সাধারণ ছাত্রদের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে

স্বদেশ রায় |

কোটাবিরোধী আন্দোলনে যে নানান ছদ্মাবরণে শিবির ও ছাত্রদল কাজ করেছে, সে বিষয়টি এখন পরিষ্কার। কোটাবিরোধী আন্দোলনের একজন মূল নেতা যে শিবির করে তা তার ফেসবুকে দেয়া স্ট্যাটাসগুলো প্রমাণ করে দেয়। যে তার ফেসবুকে স্টিফেন হকিংকে ‘শালা নাস্তিক’ বলে গালি দেয়, ইসলামী ছাত্রী সমাজের দেয়া পোস্ট শেয়ার করে- সে যে শিবির কর্মী, তা নিয়ে কারও কোন সন্দেহ থাকার কোন সুযোগ নেই। তা ছাড়া বুধবারের আন্দোলনের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি যখন কোটা বিষয়ক দাবি সরকারকে মেনে নিতে অনুরোধ করে, সে সময়ে আন্দোলনকারী এই নেতার প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়েছিল একটি টেলিভিশন। সে তখন ভিসিকে স্বাগত জানিয়ে বলে আমরা আরও যে আন্দোলন করব সেগুলোকে সমর্থন করতে হবে। কোটাবিরোধী আন্দোলনের বাইরে তারা আর কী কী আন্দোলন করতে চায় বা তাদের প্রস্তুতি আছে, সেগুলো এখন সরকারকে ভালভাবে খোঁজ নিতে হবে।

যা হোক, যারা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে তাদের সম্পর্কে সরকার এখন খোঁজখবর নিচ্ছে। এগুলো আরও ভাল করে নেয়া উচিত। এখন অনেকে বলছে তাদের বাবা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আমরা টকশোতে দেখেছি, জামায়াত-বিএনপির পক্ষের বুদ্ধিজীবী কেউ কেউ নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দাবি করেন। যখন তার প্রতিপক্ষ বলেন, আপনার কমান্ডারের নাম কি ছিল? তখন তিনি কমান্ডারের নাম বলতে পারেন না। এমনকি রাগে অনুষ্ঠান ছেড়ে উঠে যান। তাই বাস্তবে আন্দোলনকারী যে সব নেতা দাবি করছে তাদের বাবা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, সেটার সত্য-মিথ্যা এখন সরকারের বিভিন্ন সংস্থার খোঁজ নিতে হবে। কারণ, যে ছেলে ইসলামী ছাত্রী সংস্থার পোস্ট শেয়ার করে, স্টিফেন হকিংকে শালা বলে গালি দেয়, তার সঙ্গে আর যাই হোক কোন মুক্তিযোদ্ধার ছেলে মিলে আন্দোলন করতে পারে না।

এছাড়াও তারেক রহমান যে এই আন্দোলনের জন্য তার দলকে নিয়োজিত করেছিল তাদের উদ্দেশ্য কী ছিল, কোথা থেকে আন্দোলনের অর্থ এলো- এ সবের খোঁজে এখন সরকার নেমেছে। আশা করা যায় খুব শীঘ্রই বিষয়টি জাতির কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে- কারা এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল এবং কারা এর পেছনের ইন্ধনদাতা, অর্থ জোগানদাতা ছিল, সেগুলো খুব ভালভাবে খোঁজ নিতে হবে। কারণ, এই আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে কেবল বেকায়দায় ফেলা হয়নি, এই আন্দোলনের নেতাদের আচরণ ও আন্দোলনের পেছনের উদ্দেশ্য যতটুকু পরিষ্কার হচ্ছে তা থেকে বোঝা যাচ্ছে, আন্দোলনের নেতাদের মূল উদ্দেশ্য কোটার বিরোধিতা ছিল না। তা যদি থাকত তাহলে তারা কোটা নিয়ে যথেষ্ট পড়াশোনা করত।

এই কোটা সিস্টেমের মতো একটি জটিল বিষয় সমাধানের জন্য মাত্র সাতদিন সময় সরকারকে বেঁধে দিত না। দুই, তারা প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক কোন প্রতিক্রিয়া বা সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। তিন. স্বাধীনতার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে সব থেকে বড় সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে ভিসির ওপর হামলা ও ভিসির বাসায় নারকীয় তা-ব শুধু নয়, লুট এবং অগ্নিসংযোগও ঘটেছে। প্রত্যক্ষদর্শীর কাছে যা শুনেছি ওই রাতে কয়েক সাংবাদিক ভিসিকে আগলে না থাকলে ভিসি বাঁচতেন কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তারা লোহার রডের মতো বস্তু, কারও কারও মতে গাড়ির চাকা খোলার হ্যান্ডেল যুক্ত ড্রাইভার দিয়ে বার বার ভিসিকে আঘাত করার চেষ্টা করে। যার মূল উদ্দেশ্য ছিল ভিসিকে হত্যা করা। এত বড় একটি সন্ত্রাসী ঘটনার পরে আন্দোলনকারীরা যদি শিবির ও ছাত্রদলের ইন্ধনে কাজ না করে, তাহলে কী ভাবে তারা এই ঘটনার তদন্ত না চেয়ে, বিচার না চেয়ে মামলা তুলে নিতে বলে! আবার তার জন্য দুইদিন সময়ও বেঁধে দেয়। এতে কি তাদের চরিত্র উম্মোচিত হয় না যে, তারা আসলে সন্ত্রাসের পক্ষে।

এই কলামে গত সপ্তাহে লিখেছি, এখন আরও বিষয়টি পরিষ্কার যে, আন্দোলনকারীদের মধ্যে ছাত্রলীগ ও বাম সংগঠনগুলোর ভেতর ঢুকে পড়া শিবির ও বিএনপি মূলত এই আন্দোলনের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লাশ ফেলতে চেয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লাশ ফেলে তারা কোটাবিরোধী আন্দোলনকে সরকারবিরোধী আন্দোলন ও খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলনের রূপান্তরিত করতে চেয়েছিল। তাদের সমর্থক প্রথম আলো, নয়া দিগন্ত, সংগ্রাম, দিনকাল প্রভৃতি পত্রিকার উস্কানিমূলক লেখা থেকেও তা স্পষ্ট। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের পোষ্য কোটা বিরোধিতার ভেতর দিয়ে তারা রাজাকার-আলবদরদের একটা উত্থান চেয়েছিল (কিছুটা অবশ্য ঘটেছে)। কারণ, তারা জানে রাজাকারী চেতনার উত্থান ছাড়া, নির্বাচনে মানুষকে প্রতারণা করা ছাড়া তাদের ভোট নেয়ার অন্য কোন পথ নেই। কারণ, এই শক্তি যে দেশের উন্নয়ন করতে পারে না, তা ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়ে গেছে। যে কারণে ২০১৩তে তারা হেফাজতের মাধ্যমে দেশে রাজাকারী চেতনার উত্থান ঘটিয়েছিল। তার ফলও তারা ২০১৩তে পাঁচ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে পেয়েছিল। এবারও তারা সেই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে সামনে রেখে এ কাজে নেমেছিল। আর সঙ্গে ছিল খালেদাকে জেল থেকে মুক্ত করার নামে একটা অরাজকতা ঘটানো। অরাজকতা বলছি এ কারণে যে, বিএনপি নেতারাও ভালভাবে জানে খালেদা দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত। তাকে মুক্তি দেয়ার ক্ষমতা সরকারের নেই। দুর্নীতিবাজ হিসেবে দেশের প্রচলিত আইনে খালেদা জেল খাটছে। বিএনপি চাচ্ছে, খালেদাকে ক্যাশ করে দেশে কোন না কোন ধরনের অরাজকতা ঘটাতে। তারা দেখেছে, কোন আন্দোলন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক হলে তাতে সরকার বেশ বড় ধরনের ধাক্কা খায়।

জামায়াত-শিবির ও বিএনপির এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার জন্য সাধারণ ছাত্রের ব্যানারে ওই আন্দোলনকারী নেতারা তাই মূলত চেয়েছিল সাধারণ ছাত্রদের সঙ্গে প্রতারণা করে একটি আন্দোলন ঘটাতে। যে কারণে প্রতিটি বিসিএস-এ ৭০ ভাগ থেকে ৭৭ ভাগ অবধি মেধা কোটায় চাকরি পেলেও তারা সেখানে প্রচার করেছে ৫৬ ভাগ চাকরি হয় কোটার মাধ্যমে। এমনভাবে প্রচার করেছে যে, বাদবাকি যারা কোটা থেকে আসে তারা যেন এমনি এমনিই চাকরি পেয়ে যায়। তাদের যে বিসিএস প্রিলিমিনারি, ফাইনাল, ভাইভা সব স্তর পার হয়ে আসতে হয়, এটা তারা সাধারণ ছাত্রদের জানতে দেয়নি। অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক আন্দোলনটি করেছে পুরোপুরি ফেসবুকনির্ভর গুজবের ওপর ভর করে। অর্থাৎ তাদের আন্দোলনের সবটুকুই ছিল সাধারণ ছাত্রদের সঙ্গে প্রতারণা করা।

কারণ, আগেও এ কলামে লিখেছি, এখনও উল্লেখ করছি জেলাকোটা উঠে গেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ব্র্যাক এবং নর্থ সাউথ ছাড়া অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের চাকরি পাওয়া কষ্টের। বাস্তবে দেখা যাবে যাদের ও লেভেল, এ লেভেল করা আছে ও ঢাকার নামকরা কয়েকটি স্কুলে যারা পড়াশোনা করেছে, তাদের ভেতরই সব ক্যাডারের চাকরি ভাগ বাটোয়ারা হয়ে যাবে। সাতক্ষীরা, কলারোয়া, নেত্রকোনা, গাইবান্দা প্রভৃতি স্থানে যারা গ্রামের স্কুলে পড়াশোনা করেছে, তাদের চাকরি পাবার কোন সুযোগ থাকবে না। আর সাধারণ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কেমন পড়াশোনা হয়, তার বাস্তব অভিজ্ঞতা যাদের আছে তারা জানেন। তাই তাদের জন্যও সুযোগ থাকবে না। তাদের একমাত্র ভরসা ছিল জেলাকোটা। অথচ তাদেরকে রাজপথে নামিয়ে এরা বলে মাত্র ১০ ভাগ কোটা রাখতে হবে। জেলা কোটায় তা হলে একজন বা দুজন চাকরি পাবে সারাদেশে?

তাই মূলত জামায়াত-শিবিরের নেতৃত্বে ও তারেকের ইন্ধনে যে আন্দোলনটি মূলত হয়েছে, তার মাধ্যমে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। দেশের সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের এভাবে প্রতারণার শিকার হতে দেয়া যায় না কোনক্রমেই। তাদেরকে এখন বোঝাতে হবে। এ ক্ষেত্রে গত কয়েকদিনে দেখেছি, জনাব এইচটি ইমাম, ও ড. সাদৎ হোসাইন খুব পরিষ্কার করে বলেছেন। আশা করব, সরকার বা বিভিন্ন মিডিয়া এই দুই ব্যক্তিত্ব ছাড়াও যারা এগুলো সাধারণ ছাত্রদের বোঝাতে সক্ষম, তাদের মাধ্যমে এগুলো বোঝানোর চেষ্টা করতে হবে। সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা আমাদের সন্তান। নিজের সন্তানকে কখনও আমরা অর্থাৎ দেশের সাধারণ মানুষ সাপের বিষে নিক্ষেপ করতে পারি না। আমাদের সন্তানরা শিবিরের নেতৃত্বে পরিচালিত হওয়া মানেই সাপের বিষে নিক্ষেপিত হওয়া। তারেক রহমান অনেক আগেই বলেছে, শিবির ও ছাত্রদল একই মায়ের সন্তান। এক সময়ে শিবির পেটানোর জন্য ছাত্রদলের অনেক সদস্যকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাশে পাওয়া গেছে। এখন খালেদা ও তারেক তাদেরকে সাপের বিষের পাত্রে নিক্ষেপ করেছে। তা বলে দেশের সাধারণ ছাত্র সমাজকে তো আর ওই শিবিরের নেতৃত্বে ঠেলে দেয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে মিডিয়ার একটি অংশ অর্থাৎ প্রথম আলো, সংগ্রাম মার্কা অংশটি সব সময়ই চাইবে ওরা শিবিরের নেতৃত্বে থাকুক।

কিন্তু মিডিয়ার বাদ বাকি অংশ, সরকার ও দেশের বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্ব পালন করতে হবে যাতে সাধারণ ছাত্ররা প্রতারিত না হয়। তারা যেন ভবিষ্যতে চাকরি থেকে বঞ্চিত না হয়। তারা যেন একটি নষ্ট রাজনীতির দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত না হয়। সাধারণ ছাত্ররাও শিক্ষিত। তাদেরকে এখন শান্ত মাথায় তাদের ভবিষ্যত ভাবতে হবে। অন্যদিকে এই আন্দোলনের নেতাদের প্রকৃত পরিচয়, তাদের বংশধরদের ’৭১ এর অবস্থান- সব কিছু খোঁজ নিয়ে দেশবাসীকে জানানোর দায়িত্ব সরকারের ও মিডিয়ার। কারণ, যে ঘটনার ভেতর দিয়ে প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলেমেয়েদের প্রশাসনের শীর্ষে উঠে আসা বন্ধ হয়ে যাবে, তা বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী। আমাদের স্বাধীনতার অর্থই হলো সাধারণ মানুষের মুক্তি। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ও এই রাজকাররা স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল। এখন তাদের সন্তানরা দেশটি যাতে উন্নত না হয়, উন্নয়নে যাতে সাম্য না আসে, সে চেষ্টাই করছে। এদের রুখে দাঁড়ানো এখন সকলের দায়িত্ব।


সৌজন্যে: জনকণ্ঠ


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
কাল থেকে শিক্ষা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চলবে সব প্রাথমিক বিদ্যালয় - dainik shiksha কাল থেকে শিক্ষা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চলবে সব প্রাথমিক বিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান বাড়ানোর নির্দেশ রাষ্ট্রপতির - dainik shiksha বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান বাড়ানোর নির্দেশ রাষ্ট্রপতির ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দাবিতে দেশজুড়ে সংহতি সমাবেশ - dainik shiksha ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দাবিতে দেশজুড়ে সংহতি সমাবেশ সব মাদরাসার ওয়েবসাইট ও তথ্য হালনাগাদের নির্দেশ - dainik shiksha সব মাদরাসার ওয়েবসাইট ও তথ্য হালনাগাদের নির্দেশ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক : দুই মন্ত্রণালয় যা করবে - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক : দুই মন্ত্রণালয় যা করবে নার্সিং-মিডওয়াইফারি ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ - dainik shiksha নার্সিং-মিডওয়াইফারি ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় সিনিয়র আইনজীবীরা বিচার বিভাগের স্বার্থে কথা বলবেন, আশা প্রধান বিচারপতির - dainik shiksha সিনিয়র আইনজীবীরা বিচার বিভাগের স্বার্থে কথা বলবেন, আশা প্রধান বিচারপতির দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0041627883911133