সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে হাঁটু পানিতে নামাজ

নিজস্ব প্রতিবেদক |

অবশেষে জানা গেল পানিতে দাঁড়িয়ে ঈদের নামাজ আদায়ের রহস্য। খুলনার কয়রা উপজেলা আওয়ামী লীগের দুই নেতার রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে ঈদের নামাজ পড়া হয়েছে। মূলত সরকারকে বেকায়দায় ফেলতেই হাঁটু পানিতে ঈদের নামাজ আদায় করা হয়েছে।

অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে বেড়িবাঁধ ভেঙে খুলনার কয়রা উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এই বাঁধের ওপর হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে ঈদের নামাজ পড়েছেন উপজেলার হাজারো মানুষ।

অথচ পাশেই উঁচু রাস্তা এবং কাছাকাছি ২ নম্বর কয়রা দোতলা ভবন শেখ বাড়ি জামে মসজিদ; সেখানে নিয়মিত নামাজ আদায় করা হয়। উঁচু রাস্তা এবং মসজিদ থাকতে ঈদের নামাজ কেন পানিতে দাঁড়িয়ে আদায় করা হলো এই প্রশ্ন সবার। জায়গা যদি না থাকতো তাহলে একই সময়ে তার পাশে রাস্তার ওপর আরেকটি ঈদের নামাজের জামাত কিভাবে পড়ানো হলো? এসব প্রশ্নের অনুসন্ধানে মিলেছে মূলত রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে এমন ঘটনা ঘটেছে।

হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে ঈদের নামাজের ইমামতি করেছেন খুলনা দক্ষিণ জেলা জামায়াতের আমির সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান অ খ ম তমিজ উদ্দীন। তার পেছনে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়লেন কয়রা উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ও বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম।

স্থানীয় অনেকেই বলছেন, পরিকল্পিতভাবে পানিতে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ানো হয়েছে। সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে এমনটি করা হয়েছে। জামায়াত ও আওয়ামী লীগ নেতার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে এ কাজ করা হয়েছে।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ২০ মে রাতে ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের তাণ্ডবে লন্ডভন্ড হয়ে যায় কয়রা উপজেলা। সেই সঙ্গে নদীতে জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ২৩টি বেড়িবাঁধ ভেঙে কয়রা সদরসহ চার ইউনিয়নের ৭০টি গ্রাম প্লাবিত হয়। ভাঙনকবলিত এলাকার মানুুষ লোনা পানি থেকে রেহাই পেতে স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করছেন। এরই মধ্যে ঈদের দিন সোমবার (২৫ মে) সদর ইউনিয়নের ২ নম্বর কয়রা এলাকায় ভেঙে যাওয়া স্থানে স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করতে আসেন প্রায় দুই হাজার মানুষ। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে ঈদের নামাজ পড়েছেন। অথচ তাদের পাশেই ছিল উঁচু রাস্তা এবং শেখ বাড়ি জামে মসজিদ।

অনুসন্ধানে জানা যায়, কয়রা উপজেলা আওয়ামী লীগ দুটি গ্রুপে বিভক্ত। মূল গ্রুপ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মহসিন রেজার নেতৃত্বে। অন্য গ্রুপ উপজেলা যুবলীগ সভাপতি বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান এস এম শফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে। উপজেলা চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলামের সঙ্গে জামায়াত-বিএনপির লোকদের সম্পর্ক ভালো থাকায় উঁচু স্থানে নামাজ না পড়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করা হয়েছে। তার নেতৃত্বে এটি করা হয়েছে।

 হাঁটু পানিতে ঈদের নামাজ পড়ার প্রতিবাদ জানিয়েছেন খুলনা মহানগরীর সোনাডাঙ্গা থানা কৃষকলীগের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আল মাসুম খান। এ বিষয়ে তিনি তার ফেসবুক ওয়ালে লেখেন-

“খুলনার কয়রায় জলের মধ্যে ঈদের জামাত, পুরো ঘটনাটি সাজানো। সেই বাসন্তীর জালের মতো ঘটনা, বহির্বিশ্বে ব্যাপকভাবে বিক্রি হচ্ছে এই ছবি। শেখ হাসিনা সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার অপচেষ্টা। পাশেই উঁচু সড়ক থাকতে জলের মধ্যেই কেন ঈদের নামাজ পড়তে হবে? পেশাদার ফটো সাংবাদিকদের তোলা, আর পানির মধ্যে জামাতে ঈদের নামাজ আদায় করা, ফেইক সেজদা এবং ব্যাপক প্রচারণা; বিএনপি-জামায়াত-শিবির প্রথম প্রচার করে। আর ঢাকার সস্তা গণমাধ্যমগুলোও গোগ্রাসে গিলছে; এই ষড়যন্ত্রের রহস্য উদঘাটন জরুরি। এই ঈদের জামাতে ইমামতি করেছে কয়রা জামায়াতের আমির, রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার আসামি, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মাওলানা আ খ ম তমিজ উদদীন। সবাই একবার ভেবে দেখুন, মহাসড়ক বাদ দিয়ে জলের মধ্যেই কেন ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হবে? আর কোনো ধর্মপ্রাণ মুসুল্লি সেজদাবিহীন অশুদ্ধ এই নামাজ পড়বে না, অতিদ্রুত এই ষড়যন্ত্রের পেছনে থাকা বিএনপি জামায়াত ও শিবিরের কুশীলবদের খুঁজে বের করতে হবে।”

পানিতে নামাজ পড়াকে ষড়যন্ত্র উল্লেখ করে খুলনা মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক শফিকুর রহমান পলাশ ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “এটা জামায়াতি ষড়যন্ত্র। পুরাটাই ক্যামোফ্লেক্স করা হয়েছে। দেশ-বিদেশে ধর্মপ্রাণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। যেমনটি এর আগে জামায়াত নেতা কারাবন্দী দেলোয়ার হোসেন সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে বলে তারা গল্প বানিয়েছিল।”

তিনি বলেন, “ধর্মীয় সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগিয়ে জামায়াতিরা আবারও মিথ্যাচারে মাঠে নেমেছে। পানিতে নামাজ পড়ার এই ছবি আমাদের ছেলে মেয়েরাও লাইক দিয়েছে, শেয়ার করেছে না জেনেই। চলমান করোনাভাইরাস ও আম্ফানে দেশ ও জাতি যখন দিশেহারা তখন জামায়াতিরা রাজিনীতি করতে মাঠে নেমেছে। সহজ-সরল, ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের ব্যবহার করেছেন জামায়াত নেতারা। এটা পরিকল্পিতভাবেই তারা করেছে।” 

তিনি বলেন, “কৌতুহলি হয়ে আমি নিজেও ঘটনার পরে খোঁজ-খবর নিয়েছি। কয়রা উপজেলা সদর ইউনিয়নে পবিত্র ঈদুল ফিতরের নামাজ হাঁটু পানিতে পড়া নিয়ে চারিদিকে কৌতুহল সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, ওই এলাকায় কি কোনো শুকনো জায়গা নেই, যেখানে নামাজ আদায় করা সম্ভব? বিভিন্ন সূত্রে খবর নিয়ে আমরা জানতে পারি, জামায়াতের একজন আমির ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান তিনি ও তার দলীয় নেতা-কর্মীরা এলাকার সহজ-সরল মানুষকে বিভ্রান্ত করে এই কাজ করেছেন। আসল বাস্তবতা হচ্ছে প্রকৃতির উপর কোনো মানুষের হাত নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ এলাকার মানুষের জন্য অনেক কাজ করছেন এবং করে যাচ্ছেন। কাজ করেছেন বলেই এত বড় দুর্যোগেও সেখানে মানুষের কোনো প্রাণহানি ঘটেনি।” 

কয়রাবাসীর উদ্দেশ্যে পলাশ বলেন, “হতাশ হবেন না। ইতোমধ্যে আমাদের প্রিয় নেত্রী সেনাবাহিনীর সদস্যদের বাঁধ নির্মাণের জন্য দায়িত্ব দিয়েছেন।” 

কয়রা অঞ্চলের আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ছাত্রলীগসহ সবাইকে সতর্কতার সাথে কাজ করার অনুরোধ করে তিনি আরও বলেন, “গুজব ছড়ানোসহ অপপ্রচার সম্পর্কে বিস্তারিত না জেনে ভুল প্রচার করা উচিৎ নয়,আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ, আসুন আমরা গুজব পরিহার করি।”

এ বিষয়ে কয়রা উপজেলা চেয়ারম্যান এসএম শফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, কয়রার উত্তর বেদকাশী ও কয়রা সদরসহ মহারাজপুর ইউনিয়নের একটি অংশ এখনও পানিতে তলিয়ে রয়েছে। বাঁধ মেরামতের কাজ অব্যাহত রয়েছে। পানিতে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়া মুখ্য বিষয় ছিল না। ওই দিন এলাকার ৫-৬ হাজার মানুষ বাঁধ মেরামত করেছেন। সেখানে পানি আটকানো ছিল বড় ব্যাপার।

পাশের মসজিদে দেড়শ লোকেরও জায়গা হবে না জানিয়ে তিনি বলেন, এজন্য ওয়াজিব নামাজ পড়তে অনেকেই মসজিদে না গিয়ে বাঁধের স্থানে পানিতে দাঁড়িতে নামাজ আদায় করেছেন। এখানে অপরাজনীতির কিছুই নেই। বাঁধে দাঁড়িয়ে এত মানুষ একসঙ্গে নামাজ পড়তে পারতেন না।

তবে কয়রা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মহসিন রেজা বলেন, আমাদের বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন শফিকুল ইসলাম। তিনি মদদ দিয়েছেন। মূলত তার কারণে জামায়াত-শিবির এ সুযোগ পেয়েছে। কেননা বাঁধের আড়ালে তাদের লক্ষ্য ছিল সবাই একত্র হবে। এজন্য পাশে উঁচু জায়গা ও মসজিদ থাকতেও হাঁটু পানিতে নামাজ পড়েছেন তারা। তাছাড়া, নামাজ তো শুদ্ধ হয়নি। সেজদা করা যায়নি। 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের মানদণ্ড কী? - dainik shiksha শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের মানদণ্ড কী? অবসর-কল্যাণে শিক্ষার্থীদের দেয়া টাকা জমার কড়া তাগিদ - dainik shiksha অবসর-কল্যাণে শিক্ষার্থীদের দেয়া টাকা জমার কড়া তাগিদ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে সুপ্রিম কোর্টের ফতোয়ার রায় পাঠ্যপুস্তকে নিতে হবে - dainik shiksha সুপ্রিম কোর্টের ফতোয়ার রায় পাঠ্যপুস্তকে নিতে হবে সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি - dainik shiksha সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি - dainik shiksha বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0035600662231445