সময়ের দাবি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা

গোলাম কবির |

আমাদের দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রথম বর্ষ অনার্স শ্রেণিতে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া বিলম্বিত হচ্ছে। যদিও এ বিষয়ে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি কম হয় না। অনেকে মনে করেন, এর মূলে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ঐকমত্যে আসতে না পারা। কেন পারছে না তা আমাদের মতো আদার ব্যাপারীর পক্ষে অবহিত হওয়া সহজ নয়। তবে কেউ কেউ বাড়তি অর্থপ্রাপ্তির প্রতি ইঙ্গিত করেন। এটা অমূলক নয়। অর্থ কার না প্রিয়! উমাইয়া যুগের চারণকবি হারেস বিন হাম্মাম অর্থের মোহনীয় শক্তিকে বলেছেন ‘জাল্লাত কুদরাতো কা’।

কে না জানে, দেশের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষায় আনা-নেওয়া করতে একদিকে অভিভাবকদের যেমন পকেটে টান পড়ে, তেমনি ভর্তীচ্ছু শিক্ষার্থীরা ক্লান্ত-অবসন্ন হয়ে যায়। তদুপরি কয়েক মাস ধরে চলতে থাকা ভর্তি পরীক্ষার জন্য জাতির কত ঘণ্টা শিক্ষা সময় অপচয় হয় তার হিসাব আমরা রাখতে নারাজ। এত ভোগান্তি সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও তাঁদের সন্তানদের পোহাতে হয় না। কারণ তাদের জন্য কোটা আছে।

সূচনায় বলেছি, আমরা আদার ব্যাপারী। জীবিকা নির্বাহের জন্য শিক্ষকতার পেশা বেছে নিতে হয়েছিল বাধ্য হয়ে। পাকিস্তানের শেষ আমল থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের এক দশক পর্যন্ত রাজশাহী কলেজে নিয়োজিত ছিলাম। ওই সময়ে এ অঞ্চলে সেরা মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল রাজশাহী কলেজ। ফলে বাংলাদেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের অধিকাংশ মেধাবী শিক্ষার্থী এখানে আসত। তাদের সংখ্যা নগণ্য ছিল না। অথচ ভর্তিযজ্ঞের বিপুল আয়োজন থাকত না। ভর্তীচ্ছুদের তেমন বাড়তি পয়সা দিতে হতো না। ভর্তি কমিটির সদ্যসরা কোনো সম্মানী পেতেন না। ওই সময় শিক্ষকরা ভাবতেন, ভর্তির বিষয়টি শিক্ষার অপরিহার্য অঙ্গ। শিক্ষার কাজে নিয়োজিত থাকার জন্য বেতন দেওয়া হয়। সুতরাং ভর্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার জন্য অতিরিক্ত টাকা নেওয়া কিছুটা অনৈতিকতার শামিল। সে মূল্যবোধ এখন সেকেলে।

তা ফিরিয়ে আনার জন্য আমরা মোটেও সোচ্চার নই। আমরা বলছিলাম সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ঐকমত্যের বিষয়টি যেন বিলম্বিত না হয়। শিক্ষা নিয়ে যাঁরা ভাবেন, তাঁদের অনেকের মতে, সমন্বিত পরীক্ষা নিলে শিক্ষার মানের অবনতি হওয়ার আশঙ্কা নেই। যদি না থাকে, তবে অহেতুক নীরবতা জাতির জন্য মনে হয় পরিহাসের শামিল। মানুষের কিছু কিছু সিদ্ধান্তহীনতা তার নিজের জন্য ক্ষতিকর। তাহলে গোটা জাতির জন্য কী হবে? আমরা আশাবাদ ব্যক্ত করব সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ঐকমত্যে উপনীত হবে। কেননা জাতীয় মঙ্গলের কামনায় তারাও সমান অংশীদার।

উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের প্রথম মানদণ্ড সনদ আর দ্বিতীয় সক্ষমতার পরিচায়ক চুম্বক ভর্তি পরীক্ষা। আমরা যাকে বলতে চাচ্ছি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা। আমরা মনে করি, এর সঙ্গে যুক্ত হওয়া উচিত সমন্বিত পাঠ্যপুস্তক প্রবর্তন। অবশ্য তা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত। আমাদের দেশে মাধ্যমিক শিক্ষা পর্যন্ত সমন্বিত পাঠ্যপুস্তকের ব্যবস্থা চালু আছে, যা সম্পাদন করে বাংলাদেশ পাঠ্যপুস্তক বোর্ড। যেহেতু সমন্বিত পরীক্ষা, তাই হরেক রকমের পুস্তকের পরিবর্তে বিষয়ওয়ারি একখানা করে যথার্থ পুস্তক পাঠ্যতালিকায় থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের পথ সুগম হয়। উচ্চ মাধ্যমিকে ইংরেজি বাংলা ছাড়া অন্য কোনো পুস্তক বোর্ড কর্তৃক নির্ধারিত নেই। এটা সবার জানা। এতে অতীতে লাভ-ক্ষতি কতখানি হয়েছে সে বিচারও আমরা করতে বসিনি। তবে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার জন্য বিষয়টি সহায়ক হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

উচ্চ মাধ্যমিক মানবিক, বিজ্ঞান, বাণিজ্য ইত্যাদি বিভাগে সমন্বিত পাঠ্যপুস্তক পড়ার সুযোগ আছে শুধু বাংলা ও ইংরেজি কম্পলসারি বিষয়ে। অন্যান্য বিষয়ে নেই। অর্থনীতি, পৌরনীতি, সমাজবিদ্যা, ইতিহাস, পদার্থবিদ্যা, রসায়নশাস্ত্র, জীববিজ্ঞান, গণিত, হিসাববিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি বিষয় উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ানো হয়। বাজারে দেখা যায়, উপরোক্ত বিষয়গুলোর মাত্র একটি বিষয়ে অনেক লেখকের বই চালু আছে। গত শতকের পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত এগুলোর লেখক ছিলেন হাতে গোনা। কারণ পাঠের মাধ্যম ছিল ইংরেজি। মাতৃভাষায় পাঠের সুযোগ হওয়ায় লেখকের সংখ্যা বেড়ে গেছে বহু গুণে। এসব গ্রন্থ পরস্পর সমন্বিত নয়। পাঠক্রম অনুযায়ী বিন্যস্ত থাকলেও একটি গ্রন্থের সঙ্গে অন্য একটি গ্রন্থের পরিবেশনায় সমন্বয় নেই।

কলেজে ভর্তি হওয়া নবীন শিক্ষার্থীরা ভালো পাঠ্যপুস্তক বেছে নেয় অগ্রজ শিক্ষার্থী, সংশ্লিষ্ট শিক্ষক প্রমুখের পরামর্শে। এটা সঠিক কি না তা বলা যাবে না। কারণ পরামর্শদাতা নিজের পছন্দের বই সংগ্রহ করতে শিক্ষার্থীকে প্রণোদিত করেন। তা ছাড়া আমাদের খ্যাতি আছে হুজুগপ্রবণ হিসেবে।

এটা অতিশয়োক্তি নয় যে উচ্চ মাধ্যমিকের পাঠ্য তালিকাভুক্ত বইগুলো মৌলিক গ্রন্থ নয়। অধিকাংশই বিদেশি ভাষা থেকে সংগৃহীত অনুবাদ। যেসব গ্রন্থপ্রণেতা মূল বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করতে পারেন এবং মাতৃভাষায় তা প্রকাশের সাবলীল দক্ষতা রাখেন তাঁদের গ্রন্থ শিক্ষার্থীদের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার কথা। বাস্তবে তা হয় না। বাজারে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের পুস্তক প্রচুর। এখনকার অনেক পুস্তক ভদ্রগোছের গাইডের মতো। এগুলোর প্রতি ছাত্র-শিক্ষকের আগ্রহ বেশি। লেখা বাহুল্য, এসব গ্রন্থ অনুসরণ করে শিক্ষার্থীরা মেধাকর্ষণের সুযোগ পায় না। ফলে শিক্ষার্থীদের প্রত্যুত্পন্নমতিত্ব যথাসময়ে অর্জিত হয় না। আমরা গ্রন্থ প্রণেতা নই। নীতিনির্ধারকমণ্ডলীর ধারেকাছে যাওয়ার যোগ্যতাও আমাদের নেই। শুধু দূর থেকে আভাস-ইঙ্গিতে অযাচিতভাবে বলতে পারি, পাঠ্যপুস্তক বোর্ড যেন মাধ্যমিকের মতো উচ্চ মাধ্যমিকেও সমন্বিত পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করে। এতে শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্তি বিড়ম্বনা যেমন কমবে, তেমনি তারা মেধাকর্ষণের সুযোগ পাবে।

শুরু করেছিলাম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রথম বর্ষ অনার্স শ্রেণিতে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে। তার সঙ্গে যুক্ত করতে হলো উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত সমন্বিত পাঠ্যপুস্তক প্রবর্তনের বিষয়টি। আমরা মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের এই পর্বটি পরস্পরের পরিপূরক। উপরন্তু অনেকেই মনে করেন, বিষয় দুটি সময়ের দাবি।

লেখক : সাবেক শিক্ষক, রাজশাহী কলেজ


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল - dainik shiksha সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0038940906524658