সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়ার ১৮তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ শুক্রবার। হত্যাকাণ্ডের দেড় যুগ পেরোলেও বিচারের আশায় এখনো আদালতের দিকে তাকিয়ে তার পরিবার। হত্যাকাণ্ডের সাড়ে ৯ বছর পর সম্পূরক চার্জশিট দাখিলের মাধ্যমে বিচার শুরু হলেও আজ পর্যন্ত তা আটকে রয়েছে সাক্ষ্য গ্রহণে। ফলে বিচার নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন এ নেতার স্বজনরা। তাদের অভিযোগ, দেশের সবকিছুর বিচার হলেও কিবরিয়া হত্যাসহ ৫ হত্যাকাণ্ডের বিচার হচ্ছে না।
২০০৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জ সদরের বৈদ্যের বাজারে ঈদ-পরবর্তী জনসভা থেকে ফেরার পথে গ্রেনেড হামলায় নিহত হন তৎকালীন হবিগঞ্জ-৩ আসনের এমপি ও সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া, তার ভাতিজা শাহ মনজুরুল হুদা, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রহিম, আবুল হোসেন ও সিদ্দিক আলী। আহত হন শতাধিক নেতাকর্মী।
ঘটনার রাতেই হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা করেন জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল মজিদ খান। মামলার তদন্তে কাজ করে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা। ওই বছরের ২০ মার্চ সিআইডির তৎকালীন সহকারী পুলিশ সুপার মুন্সি আতিকুর রহমান মামলাটি তদন্ত করে ১০ জনের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগপত্র দাখিল করেন। তবে ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দের ৩ মে সিলেট দ্রুত বিচার আদালতে নারাজি আবেদন করেন অ্যাডভোকেট আবদুল মজিদ খান। আদালত তার আবেদন খারিজ করলে ১৪ মে তিনি হাইকোর্টে আপিল করেন। আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ
সরকারের প্রতি ‘কেন অধিকতর তদন্ত করা যাবে না’ মর্মে রুল জারি করেন। রুলের বিরুদ্ধে ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ মে লিভ টু আপিল করে সরকার। আপিল বিভাগ তা খারিজ করেন।
এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নিলে মামলার অধিকতর তদন্ত শুরু হয়। দায়িত্ব পড়ে সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলামের। দীর্ঘ তদন্ত শেষে তিনি ২০১১ খ্রিষ্টাব্দের ২০ জুন আরও ১৪ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এ সময় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, মুফতি হান্নানসহ ২৪ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছিল।
পরে ২০১১ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ জুন কিবরিয়ার স্ত্রী আসমা কিবরিয়া চার্জশিটের ওপর হবিগঞ্জ জুডিশিয়াল আদালতে নারাজি আবেদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে মামলার মূল নথি সিলেট দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে থাকায় বিচারক রাজীব কুমার বিশ্বাস উপনথির মাধ্যমে আবেদনটি সিলেটে পাঠানোর নির্দেশ দেন। ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ৫ জানুয়ারি নারাজি আবেদন গ্রহণ করেন সিলেটের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক দিলীপ কুমার বণিক। তিনি সিনিয়র পুলিশ অফিসারের মাধ্যমে মামলার অধিকতর তদন্তের জন্য নির্দেশ দেন।
এরপর সিআইডির এএসপি মেহেরুন নেছা দীর্ঘ তদন্ত শেষে ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ নভেম্বর হবিগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রোকেয়া আক্তারের আদালতে মামলার তৃতীয় সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এতে নতুন ১১ জনকে অন্তর্ভুক্ত করে ৩৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। অন্তর্ভুক্ত আসামিরা হলেন–সিলেট সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, হবিগঞ্জ জেলা বিএনপির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক সাবেক মেয়র জি কে গউছ, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরী, মুফতি আব্দুল হাই, মুফতি তাজ উদ্দিন, মুফতি সফিকুর রহমান, মোহাম্মদ আলী, বদরুল, মহিবুর রহমান, কাজল আহমেদ ও হাফেজ ইয়াহিয়া।
২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের জুনে মামলাটি সিলেট দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে হস্তান্তর করা হয়। সেখানে বিচার শুরু হয়। মোট আসামি ৩২ জনের মধ্যে অন্য মামলায় ৩ আসামির ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। সম্প্রতি হারিছ চৌধুরী ঢাকায় মারা গেছেন। আর ২৮ আসামি জীবিত রয়েছেন। এর মধ্যে জামিনে আছে ১২ জন। পলাতক ৬ ও হাজতে ১০ জন। বর্তমানে সিলেটে মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। এ পর্যন্ত ৪২ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ হয়েছে।
কিবরিয়ার ছেলে ড. রেজা কিবরিয়া জানান, দুই বছর বিএনপি, দুই বছর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও আওয়ামী লীগ ১৪ বছরে সুষ্ঠু তদন্ত করতে পারেনি। করতে চায়নি। গ্রেনেডের উৎস কোথায় ও আসল মদদাতারা কারা–বিষয়গুলো স্পষ্ট করতে পারেননি তদন্ত কর্মকর্তারা।
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ও আমার পরিবারকে অপেক্ষা করতে হবে। আমরা অপেক্ষা করছি। আমার মতো অনেকে আছে তারা রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। আমার বাবার হত্যাকাণ্ডের পর কারা কারা সুবিধা পেয়েছে সবাই জানে; কিন্তু একদিন তাদের বিচার হবেই।’
হামলায় নিহত আব্দুর রহিমের স্ত্রী আছিয়া খাতুন বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডের ১৮ বছর হলেও বিচারের মুখ দেখলাম না। জানি না আমার স্বামীর বিচার দেখতে পারব কিনা। আমরা বেঁচে থাকতে স্বামী হত্যাকাণ্ডের বিচার দেখতে চাই।’
মামলার বাদী হবিগঞ্জ-২ আসনের এমপি আব্দুল মজিদ খান বলেন, ‘বিভিন্ন কারণে মামলা দীর্ঘ হয়েছে। আমি আশাবাদী, বর্তমান সরকারের আমলেই এই চাঞ্চল্যকর মামলার বিচার হবে এবং প্রকৃত দোষীরা শাস্তি পাবে।’