াইফারি ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় সিনিয়র আইনজীবীরা বিচার বিভাগের স্বার্থে কথা বলবেন, আশা প্রধান বিচারপতির - dainik shiksha সিনিয়র আইনজীবীরা বিচার বিভাগের স্বার্থে কথা বলবেন, আশা প্রধান বিচারপতির দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0032880306243896