সহশিক্ষায় মাদারাসা এগিয়ে!

মাছুম বিল্লাহ |

সম্প্রতি বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো বা ব্যানবেইস ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের  শিক্ষা তথ্য প্রকাশ করেছে। সেখানে মাদরাসা শিক্ষা বিষয়ের একটি তথ্য আমাদের কিছুট অবাক করেছে। আমরা জানি যে, যেসব প্রতিষ্ঠানে ছাত্র ও ছাত্রীরা একই শ্রেণিতে পড়াশুনা করেন সেই ধরনের ব্যবস্থাকে আমরা সহশিক্ষা কিংবা কো-এডুকেশন বলে থাকি। সাধারণ অর্থে বা সমাজের বিশ্বাস অনুযায়ী, মাদারাসায় সাধারণত কনজারভেটিভ বা রক্ষনশীল পরিবারের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করে থাকেন এবং সেখানকার পরিবেশও অনেকটাই রক্ষণশীল। তবে, ব্যানবেইসের পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশের মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রায় ৮৭ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে ছাত্র ও ছাত্রীরা একত্রে লেখাপড়া করছেন অর্থাৎ সহশিক্ষা প্রথা বিদ্যমান। অন্যদিকে সহশিক্ষা প্রথা সাধারণ শিক্ষায় প্রায় ৮০ শতাংশ। এটির কোন কারণ সেখানে উল্লেখ করা হয়নি। তবে, শিক্ষাক্ষেত্রে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এবং আলোচনার দাবি রাখে।  

ব্যানবেইস-২০২৩ তথ্য বলছে, দেশে মাধ্যমিক স্কুল থেকে কলেজ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা স্নাতকোত্তর কলেজ পর্যন্ত সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থায় ৮০ দশমিক ২১ শতাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কো-এডুকেশন ব্যবস্থা বিদ্যমান। ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ৮৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ, আর মাদরাসায় ৮৭ দশমিক ৭ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কো-এডুকেশন ব্যবস্থা প্রচলিত। আশ্চর্য্যজনকভাবে কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো তথ্য ব্যানবেইসের রিপোর্টে উল্লেখ নেই। এটি ব্যানবেইসের দুর্বলতা বলা যেতে পারে। কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব বাস্তবে এখনও সেভাবে দেয়া হচেছ না- তাও বলা যেতে পারে।

ব্যানবেইসের তথ্য অনুযায়ী, মাধ্যমিক পর্যায়ে দেশে বর্তমানে মোট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে ২০ হাজার ৪৪৮টি। এর মধ্যে শুধু মেয়েদের জন্য রয়েছে ৩ হাজার ২৮৫টি বিদ্যালয় আর ছেলেদের জন্য রয়েছে ৩০৫টি। বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ১৬ হাজার ৪১৫টি বিদ্যালয়ে কো-এডুকেশন ব্যবস্থা রয়েছে, যা মোট বিদ্যালয়ের ৮০ দশমিক ২৭ শতাংশ। এছাড়া ৪৪৩টি বিদ্যালয়ে ‘সেপারেট কো-এডুকেশন’ ব্যবস্থা রয়েছে অর্থাৎ একই প্রতিষ্ঠানে ছেলে ও মেয়েদের জন্য আলাদা ক্যাম্পাস রয়েছে। 

ব্যানবেইসের তথ্য বলছে, মাদরাসার দাখিল পর্যায়ে মোট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৬ হাজার ৫১১টি। এর মধ্যে শুধু মেয়েদের জন্য ৯৭৬টি। কো-এডুকেশন রয়েছে ৫ হাজার ৫১২টিতে, যা মোট প্রতিষ্ঠানের ৮৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ। এছাড়া সেপারেট কো-এডুকেশন রয়েছে ১১টি প্রতিষ্ঠানে। স্কুল পর্যায়ের মতো কলেজ পর্যায়েও কো-এডুকেশন এগিয়ে রয়েছে মাদরাসা শিক্ষায়। আলিম থেকে কামিল পর্যন্ত মোট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২ হাজার ৭৪৮টি। এর মধ্যে মেয়েদের জন্য ১৪৯টি ও ছেলেদের জন্য ২৩টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কো-এডুকেশন ব্যবস্থা রয়েছে ২ হাজার ৫৫০টি প্রতিষ্ঠানে যা মোট প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৯২ দশমিক ৮০ শতাংশ। এছাড়া ২৬টি প্রতিষ্ঠানে ‘সেপারেট কো-এডুকেশন’ ব্যবস্থা রয়েছে। 

মাদারাসায় সহশিক্ষা প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজের অধ্যাপক ড. তানিয়া হক বলেন, আমাদের সমাজ শুধু নারী বা শুধু পুরুষের নয়। একজন শিশু যখন কো-এডুকেশন সিস্টেমে শিক্ষাগ্রহণ করে তখন সে এ বৈচিত্রকে সহজে গ্রহণ করতে শেখে। সবার সঙ্গে বেড়ে ওঠার ফলে তার মধ্যে পারস্পরিক সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধের বাস্তবিক চর্চা থাকে। এছাড়া কো-এডুকেশনের মাধ্যমে এ অনুধাবনও জন্মায় যে সমাজে প্রতিটি মানুষেরই সমান সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকার রয়েছে।’ 
ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. শামছুল আলম বলেন, ‘ইসলাম নারী শিক্ষাকে উৎসাহিত করেছে। আমাদের দেশের মাদরাসাগুলোতে বিপুলসংখ্যক নারী শিক্ষার্থী লেখাপড়া করেন। শহরাঞ্চলে সাধারণত নারী শিক্ষার্থীদের জন্য পৃথক ক্যাম্পাস থাকে। মফস্বল বা গ্রামাঞ্চলে অনেক ক্ষেত্রে একই সঙ্গে ক্লাস নেয়া হয়। তবে মাদরাসাগুলোয় ইসলামের বিধানের বিষয়ে সর্বোচচ গুরুত্ব দেয়া হয় এবং ইসলামের বিধান অনুসরণ করেই মাদরাসাগুলোয় এসব শিক্ষার্থীর শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করা হয়েছে।’

আমরা সামাজিক ও সাংষ্কৃতি বৈচিত্র্য ধারণ করি। ব্যক্তিভেদে পছন্দ ও চাহিদা আলাদা হয়। এ বৈচিত্রের কারণেই কো-এডুকেশন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেমন প্রয়োজন তেমনি ছেলে ও মেয়েদের বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও থাকা প্রয়োজন। 

সহশিক্ষা বা ছেলে-মেয়েকে একসঙ্গে পাঠদানের ব্যবস্থা তুলনামূলক বেশি কার্যকরী। ছাত্র ও ছাত্রীদের জন্য আলাদা অর্থাৎ বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর তুলনায় সহশিক্ষা ব্যবস্থায় থাকা শিক্ষার্থীরা কর্মজীবনে তুলনামূলক এগিয়ে থাকেন। কারণ, এটি সমাজ বাস্তবতার একটি অবিচেছদ্য অংশ। তারা একত্রে পড়াশুনা করলে এবং  বেড়ে উঠলে একে অপরেরর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেন, তাদের মধ্যে সহমর্মিতা, সহযোগিতা ও শেয়ারিংয়ের মনোভাব গড়ে উঠে যা বাস্তব জীবনে চলার পথে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। একে অপরের সাইকোলজি বুঝতে পারেন। আর অর্থনৈতিকভাবেও অধিকতর শ্রেয়। কারণ অতিরিক্ত শ্রেণিকক্ষের প্রয়োজন হয় না। বাস্তব জীবনের কমিউনিকেশন বা যোগাযোগ রক্ষার ক্ষেত্রেও নারী-পুরুষের একসঙ্গে লেখাপড়া করার বিষয়টি কার্যকর একটি পদ্ধতি। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও নেতৃত্বের বিষয়টিও এখানে জড়িত। শ্রেণিকক্ষের শিক্ষা শিক্ষার্থীদের জীবনকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে। শালীনতা বজায় রেখে এবং ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে সহশিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে গেলে মাদরাসা শিক্ষাও একটি জনপ্রিয় ‘স্ট্রিম অব এডুকেশন’ হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে। 

লেখক : ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
অ্যাডহক কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha অ্যাডহক কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নতুন নির্দেশনা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে অনতিবিলম্বে প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় এমপিওভুক্ত করতে হবে: নুর - dainik shiksha অনতিবিলম্বে প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় এমপিওভুক্ত করতে হবে: নুর কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে রিকশার ধাক্কায় জাবি ছাত্রীর মৃত্যু, ৩ জনকে পুলিশে সোপর্দ - dainik shiksha রিকশার ধাক্কায় জাবি ছাত্রীর মৃত্যু, ৩ জনকে পুলিশে সোপর্দ ছাত্রদের নতুন দল আসছে জানুয়ারিতে - dainik shiksha ছাত্রদের নতুন দল আসছে জানুয়ারিতে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.004180908203125