সরকারি জমি বিক্রি করেন ‘মন্ত্রীর বড় ভাই’, শিক্ষক নিয়োগ-বদলিতে ঘুষের অভিযোগ

কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি |

কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলায় কোটি টাকা মূল্যের সরকারি খাস জমি অবৈধভাবে বিক্রির অভিযোগ উঠেছে সুরুজ্জামাল মিয়া নামে এক আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে। তিনি রৌমারী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক। এলাকায় তিনি ‘মন্ত্রীর বড় ভাই’ হিসেবে পরিচিত। যাদুরচর ইউনিয়ন ভূমি অফিসের সামনেই সরকারি জমি অবৈধভাবে বিক্রি ও দখলের ঘটনা ঘটলেও স্থানীয় প্রশাসন নিরব। তার বিরুদ্ধে শিক্ষক নিয়োগ ও বদলির নামে অর্ধকোটি টাকা ঘুষ নিয়ে তা আত্মসাৎ করার অভিযোগও আছে। 

মঙ্গলবার সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, উপজেলার কর্তিমারী বাজারের উত্তর পাশে যাদুরচর ইউনিয়ন ভূমি অফিস। এ অফিস ঘেঁষা একটি সরকারি জলাশয় রয়েছে। কর্তিমারী হাট-বাজারের পানি নিষ্কাশনের একমাত্র ড্রেনটি গিয়ে ঠেকেছে ওই জলাশয়ে। ওই জলাশয়ে আরসিসি পিলার করে নির্মাণ করা হচ্ছে বহুতল ভবন। অন্য পাশে কয়েকজন শ্রমিক কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। আরসিসি পিলারের ওপর চৌচালা ঘর নির্মাণ করে তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগের ওই নেতা সরকারি জমির একাংশ বিক্রি করে হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা।


 
যাদুরচর ইউনিয়ন ভূমি অফিস সূত্রে জানা যায়, রৌমারী উপজেলার যাদুরচর মৌজায় এসএ ও আরএস রেকর্ডে ১নং খাস খতিয়ানভুক্ত। আরএস ৩৬৩২ নম্বর দাগে মোট জমির পরিমাণ ৫৫শতক। এরমধ্যে ৩৫ শতক জায়গাটি গত যুগ যুগ ধরে হাট-কর্তিমারী বাজারের পানি নিষ্কাশনের একমাত্র জলাশয় হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছিলো।
 
২০২২ খ্রিষ্টাব্দের ২০ ফেব্রুয়ারি রৌমারী উপজেলার তৎকালীন নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) আল ইমরান ও যাদুরচর ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা গোলাম মর্ত্তুজা আল ফারুখ স্বাক্ষরিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, জমিটি এসএ এবং আরএস সরকারের নামে ১ নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত। সুরুজ্জামাল মিয়া ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ জানুয়ারিতে ৯৯/৫৩ নম্বর এবং ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে ২৬ অক্টোবরে ৩৪২৬/৬৬ নম্বরের যে দুটি দলিলের কথা বলছেন তা জাল ও চক্রান্তমূলক। 


 
কিন্তু গত ২০২০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে এ জলায়শয়টি অবৈধভাবে ধাপে ধাপে দখল, ভরাট, স্থাপনা নির্মাণ এবং প্লট আকারে বিক্রি করে চলছেন এলাকার কথিত ‘মন্ত্রীর বড় ভাই’ সুরুজ্জামাল মিয়া। দীর্ঘ চার বছর ধরে ভূমি অফিস ঘেঁষা জায়গায় অবৈধ দখল কার্যক্রম ও সরকারি জমি বিক্রি করলেও নিরব ভূমিকায় স্থানীয় প্রশাসন।

নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক স্থানীয় নেতা ও ব্যবসায়ীরা দৈনিক শিক্ষাডটকমকে জানান, মন্ত্রীর বড় ভাই খ্যাত আওয়ামী লীগ নেতা সুরুজ্জামাল মিয়ার বিরুদ্ধে অংসখ্য অভিযোগ রয়েছে। গত ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে আজাহার মন্ডল নামের এক নৌকার মাঝিকে অপহরণ ও গুমের মামলা রয়েছে। ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ১০ সেপ্টেম্বর এনএসআইসহ ভ্রাম্যমাণ আদালতের ওপর হামলার অভিযোগ আছে সুরুজ্জামাল ও তার ছেলেদের বিরুদ্ধে। ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ মার্চ সরকারি স্কুলের এক প্রধান শিক্ষককে প্রকাশ্যে মাথা ফাটিয়ে রক্তাক্ত করেন তিনি। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের জাতীয় নির্বাচনের পর দিন ৩১ ডিসেম্বর নিরিহ পরিবারের ওপর হামলা-নির্যাতন চালিয়ে দুটি গরু ছিনিয়ে নিয়ে জবাই করে ভূড়িভোজ করান তার সর্মথকদের। এছাড়াও ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ মে লোডশেডিংয়ের কারণে বিদ্যুৎ বিল না দিতে গ্রাহকদের নিরুৎসাহিত করতে এলাকায় মাইকিং করান তিনি। একই বছরের ২৮ মার্চ তার ছেলের কাগজপত্রহীন মোটরসাইকেল আটকানোয় ট্রাফিক পুলিশের চাকরিচ্যুত করার হুমকি দেন জনসম্মুখে।
এছাড়াও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ ও বদলির কথা বলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের কাছ থেকে অর্ধকোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এতো অপকর্মের পরও দল থেকে নেয়া হয়নি কোনো সাংগঠনিক ব্যবস্থা। উল্টো বিতর্কিত এই নেতাকে পুরস্কার হিসেবে দলীয় পদে পদোন্নতি দেয়ার সুপারিশ করছে একটি মহল।

স্থানীয়রা বলছেন, একজন ‘স’ মিল মিস্ত্রি থেকে কোটিপতি বনে যান সুবিধাবাদী নেতা সুরুজ্জামাল। তিনি কুড়িগ্রামের সাবেক এমপি গোলাম হোসেনের সঙ্গে জাতীয় পার্টি এবং জাতীয় পার্টি-জেপি এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের অনুসারী ছিলেন। কিন্তু ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে বর্তমান প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন প্রথম আওয়ামী লীগের এমপি নির্বাচিত হন। এরপর থেকে তার অনুসারী হয়ে বড় ভাই হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন সুরুজ্জামাল। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাগিয়ে নেন আওয়ামী লীগের পদ-পদবি। সেই থেকে শুরু হয় তার অপরাধ জগতের রাজত্ব। 

কর্তিমারী বাজারের নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম জায়গা নেয়ার কথা স্বীকার না করে দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, আমার দোকান ঘরের পেছনে স্থাপনা নির্মাণ করেছে সুরুজ্জামাল মিয়া। জমিটি খাস খতিয়ানের ১ নম্বরে অন্তর্ভুক্ত। দলিল না থাকায় আমি জমিটি নেইনি। কিন্তু গোডাউন ঘর হিসেবে ভাড়ার কথা রয়েছে। 

রড সিমেন্ট ব্যবসায়ী সুরুজ্জামান বলেন, আওয়ামীলীগ নেতা সুরুজ্জামালের কাছ থেকে স্ট্যাম্প মূলে পাঁচ লাখ টাকার বিনিময়ে ১০বাই ২০ হাত জমি নিয়েছি দোকান ঘরের জন্য। সরকারি জমি কি-না তা আমার জানা নেই।

আওয়ামী লীগ নেতা সুরুজ্জামাল মিয়া দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, সরকারের সঙ্গে কেস করে আমি রায় পেয়েছি আমি। আমার তিনটি বাড়ি রয়েছে। আমি কাগজপত্র এসিল্যান্ড, এডিসিসহ কর্মকর্তাদের দেখিয়েছি কোনো সমস্যা নেই। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেন। 

তবে স্থানীয় বাসিন্দা ৯০ বছর বয়সী রাফিক হক দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, কোনো কালেই আরএস ৩৬৩২ নং দাগে সুরুজ্জামাল গংদের কোনো জমি ছিলো না। পুরোপুরি অবৈধভাবে এই দাগের জমি দখল করে তিনি স্থাপনা নির্মাণ ও জায়গা বিক্রি করছেন। 

কর্তিমারী বাজারের বণিক সমিতির সভাপতি লিয়াকত আলী দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, সুরুজ্জামালের দখলকৃত জলাশয়টি সরকারি সম্পত্তি। সে অবৈধভাবে দখল করে স্থাপনা নির্মাণ ও বিক্রি করছেন। এই নিয়ে আমরা ভূমি অফিসকে বার বার বলেছি। কিন্তু তারা অদৃশ্য শক্তির কারণে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। 

সাবেক এমপি রুহুল আমিন দৈনিক শিক্ষাডটকমকে জানান, কর্তিমারী বাজারের সরকারি সম্পত্তি অবৈধভাবে দখল করার বিষয়ে এসিল্যান্ড, ইউএনও,ডিসি এবং বিভাগীয় কমিশনারকে অবহিত করেছি। তারা আমাকে আশ্বাস দিয়েছেন দ্রুত এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। এই সরকারি সম্পত্তি দখল করে টাকার পাহাড় গড়ায় আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে এর প্রভাব ফেলবে। কেননা সরকারি সম্পদ রক্ষার করার যোগ্যতা যদি স্থানীয় প্রশাসনের না থাকে জাতি তাদের কাছে নিরপেক্ষতা আশা করতে পারে না।
 
জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক সাইদুল আরীফ দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, বিষয়টি আমি অবগত হয়েছি। সরকারি সম্পত্তি রক্ষার্থে আমরা দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবো।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
বাকী সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিয়োগ একসঙ্গে : শিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha বাকী সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিয়োগ একসঙ্গে : শিক্ষা উপদেষ্টা আমি আশ্বাস দিচ্ছি, নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha আমি আশ্বাস দিচ্ছি, নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপদেষ্টা শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন : এহছানুল হক মিলন - dainik shiksha শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন : এহছানুল হক মিলন পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন ৪৯ হিন্দু শিক্ষক - dainik shiksha পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন ৪৯ হিন্দু শিক্ষক শিক্ষাগুরুর মর্যাদা কবিতাটি পাঠ্যবই থেকে বাদ দিয়েছিলেন কামাল চৌধুরী - dainik shiksha শিক্ষাগুরুর মর্যাদা কবিতাটি পাঠ্যবই থেকে বাদ দিয়েছিলেন কামাল চৌধুরী কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0027010440826416