দৈনিক শিক্ষাডটকম, চট্টগ্রাম : সাউদার্ন ইউনিভার্সিটির সাবেক কোষাধ্যক্ষ সরওয়ার জাহানের বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকার অনিয়ম ও দুর্নীতির তদন্ত করার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনে চিঠি দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির রেজিস্ট্রার নুর আহমদ। এর জের ধরে গত ছয় মাস ধরে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে অচলাবস্থা বিরাজ করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংক লেনদেন বন্ধ রাখার জন্য ৬ ব্যাংকে চিঠি দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান। ব্যাংক লেনদেন বন্ধ থাকায় ট্রেজারার ড. শরীফ আশরাফ উজ্জামানও বাংলাদেশ ব্যাংকে একটি অভিযোগ দায়ের করেছেন।
গত বছরের ২৫ জুন দুর্নীতি দমন কমিশন ও বাংলাদেশ ব্যাংকে দেয়া লিখিত অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড বায়জিদ লিংক রোড সংলগ্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক কোষাধ্যক্ষ সরওয়ার জাহান তার পদে থাকাকালীন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিষয়ে বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যানকে ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেন। এতে করে ওই প্রতিষ্ঠানের বর্তমান অচল অবস্থা তৈরি হয়। কারণ বোর্ড অব ট্রাস্টিজের অনুমোদন ছাড়াই ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যানের একক সিদ্ধান্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের লেনদেনকৃত সকল ব্যাংকগুলোকে লেনদেন না করার জন্য লিখিত চিঠি দিয়ে নিষেধ করেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর বরাবরে অভিযোগ দায়ের করেন সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার ড. শরীফ আশরাফ উজ্জামান। ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন বন্ধ থাকার কারণে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মাসিক বেতন না পাওয়ার ফলে তারা আর্থিক সংকটে আছে। এমনকি স্বল্প বেতনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা দৈনিন্দন জীবন যাপন করতে হিমশিম খাচ্ছেন। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমি ও প্রশাসনিক কাজের বিপরীতে প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় ব্যয়, যেমন শিক্ষার্থীদের পরিবহন ব্যয়, জেনারেটর, পানি, বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ ও আনুসঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা অর্থের অভাবে প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না।
ট্রেজারার আরও অভিযোগ করেন, বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন করতে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও ট্রেজারার কর্তৃক (ট্রেজারার বাধ্যতামূলক এবং উপাচার্য বা উপ-উপাচার্য) পরিচালিত হয়ে থাকে।
এ ব্যাপারে অন্য কোনো ব্যক্তি বা পক্ষ দ্বারা উক্ত ব্যাংকের কার্যক্রম স্থগিত রাখা বেআইনি। এ সুযোগে বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্য এবং তৎকালীন সাবেক কোষাধ্যক্ষ সরওয়ার জাহান এককভাবে কোটি কোটি টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেন। এতে সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হওয়ার উপক্রম।
এদিকে বিভিন্ন দপ্তরে দেয়া অভিযোগে দেখা যায়, সরওয়ার জাহান সম্পূর্ণ অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটি কোটি আত্মসাৎ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ভবিষ্যৎ তহবিলের মোট ২ কোটি ৯৬ লাখ ৩৫ হাজার টাকা, বিদেশি নাগরিক মি. মির্ক বার্থোলোমিও এবং আরও ২ জন সহযোগীসহ মোট ৩ জনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল থেকে বেআইনিভাবে ২৮ লাখ ১১ হাজার টাকা বেতন হিসাবে প্রদান, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া মো. ইলিয়াছ নামে এক ব্যক্তিকে বেআইনিভাবে ৭৫ লাখ টাকার মধ্যে ২৮ লাখ টাকা পরিশোধ, দখিনা প্রকাশনী ও আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় স্পোর্টস ইত্যাদি অত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও কর্মচারীর নামে ৫০ লাখ ৮ হাজার টাকা প্রদান, ক্যাম্পাসে সরওয়ার জাহান নিজ নামে এজেন্ট ব্যাংকিং চালু করে বিশ্ববিদ্যালয় তহবিল থেকে উক্ত এজেন্ট ব্যাংকের কর্মকর্তাকে ৮৯ হাজার টাকা পরিশোধ। এছাড়া তিনি সিএলআই নামে একটি ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করেন। কিন্তু ওই প্রতিষ্ঠানের অর্জিত অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে জমা না দিয়ে বরং ইহার সকল ব্যয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল থেকে ২৮ লাখ ১১ হাজার টাকা নির্বাহ করে, চট্টগ্রাম শহরের মেহেদীবাগস্থ পুরাতন ক্যাম্পাসের ভাড়াকৃত ভবন ছেড়ে দেয়ার পরও উক্ত ভবনের সংস্থাপিত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ও আসবারপত্রসহ প্রায় দেড় কোটি টাকার মালামাল আটকে রাখে। ফলে ওই ভবনের বর্তমান ভাড়াটিয়াদের ব্যবহার করার সুযোগ দিয়ে সরওয়ার জাহান আর্থিক সুবিধা ভোগ করেন। বায়েজিত রোডস্থ আরেফিন নগরের জালালাবাদ মৌজায় ৬৭ শতাংশ জায়গা বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল থেকে ক্রয় করেন। কিন্তু তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে না নিয়ে সরওয়ার জাহান নিজ নামে এবং তার মালিকাধীন প্রতিষ্ঠান সাউদার্ন পলিট্যাকনিক্যাল এর নামে রেজিস্ট্রি করেন। তাছাড়া সরওয়ার জাহান বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়াই নিজের স্ত্রী ড. ইসরাত জাহানকে তার সহকারী অধ্যাপক ও সহযোগী পদের নিয়োগপত্রে নিজে স্বাক্ষর করেন। তার স্ত্রী ড. ইসরাত জাহানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ ওঠে।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন ভাতা উত্তোলনের জন্য বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট স্থগিতের প্রতিবাদে কোষাধ্যক্ষ ড. শরীফ আশরাফ উজ্জামান চিঠি দেন। এমনকি তিনি আগামীতে বেতন ভাতা উত্তোলনে ছাড় না দিলে উল্লিখিত ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিবেন বলে তাদেরকে জানান।
সরওয়ার জাহান ও তার স্ত্রী ইসরাত জাহানের বিরুদ্ধে রেজিস্ট্রার, ট্রেজারার বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অভিযোগ করে। এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে দুদক ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিষয়টি তদন্ত করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে চিঠি দেয়। তাদের চিঠি পেয়ে মঞ্জুরি কমিশন ৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দেয়। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ারম্যানের কাছে বাংলাদেশ মঞ্জুরি কমিশনের পরিচালক মো. ওমর ফারুক গত ১২ নভেম্বর একটি চিঠি প্রেরণ করে। চিঠিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন ভাতা এবং যাবতীয় খরচ বহনের জন্য ব্যাংক লেনদেন সচল রাখতে নির্দেশ দেয়া হয়। দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগকারী রেজিষ্ট্রার নুর আহমদ জানান, আমি যথাযথ কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী আমি অভিযোগ দায়ের করেছি।
অপরদিকে বাংলাদেশ মঞ্জুরি কমিশনের গঠিত তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক প্রফেসর মোহাম্মদ শামসুল আলমের কাছে তদন্তের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তদন্ত এখনো চলছে। তদন্ত শেষ হলে তা অবশ্যই সংশ্লিষ্ট সকলকে জানানো হবে।
এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য প্রফেসর ইঞ্জিনিয়ার মো. মোজাম্মেল হক বলেন, আগে সিন্ডিকেট সভার মাধ্যমে যে দুর্নীতি ও অনিয়মের সত্যতা পাওয়া গেছে তার জন্য সারওয়ার জাহানকে টাকা ফেরত দিতে বলার পরও উনি টাকা ফেরত দেননি। তাই ওনার বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্টরা বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দায়ের করেন। এখানে অনিয়ম ও দুর্নীতিগুলো তদন্ত করে যে সত্যতা পাওয়া যাবে, সেগুলোর ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া দরকার। তাছাড়া ভবিষ্যতে যদি প্রতিষ্ঠানকে এ ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতিমুক্ত রাখা যায় তখনি বিশ্ববিদ্যালয় স্বাভাবিক গতিতে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে পাবে। অভিযুক্ত সরওয়ার জাহানের মোবাইলে বারবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ না করায় বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।