সরকারি স্কুলের ৪৩ শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোচিং বাণিজ্যের অভিযোগ

চট্টগ্রাম প্রতিনিধি |

সরকারি নীতিমালার বাইরে গিয়ে শিক্ষকদের সব ধরনের কোচিং বাণিজ্যে জড়ানোর বিষয়টি হাইকোর্ট থেকে নিষিদ্ধ। শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে নীতিমালা জারি করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও। নির্দেশনা না মানলে এমপিও স্থগিত বা বাতিল, এমনকি চাকরি থেকে বরখাস্ত করার মতো শাস্তির বিধানও করা হয়েছে। তবুও সব কিছুকে 'থোরাই কেয়ার' করে কোচিং বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন চট্টগ্রাম মহানগরের নামকরা ৯টি সরকারি স্কুলের ৪৩ জন শিক্ষক। তাদের বেশিরভাগই ইংরেজি ও গণিতের শিক্ষক।  

প্রত্যেকেই প্রতিমাসে বাড়তি কামিয়ে নিচ্ছেন কয়েক লাখ টাকা। এক স্কুলে তিন বছরের বেশি না থাকার বিধান থাকলেও এসব শিক্ষক একই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ১০ থেকে ২৮ বছর পর্যন্ত। এভাবে দশকের পর দশক একই প্রতিষ্ঠানে থাকার কারণে একেকজন ক্ষমতাধরও বনে গেছেন। তাদের অবৈধ কোচিং বাণিজ্যসহ নানা অপকর্মের বিস্তারিত তুলে ধরে প্রয়োজনীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম থেকে তালিকা পাঠানো হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে।

জড়িত যে শিক্ষকরা :কোচিং বাণিজ্যে জড়িত ৪৩ শিক্ষকের মধ্যে রয়েছেন- এসএম আহমদ শফি (ইংরেজি), মোরশেদ জামান (গণিত), আনজুমান আরা (জীববিজ্ঞান), আশীষ শীল (শারীরিক চর্চা), জাহাঙ্গীর আলম (ইংরেজি), ধনঞ্জয় দেবনাথ (বিজ্ঞান), জাহাঙ্গীর আলম (গণিত), মো. নুরুল আলম (ইংরেজি), আশীষ চৌধুরী (শারীরিক শিক্ষা), খুরশিদ আলিয়া (সামাজিক বিজ্ঞান), আমিনুল ইসলাম (জীববিজ্ঞান), বিপ্লব দাশ (বাংলা), শর্মিলা চৌধুরী (ইংরেজি), জাফর আলম (রসায়ন), আবু মো. সাইফুল্লাহ (গণিত), দীপক কুমার সাহা (কৃষিশিক্ষা), আজিজুল হক নিজামী (ইসলাম ধর্ম), আবদুল মজিদ (ইসলামিয়াত), সুশেন নাথ (চারুকারু), পান্না বড়ূয়া (সামাজিক বিজ্ঞান), কানিজ ফাতেমা জেসমিন (চারুকারু), মো. শহীদুল্লাহ (গণিত), অনুপম দাশ (জীববিজ্ঞান), কামরুল হাসান (জীববিজ্ঞান), আমীর হোসেন (কৃষিশিক্ষা), গোলাম মোস্তফা চৌধুরী (ইংরেজি), ফরিদা ইয়াছমিন (ব্যবসায় শিক্ষা), মেহের নিগার (ইংরেজি), রতন কান্তি দাশ (চারুকারু), প্রদীপ কুমার দাশ (গণিত), নুরুল কাদের সিকদার (ইংরেজি), মুজিবুর রহমান (সামাজিক বিজ্ঞান), কামাল উদ্দীন জাফরী (ইসলাম ধর্ম), মো. জাকারিয়া আমিন (গণিত), মো. আবুল কালাম (গণিত), রিদোয়ানুল বারী (গণিত), সুকুমার জলদাস (কৃষিশিক্ষা), অভিজিৎ দাশ (রসায়ন), শাহীনা আকতার চৌধুরী (গণিত), জসিম উদ্দিন (গণিত), অঞ্জন কংস বণিক (বাংলা), কাকলী বড়ূয়া (বাংলা) এবং অঞ্জনা বড়ূয়া (ইংরেজি)। এ শিক্ষকরা যেসব স্কুলে কর্মরত রয়েছেন সেগুলো হলো- কলেজিয়েট সরকারি স্কুল, নাসিরাবাদ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, খাস্তগীর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, সরকারি মুসলিম হাই স্কুল, চট্টগ্রাম সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, চট্টগ্রাম সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়, হাজি মো. মহসিন সরকারি হাই স্কুল, সিটি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এবং বাকলিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়।

কী বলছেন মাউশি কর্মকর্তা ও শিক্ষাবিদরা : বিষয়টি নিশ্চিত করে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর, চট্টগ্রামের উপপরিচালক হোসনে আরা বেগম বলেন, শুধু টাকার লোভে এই শিক্ষকরা হাইকোর্টের আদেশ ও মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনাও অমান্য করছেন। এসব শিক্ষকের নাম, পদবি, অপকর্মের বিস্তারিত উল্লেখ করে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে শিক্ষা অধিদপ্তরে চিঠি দিয়েছি। তিনি বলেন, স্কুল কর্তৃপক্ষ, অভিভাবক, সচেতন নাগরিকসহ সংশ্নিষ্টদের কাছ থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে কোচিং বাণিজ্যে লিপ্ত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছি আমরা। তিনি জানান, কোচিং বাণিজ্যে জড়িত

থাকার কারণে মাউশি এসব শিক্ষককে বেশ কয়েকবার সতর্ক, এমনকি শোকজও করেছিল। কোনো কিছুতেই তারা কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করেননি।

মাউশির অধিকাংশ কর্মকর্তার অভিযোগ, নিয়ম অনুযায়ী শিক্ষকদের এক কর্মস্থলে থাকার কথা সর্বোচ্চ তিন বছর। এসব শিক্ষক কেউ কেউ ২৫ থেকে ২৮ বছর ধরে আছেন একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। দীর্ঘদিন ধরে একই প্রতিষ্ঠানে থাকার কারণে তারা বিভিন্নভাবে ক্ষমতাধর হয়ে উঠেছেন। কোনো নিয়মকানুনের তোয়াক্কা করছেন না তারা। অতিরিক্ত অর্থ আয়ের লোভে পড়েই বেশিরভাগ শিক্ষক জড়িয়ে পড়েছেন কোচিং বাণিজ্যে। অনেক শিক্ষকের বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ পাওয়া যায়। তাদের হাত অনেক উপরে, ব্যবস্থা নেওয়া যায় না।

এ ব্যাপারে শিক্ষাবিদ ও সম্প্রতি অবসরে যাওয়া চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক শাহেদা ইসলাম বলেন, একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সব শিক্ষার্থী কখনও পড়ালেখায় একই মানের হবে না। সব শিক্ষকও আবার একইভাবে পাঠদানে পারদর্শী নন। তাই নির্দিষ্ট সময় শেষে শিক্ষক বদলির বিষয়টি অবশ্যই ইতিবাচক। এক প্রতিষ্ঠান থেকে আরেক প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক বদলি হলে পাঠদানে পরিবর্তন আসার পাশাপাশি তা শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়ের জন্যই ভালো। শিক্ষার মানোন্নয়নের স্বার্থে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শিক্ষকদের অন্যত্র বদলি করা উচিত।

ক্ষুব্ধ অভিভাবকরাও :অভিযোগ আছে, বছরের পর বছর যারা একই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন, তাদের অনেকে শিক্ষাকে পরিণত করেছেন বাণিজ্যে। শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে তারা কোচিং ও প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করেন। নিজেদের কোচিং সেন্টারে ভর্তি না হলে এসব শিক্ষক পরীক্ষার খাতায় ইচ্ছাকৃতভাবে কম নম্বর দেওয়াসহ অনেক সময় শিক্ষার্থীদের অকৃতকার্যও করিয়ে দেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কলেজিয়েট স্কুলের কয়েকজন অভিভাবক বলেন, পড়ালেখায় মেধাবী হলেও শুধু সংশ্নিষ্ট বিষয়ের শিক্ষকের কোচিং সেন্টারে না পড়ার কারণে পরীক্ষায় সন্তানরা ভালো নম্বর পায় না। অথচ ওই শিক্ষকের কোচিংয়ে পড়া যেসব শিক্ষার্থী নিয়মিত ক্লাসে থাকে না; তারাই পরীক্ষায় নম্বর বেশি পায়।

নাসিরাবাদ স্কুলের এক ছাত্রের অভিভাবকের অভিযোগ, নিজেদের কোচিং সেন্টারে না পড়লে অনেক শিক্ষক শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অভিভাবকদেরও নানাভাবে হুমকি-ধমকি দেন।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা - dainik shiksha মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা - dainik shiksha দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0030632019042969