সহমত পোষণ না করায় চার ছাত্রের পরীক্ষা আটকে দিলেন শিক্ষক

দৈনিক শিক্ষাডটকম প্রতিবেদক |

দৈনিক শিক্ষাডটকম প্রতিবেদক : জাবির ফার্মেসি বিভাগের মেসেঞ্জার গ্রুপে একটি মেসেজের প্রতিক্রিয়া এবং মন্তব্যের সূত্র ধরে চার শিক্ষার্থীকে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় বসতে দেননি সভাপতি অধ্যাপক ড. মুহম্মদ দিদারে আলম মুহসিন। তবে, এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট বাকি শিক্ষার্থীরা সভাপতির কাছে লিখিতভাবে ক্ষমা চাইলে তাদের পরীক্ষায় বসতে দিয়েছেন তিনি।
দিদারে আলম মুহসিন বিভাগের সভাপতির পাশাপাশি ৪৫ ব্যাচের স্নাতকোত্তরের পরীক্ষা কমিটির সভাপতিও। তিনি দাবি করেছেন, শিক্ষার্থীরা ‘অসৌজন্যমূলক আচরণ’ করেছেন, কিন্তু ক্ষমা চাননি। তাদের আচরণ শিক্ষার্থীসুলভ না। এজন্য তাদের পরীক্ষার ফর্মে তিনি স্বাক্ষর করেননি। বাকিদের মতো চারজন তাদের ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমা প্রার্থনা করলে তিনিও তাদের ক্ষমা করে দিতেন।


ভুক্তভোগী ওই চার শিক্ষার্থী হলেন- রায়হানুল হক, আবু রায়হান, আবু বকর সিদ্দীক তায়েফ এবং রাব্বী হাসান।
ঘটনার সূত্রপাত ২ ফেব্রুয়ারি। ‘বাংলাদেশ ফার্মেসি স্টুডেন্ট এসোসিয়েশন (বিপিএসএ)’ এর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিভাগের সভাপতি দিদারে আলম মুহসিন মেসেঞ্জার গ্রুপে লিখেন, ‘আমার কাছে বিপিএসএ সভাপতি ফাহিম শাহরিয়ার (৪৬ ব্যাচ) তার সাথে ৪৭তম ব্যাচের ২ জন শিক্ষার্থী গুরুতর অসদাচরণ করেছে বলে অভিযোগ দিয়েছে। প্রাথমিক অনুসন্ধানে এ অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। এ ধরণের ঘটনা খুবই অনভিপ্রেত। এ ব্যাপারে বিস্তারিত অনুসন্ধান শেষে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ 

সভাপতির এই পোস্টে ৪৫ ব্যাচের সাত জন শিক্ষার্থী নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানান। এরমধ্যে আবু রায়হান লিখেন, ‘আশা করি একটা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত হবে।’ আর তায়েফ লিখেন, ‘নির্বাচনের পূর্ব মুহুর্তে এভাবে দুইজন শিক্ষার্থীর নামে অভিযোগ দেয়ার ফলে নির্বাচন নিয়ে তাদের আকাঙ্খা, উদ্দীপনায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এই অভিযোগের পিছনে অভিযোগকারীর স্বার্থ লুকায়িত থাকতে পারে।’
শিক্ষার্থীদের মতে, সাধারণত চতুর্থ বর্ষ থেকে বিপিএসএ এর কমিটি দেয়া হয়। কারণ ওইসময় চাপ কম থাকে। আর পঞ্চম বর্ষে শিক্ষার্থীরা হসপিটাল ট্রেনিং, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং, সার্ক ট্যুরের আয়োজন করে। যার কারণে, পঞ্চম বর্ষের একজন শিক্ষার্থী তার একাডেমিক কার্যক্রম, ট্রেনিং এবং ক্যারিয়ার এর প্রস্তুতি নিয়েই ব্যস্ত থাকে। পঞ্চম বর্ষ থেকে সভাপতি নির্বাচন করলে সময় দিতে পারবে কি না সন্দেহ ‘আমাদের মনে হয়েছে এই নির্বাচনে সভাপতি স্যারের একটা প্রভাব আছে। তিনি তার অনুগত শিক্ষার্থীকে সভাপতি পদে নিয়ে আসতে চান। এজন্য ৪৭ ব্যাচের ওই দুই প্রার্থীর বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যমূলকভাবে অভিযোগ আনা হয়েছে। এজন্য আমরা সুষ্ঠু তদন্ত চেয়েছি।’ বলেছি, নির্বাচনের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী ব্যতীত অন্য কারো হস্তক্ষেপ সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত করে।

এরপরই বিভাগীয় সভাপতি মুহসিন ক্ষিপ্ত হয়ে সাতজনকে মেনশন করে প্রথমে গ্রুপে এবং পরে লিখিতভাবে ক্ষমা চাইতে বলেন। শিক্ষার্থীদের মানুষ করার হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি লিখেন, ‘প্রাইভেট-পাবলিক মিলিয়ে আমার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতার বয়স প্রায় ২৭ বছর। এই দীর্ঘ পথ চলায় অনেক সুবোধ-সজ্জন শিক্ষার্থী যেমন পেয়েছি, কিছু ইঁচড়ে পাকা, ত্যাড়র শিক্ষার্থীকেও মানুষ করার সুযোগ হয়েছে। শিক্ষক হিসেবে আমার জায়গা থেকে এদের প্রত্যেককে যথোচিত শিক্ষা দিয়ে সুশিক্ষিত করার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।’

এরমধ্যে ভুলে প্রতিক্রিয়া পড়ে গেছে জানিয়ে একজন শিক্ষার্থী সাথে সাথে ক্ষমা চান। কিন্তু বাকিরা ক্ষমা চাননি। তাদের দাবি, এমন কোন অপরাধ বা বেয়াদবি করেননি, যার কারণে ক্ষমা চাইতে হবে।

ফার্মেসি বিভাগের চলমান সেশন জটের মধ্যে ৪৫ ব্যাচও আছে। ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে ওই ব্যাচের স্নাতকোত্তরের পরীক্ষা হওয়ার কথা থাকলেও তিন বছরের মাথায় পরীক্ষা শুরু হয়েছে চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি। মার্চের ২৮ তারিখ তাদের লিখিত পরীক্ষা শেষ হয়। এখনও বাকি থিসিস এবং ব্যবহারিক পরীক্ষা।

ছয় বছরের শিক্ষাজীবন শেষ করতে নয় বছর লেগে যাওয়ার দীর্ঘ এই শিক্ষাজীবন নিয়ে হতাশাগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের অনেকেই তাই স্নাতক শেষ করে স্নাতকোত্তরে ভর্তি হয়ে প্রবেশ করেন চাকরি জীবনে। ভুক্তভোগী ওইসব শিক্ষার্থীসহ এই ৪৫ ব্যাচেও এমন ১৩-১৪ জন শিক্ষার্থী আছেন, যারা চাকরি করছেন। ফলে তারা নিয়মিত ক্লাস করতে পারেন না। এতে তাদের ক্লাসে উপস্থিতির হার ৬০ শতাংশের নিচে।

বিভাগের ছাত্র কল্যাণ উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. নুর আলম জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত নিয়মে ক্লাসে উপস্থিতির হার ৬০ শতাংশের নিচে হলে কোন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় বসতে পারবেন না। তবে, সভাপতির অনুমতি সাপেক্ষে পরীক্ষা দিতে পারবেন।

একই মত পোষণ করেন জীববিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক নূহু আলম। বলেন, সবসময় এ নিয়ম মানা হয় না। এখানে আমরা মানবিকতা দেখাই, ছাড় দেই।

কিন্তু ফার্মেসি বিভাগের সভাপতি মুহম্মদ দিদারে আলম মুহসিন সবার বেলায় মানবিকতা দেখালেও চার শিক্ষার্থীর ‘আচরণ শিক্ষার্থীসুলভ নয়’ উল্লেখ করে পরীক্ষায় বসতে দেননি।
৬ ফেব্রুয়ারি তায়েফ এবং রাব্বী হাসান স্নাতকোত্তরের ফরম পূরণ করে সভাপতির স্বাক্ষর নিতে গেলে তাদের ক্লাসে উপস্থিতির হার ৬০ শতাংশের নিচে থাকায় স্বাক্ষর করবেন না বলে জানান। বলেন, ‘এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম। তোমরা ক্লাস করোনি, এখন পরীক্ষা দিতে পারবে না।’

এসময় শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘বাকিরাও ক্লাস করেনি, তাদেরও উপস্থিতির হার ৬০ শতাংশের নিচে। তাদের ফরমে আপনি স্বাক্ষর করলে আমাদের কেন করবেন না?’ জবাবে, সভাপতি দিদারে আলম মুহসিন বলেন, ‘তোমার কার্যক্রম শিক্ষার্থীসুলভ নয়। যাদের আচরণ শিক্ষার্থীসুলভ তাদের আমি কনসিডার করতে পারি, তুমি এখন যাও। বাকিদেরটা আমি দেখবো। তোমার কেস আমার কাছে কনসিডার করার মতো মনে হয়নি।’ (এ সংক্রান্ত অডিও রেকর্ড এই প্রতিবেদকের হাতে আছে)

অপর এক অডিওতে সভাপতিকে বলতে শোনা যায়, ‘তুমি কেন আসছ? আমি দেখেছি তুমি আমার বিরুদ্ধে করা কমেন্টে লাইক দিয়েছ।’

তাদের এমন অবস্থা দেখে রায়হানুল হক ও আবু রায়হান আর স্বাক্ষরের জন্য সভাপবলেন, ‘স্যারের পোস্টে রিয়্যাক্ট দিয়েছি, কিন্তু আমরা ক্ষমা চাইনি। আমার দুই বন্ধুকে স্যার অনুমতি দেয়নি, অপমান করেছে। আমরা গেলে আমাদের সাথেও একই কাজ করবে। তাই আর যাইনি।’

আর বাকি দুই শিক্ষার্থীর একজন ক্ষমা চেয়ে পরীক্ষা দিয়েছেন। জানা গেছে, ওই ক্ষমা চাওয়ার জন্য গ্রুপে লিখা পোস্টটি সভাপতি দিদার নিজে লিখে ওই শিক্ষার্থীকে দিয়ে পোস্ট করিয়েছেন। অন্যজন বিসিএস পরীক্ষার জন্য আর বিভাগের পরীক্ষা দিতে আগ্রহী হননি।

 মুহম্মদ দিদারে আলম মুহসিন বলেন, “এটা একেক জনের কাছে একেক রকম। আমার কাছে যেটা খারাপ লাগবে সেটা অন্য জনের কাছে খারাপ নাও লাগতে পারে। আমি বলবো ওই ছাত্ররা ‘অসৌজন্যমূলক আচরণ’ করেছে আমার সাথে, কিন্তু ক্ষমা চায়নি। যাদের মধ্যে শিক্ষার্থীসুলভ আচরণ নেই আমি মনে করি না তাদের পরীক্ষায় বসার দরকার আছে। তাদের আমি ক্ষমা চাইতে বলেছি, তারা সেটা করেনি। আমি তো বলেছি, মাফ করে দিবো।”

‘আর তারা অনুতপ্ত হবে কীভাবে তাদের তো পরীক্ষা দেয়ার কোন ইচ্ছাই ছিল না। আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি বিভিন্ন সোর্স থেকে, তাদের কোন প্রস্তুতি ছিল না। এজন্য তারা পরীক্ষা দেয়নি। এখন তারা আমার বিরুদ্ধে এসব বলে বেড়াচ্ছে।’

সভাপতির এমন কর্মকাণ্ডের বিষয়ে কিছুই জানেন না জীববিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক নূহু আলম। তিনি বলেন, নিয়ম সবার জন্য সমান হতে হবে। উপস্থিতি ৬০ শতাংশের নিচে হয়ে একজন পরীক্ষা দিতে পারলো, আর একজন দিতে পারলো না ব্যক্তিগত ক্ষোভের কারণে এটা হতে পারে না। আমি বিষয়টি জানতাম না। এটা আমি খোঁজ নিয়ে দেখবো।

তিনি বলেন, ফার্মেসিতে সেশনজট আছে। সব শিক্ষার্থীর আর্থিক অবস্থা একরকম না। তাদের ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং আছে, অনেক প্র্যাকটিক্যাল আছে। ফলে অনেকেই আগে চাকরিতে প্রবেশ করেন। এসবক্ষেত্রে আমরা মানবিকতা দেখাই, ছাড় দেই।
এদিকে, ৪৫ ব্যাচের ইমদাদুল হক মিলন ২০২১  খ্রিষ্টাব্দের ১ ডিসেম্বর ফেসবুক গ্রুপ ‘আমরাই জাহাঙ্গীরনগর’ এ বিভাগের সেশনজট এবং পরীক্ষার ফলাফল না দেয়া নিয়ে একটি পোস্ট দেন। সেখানে তিনি কোন একটি অঘটন ঘটিয়ে ফেলারও ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, হতাশা থেকে এমন কিছু হলে তার জন্য ফার্মেসি বিভাগ এবং জাবি প্রশাসনকে নিতে হবে।

শিক্ষার্থীরা জানান, মিলনের ওই পোস্টে যারা প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন এবং মন্তব্য করেছেন তাদের সবাইকে মৌখিক পরীক্ষার সময় কারণ জানতে চেয়েছেন দিদারে আলম মুহসিন। তাদের হেনস্তা করেছেন।
 
সার্বিক বিষয়ে শুক্রবার উপাচার্য অধ্যাপক নূরুল আলমের সাথে দেখা করতে চাইলে তার ব্যক্তিগত সহকারী জানান, বন্ধের দিন উপাচার্য কারো সাথে দেখা করেন না। এরপর উপাচার্যকে মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি ধরেননি।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ডিআইএর নতুন পরিচালক অধ্যাপক আবু কাইয়ুম - dainik shiksha ডিআইএর নতুন পরিচালক অধ্যাপক আবু কাইয়ুম জাতীয়করণসহ তিন দাবিতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দপ্তরিদের অবস্থান - dainik shiksha জাতীয়করণসহ তিন দাবিতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দপ্তরিদের অবস্থান এমপিওর দাবিতে প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় শিক্ষকদের পদযাত্রা - dainik shiksha এমপিওর দাবিতে প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় শিক্ষকদের পদযাত্রা কারিগরিতে ৪০ শতাংশ নম্বরে উপবৃত্তি - dainik shiksha কারিগরিতে ৪০ শতাংশ নম্বরে উপবৃত্তি কাউকে হেনস্তা না করার আহ্বান বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের - dainik shiksha কাউকে হেনস্তা না করার আহ্বান বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের আটকের পর বিজিবিকে যে প্রলোভন দেখান বিচারপতি মানিক - dainik shiksha আটকের পর বিজিবিকে যে প্রলোভন দেখান বিচারপতি মানিক নয় বছরের শিক্ষিকাকে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হতে বললেন প্রধান শিক্ষক - dainik shiksha নয় বছরের শিক্ষিকাকে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হতে বললেন প্রধান শিক্ষক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0027589797973633