সাবেক ভিসির অনৈতিকসঙ্গী আবু হানিফা বহাল তবিয়তে

এনামুল হক প্রিন্স |

ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপরেজিস্ট্রার পদে অবৈধভাবে নিয়োগ পেয়েছিলেন সাবেক ভিসির ‘অনৈতিক সম্পর্কের সঙ্গী’ আবু হানিফা। বিভিন্ন অভিযোগ তদন্ত শেষে ‘বলাৎকারকারী’ হিসেবে সুপরিচিত সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. আহসান উল্লাহর মাধ্যমে অবৈধভাবে নিয়োগ পাওয়া এ কর্মকর্তাকে অপসারণের সুপারিশ করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) একজন সদস্য। গত জুন মাসে সে সুপারিশ বাস্তবায়ন তথা আবু হানিফাকে অপসারণের ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে, সে নির্দেশনার দুই মাস পরও সাবেক এ ‘শিবির ক্যাডার’ নিজ পদে আছেন। শুধু তাই নয়, উপরেজিস্ট্রার হয়েও নিয়মিত নিজেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের  রেজিস্ট্রার বলে পরিচয় দিচ্ছেন। দৈনিক আমাদের বার্তার অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

জানা গেছে, ভিসি অধ্যাপক ড. আহসান উল্লাহর বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন দুর্নীতি ও অনিয়মের বিষয়ে তদন্ত করতে ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে কমিটি গঠন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে ওই তদন্ত প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠান তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ও ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ কুমার চন্দ। চলতি বছরের ১৯ জুন ওই তদন্ত প্রতিবেদন ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আব্দুর রশীদকে পাঠিয়ে সুপারিশের আলোকে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ। দৈনিক আমাদের বার্তার হাতে থাকা ওই তদন্ত প্রতিবেদনে উপরেজিস্ট্রার আবু হানিফাকে অপসারণের সুপারিশ করেছিলো কমিটি। তবে সে নির্দেশনা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আব্দুর রশীদ গতকাল মঙ্গলবার দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, আগামী ২৮ আগস্ট আমাদের সিন্ডিকেট সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা আছে। মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত ও ওই তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে সিন্ডিকেট সদস্যদের মতামত নেয়া হবে। সে মতামতের আলোকে চূড়ান্ত ব্যবস্থা নেয়া হবে। 

তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী সিন্ডিকেটে আলোচনা বা সিদ্ধান্ত ছাড়া কোনো কাজ করা যায় না। মন্ত্রণালয় থেকে তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর সিন্ডিকেটের কোনো সভাও অনুষ্ঠিত হয়নি। তাই সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত জানা সম্ভব হয়নি। আগামী ২৮ আগস্ট সিন্ডিকেট সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে।

আমাদের বার্তার অনুসন্ধানে জানা গেছে, কোনো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বা নিয়োগ পরীক্ষা ছাড়াই অবৈধভাবে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ডে ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দের ১ জুন মূল্যায়ন কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন আবু হানিফা। তখন বোর্ডের সদস্য-সচিব ছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় গণশিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক অধ্যক্ষ মো. সেলিম ভুঁইয়া। ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসেও সেলিম ভুঁইয়া একই পদে ছিলেন। আবু হানিফার চাকরি স্থায়ী হয় সে মাসেই, সেলিম ভুঁইয়ার শেষ কর্মদিবসে। আবু হানিফা পদোন্নতি পেয়ে বোর্ডের সহকারী পরিচালক হন ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের আগস্টে। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারিতে ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপরেজিস্ট্রার পদে প্রেষণে চাকরি বাগান আবু হানিফা। আর ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে হানিফার অবসর বোর্ডের মূল্যায়ন কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগটি অবৈধ বলা হয়। তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রধান ছিলেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের তৎকালীণ অতিরিক্ত সচিব এ কে এম জাকির হোসেন ভূঁঞা। অবসর সুবিধা বোর্ডের চাকরি আলোকে প্রেষণে কর্মরত থেকেই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপরেজিস্ট্রার পদে নিয়োগ পান। আবু হানিফার বিরুদ্ধে জালিয়াতি বা চুরি করে পিএইচডি বা ডক্টরেট ডিগ্রি বাগানোর অভিযোগও আছে।

ইউজিসি সদস্য ও তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক বিশ্বজিৎ কুমার চন্দ ওই প্রতিবেদনে বলেছেন, প্রেষণে কর্মরত প্রার্থী হিসেবে মো. আবু হানিফা উপরেজিস্ট্রারের স্থায়ী পদে আবেদন যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে করেননি। তার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে প্রার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বা সমপর্যায়ের পদে ৫ বছরের অভিজ্ঞতাসহ প্রথম শ্রেণির পদে মোট ১০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকার শর্ত রয়েছে। কিন্তু আবু হানিফার বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কাজ করার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তাছাড়া যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আবেদনের কোনো কাগজপত্র এবং পূর্বের প্রতিষ্ঠানের ছাড়পত্র পাওয়া যায়নি, তাই তার আগের প্রতিষ্ঠানের চাকরিকাল গণনার কোনো সুযোগ নেই। সিন্ডিকেটের অনুমোদন না নিয়ে তৎকালীন উপাচার্য উপ-রেজিস্ট্রার পদের তফসিল তথা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত প্রার্থীদের ক্ষেত্রে শর্ত শিথিলের তফসিল নিজেই অনুমোদন করেছেন। যা তিনি আইনগতভাবে করতে পারেন না। তাই আবু হানিফার ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হবে না। তদন্ত কমিটির কাছে প্রতীয়মান হয়, তার নিয়োগটি যথাযথভাবে হয়নি। আবু হানিফার নিয়োগের নিয়োগ নির্বাচনী বোর্ডের সুপারিশমালা বা কার্যবিবরণীর মূল কপি বার বার চাওয়া হলেও উপাচার্য ড. আহসান উল্লাহ তা উপস্থাপন করেনি। সুপারিশমালার ফটোকপি দেয়া হয়েছে যা টেম্পারিং করা বলে কমিটির কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১৩ এর ধারা ২২(২)(ঞ) অনুযায়ী কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ, তাদের দায়িত্ব ও চাকরির শর্তাবলী নির্ধারণ করা সিন্ডিকেটের দায়িত্ব। কিন্তু উপাচার্য এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে চাকরির শর্তাবলীর বিষয়ে সিন্ডিকেটের পূর্বানুমোদন না নিয়ে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জারি করেছেন। এক্ষেত্রে আইনের ব্যত্যয় ঘটেছে বলে কমিটি মনে করে।

এদিকে ভিসির বিরুদ্ধে ওঠা বলাৎকারের অভিযোগ নিয়ে তথ্য সংগ্রহের সময় আবু হানিফার সঙ্গে সাবেক ভিসির অনৈতিক সম্পর্কের তথ্য পেয়েছে তদন্ত কমিটি। জানা গেছে, ধানমণ্ডিতে থাকা মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের কোয়ার্টারে থাকতেন ভিসি অধ্যাপক ড. আহসান উল্লাহ। সে বাড়িতেই থাকতেন বোর্ডের তৎকালীন চেয়ারম্যান এ কে এম সায়েফ উল্লাহ। তদন্ত প্রতিবেদনে এ কে এম ছায়েফ উল্যাহর বরাতে বলা হয়েছে, ‘ওই বাসায়ও অনৈতিক কর্মকান্ড হয়েছে। বেশ কয়েকজন কর্মচারীর সঙ্গে সাবেক ভিসি আহসান উল্লাহর অবৈধ শারীরিক সম্পর্ক ছিলো। এ অনৈতিক সম্পর্কের ফলশ্রুতিতে ভিসিকে ব্ল্যাকমেইল করে অনেকে চাকরি নেন। অপর এক কর্মকর্তা ও আবু হানিফার নিয়োগ হয় প্রথমে এবং তিনি ভিসির সব অনৈতিক সম্পর্কের সঙ্গী’। তবে সাবেক ভিসি ড. আহসান উল্লাহ ওই কমিটির কাছে বলাৎকার ও বিভিন্ন অনৈতিক সম্পর্কের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। এসব তথ্য তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন কমিটির আহ্বায়ক।  

প্রতিবেদনের তদন্ত কমিটি বলেছে, ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবু হানিফাকে উপরেজিস্ট্রার পদে নিয়োগে আইনের ব্যত্যয় ঘটেছে, বিধায় তার নিয়োগের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ। ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ নির্বাচনী বোর্ডের সুপারিশ বা কার্যবিবরণীর মূলকপি না থাকা এবং নিয়োগ নির্বাচনী বোর্ডের সুপারিশ বা কার্যবিবরণীর যে ফটোকপি দেয়া হয়েছে তা টেম্পারিং করা বলে কমিটির কাছে প্রতীয়মান হয়। আবু হানিফা ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন মেয়াদে কয়েক দফায় ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া সাবেক রেজিস্ট্রার রোশন খানের সাক্ষ্যমতে ভিসি প্রফেসর ড. আহসান উল্লাহ আবু হানিফার কাছে সব গোপনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ অফিসিয়াল কাগজপত্র সংরক্ষণ করতেন। তাই টেম্পারিংয়ের দায় আবু হানিফার ওপরও বর্তায়। এক্ষেত্রে বেআইনিভাবে নিয়োগ পাওয়া অসৎ একজন ব্যক্তিকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবিলম্বে অপসারণের সুপারিশ করা হলো।

এসব বিষয়ে মন্তব্য জানতে গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে একাধিকবার উপরেজিস্ট্রার মো. আবু হানিফার সঙ্গে তার দপ্তরিক মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করে দৈনিক আমাদের বার্তা। কিন্তু তার মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। তবে তদন্ত কমিটির কাছে তিনি দাবি করেছেন, তার নিয়োগ সব নিয়ম মেনেই হয়েছে।

 

শিক্ষার সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক শিক্ষার চ্যানেলের সাথেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে সয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।

দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল  SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
পুরনো পদ্ধতিতে ফিরছে বৃত্তি পরীক্ষা - dainik shiksha পুরনো পদ্ধতিতে ফিরছে বৃত্তি পরীক্ষা শিক্ষায় কী হলো তিন মাসে - dainik shiksha শিক্ষায় কী হলো তিন মাসে মাদরাসায় চলে যায় প্রাথমিকের ২৬ দশমিক ৫৭ শতাংশ শিক্ষার্থী - dainik shiksha মাদরাসায় চলে যায় প্রাথমিকের ২৬ দশমিক ৫৭ শতাংশ শিক্ষার্থী কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক অবশেষে কপাল খুললো পঞ্চম গণবিজ্ঞপ্তিতে বাদপড়াদের - dainik shiksha অবশেষে কপাল খুললো পঞ্চম গণবিজ্ঞপ্তিতে বাদপড়াদের শিক্ষক নিবন্ধন ভাইভা: ১৫তম দিনে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি - dainik shiksha শিক্ষক নিবন্ধন ভাইভা: ১৫তম দিনে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে গণঅভ্যুত্থানে আহতদের তোপের মুখে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা - dainik shiksha গণঅভ্যুত্থানে আহতদের তোপের মুখে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা দপ্তরসহ সাবেক শিক্ষাপ্রতিমন্ত্রীকে চালাতেন পিয়ন! - dainik shiksha দপ্তরসহ সাবেক শিক্ষাপ্রতিমন্ত্রীকে চালাতেন পিয়ন! ৬১০ ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীর শিক্ষা অধিদপ্তরে নিয়োগ চূড়ান্ত! - dainik shiksha ৬১০ ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীর শিক্ষা অধিদপ্তরে নিয়োগ চূড়ান্ত! দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0027859210968018