সামাজিক অবক্ষয় ও তরুণদের ভবিষ্যৎ

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

দেশের উন্নয়ন হচ্ছে—এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু দেশের অনেক তরুণ সামাজিক অবক্ষয়জনিত কারণে ক্রমেই ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে এ বিষয়ে যথেষ্ট আন্তরিকতা থাকলেও কিছুতেই এই প্রবণতা রোধ করা যাচ্ছে না। দুর্নীতি, মাদক ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি অব্যাহত রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু অন্যায়-অপকর্ম মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। কোনোভাবেই সেগুলো প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। সম্প্রতি রাজধানী ঢাকার অভিজাত ১৩টি ক্লাবসহ সারা দেশে টাকার বিনিময়ে জুয়া খেলা বন্ধের নির্দেশ দিয়ে রায় ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। এটি একটি শুভ উদ্যোগ হলেও এই রায় যথাযথভাবে কার্যকর হবে কি না সেটি নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। কারণ এর আগে আদালতের অনেক ইতিবাচক রায় এবং নির্দেশ যথাযথভাবে অনুসরণ করতে দেখা যায়নি। সমাজের আপামর জনসাধারণের আন্তরিক সহযোগিতা ছাড়া কোনোভাবেই এই রায় শুধু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যথাযথ তৎপরতা থাকলেও নানা ধরনের সিন্ডিকেট সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে নিজেদের মতো করে পরিচালনা করতে দেখা যায়। আর এই নেতিবাচক সিন্ডিকেট দেশের তৃণমূল পর্যায় থেকে শুরু করে রাজধানী পর্যন্ত ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। শুদ্ধি অভিযানের অংশ হিসেবে দু-একটি সিন্ডিকেট ভাঙলেও আরো অনেক সিন্ডিকেট দেশে বিদ্যমান রয়েছে। রোববার (১৬ ফেব্রুয়ারি) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, ইদানীং আমরা অনুধাবন করছি যে মাদকের ভয়ংকর নেশা দেশের তরুণসমাজের একটি বড় অংশ ধীরে ধীরে গ্রাস করতে চলেছে। শহর ছাড়িয়ে গ্রামাঞ্চলেও তরুণসমাজে ইয়াবা আসক্তি বাড়ছে। সারা দেশে যেভাবে ইয়াবা ছড়িয়ে পড়ছে, তাতে শঙ্কিত না হয়ে উপায় নেই। মাদকের বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স ঘোষণার পর পরিচালিত মাদকবিরোধী কঠোর অভিযানে কক্সবাজারসহ সারা দেশে দেড় বছরে ৪৮২ জন ইয়াবা কারবারি নিহত হয়েছে। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একটি প্রতিবেদনই বলছে, দেশে ইয়াবা আসক্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। গত ৯ ফেব্রুয়ারি কালের কণ্ঠে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, পুরনো কারবারিদের সঙ্গে নতুন সিন্ডিকেট মিলে নতুন রুটে পাচার এবং কৌশল বদলে কারবার করায় ইয়াবার প্রবেশ ঠেকানো যাচ্ছে না। উল্টো আত্মসমর্পণসহ প্রশাসনের উদ্যোগের সুযোগ নিচ্ছে ইয়াবার গডফাদাররা। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, সমাজ কি এভাবেই চলতে থাকবে, কোনো রকম প্রতিকারহীনভাবে? এই গডফাদার কারা? তাদের কি আইনের আওতায় আনা যায় না?

সারা দেশে মাদকের ভয়াবহতার পাশাপাশি আরো একটি সমস্যা সমাজকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, সেটি হলো ধর্ষণ। প্রতিনিয়ত ঘটছে ধর্ষণের মতো নির্মম ঘটনা। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনার পর পরই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও (রাবি) ধর্ষণের মতো একটি নির্মম ঘটনা ঘটেছে। রাবির ওই ঘটনাটিতে ধর্ষকগোষ্ঠী ভিডিওচিত্র ধারণ করে ছাত্রীকে এবং ছাত্রীর পরিবারকে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এরই মধ্যে রাবি ক্যাম্পাসে সাধারণ শিক্ষার্থী এবং ছাত্রলীগের ব্যানারে ওই ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে নানা প্রতিবাদ কর্মসূচি লক্ষ করেছি। আমরা প্রতিনিয়তই দেখি ঘটনা ঘটার পর প্রতিবাদ হয়। এমনকি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও যথেষ্ট তৎপর থাকে এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে। কিন্তু এসবের মূলোৎপাটন করা সম্ভব হচ্ছে না সামাজিক অবক্ষয়ের ফলে। একদিকে সমাজের সচেতন মহলসহ সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিনিয়ত তৎপর ভূমিকা লক্ষ করছি, অন্যদিকে অপরাধপ্রবণতাও বেড়ে যাচ্ছে।

সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০১৯ সালে সারা দেশে ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার হয়েছে এক হাজার ৪১৩ জন নারী। ২৫৮ জন নারী যৌন হয়রানি ও উত্ত্যক্তের শিকার হয়েছে। এসব ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছে ৪৪ পুরুষ। ফলে ইদানীং কেউ আর প্রতিবাদ করতেও সাহস পাচ্ছে না।

২০২০ সালে এসেও এমন সব অপকর্ম থেমে নেই। ১২ ফেব্রুয়ারি একটি গণমাধ্যম সূত্রে জানতে পারলাম, গত ১০ দিনে ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হয়ে ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি হয়েছে ৪০ নারী। সে ক্ষেত্রেও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মন্তব্য করেছে, মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঠেকানো না গেলে, শুধু আইনি পদক্ষেপে এ ধরনের অপরাধ ঠেকানো সম্ভব নয়।

এহেন সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে সহজে কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। অবিশ্বাসের প্রবণতাটা দিন দিন বাড়ছে। বিভিন্ন অন্যায়-অপকর্মের ফলে সর্বস্তরের মানুষ এক ধরনের শঙ্কা অনুভব করছে।

একটি দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নই একমাত্র উন্নয়ন নয়। সামাজিক মূল্যবোধ ও নীতিবোধ সৃষ্টি এবং তার উন্নয়ন ঘটানোর পরিপ্রেক্ষিতে সর্বস্তরের এবং সব ধরনের অপকর্মের প্রতিরোধ ঘটানো সম্ভব। সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের মূল্যবোধ চর্চার উদ্যোগ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্থায়ী প্রক্রিয়ায় সামাজিক অবক্ষয় প্রতিরোধ করা যেতে পারে। শুধু গণমাধ্যম ব্যবহার করে সামাজিকভাবে সচেতন করে তোলাই নয়, এ বিষয়ে আলাদাভাবে সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ গ্রহণ করার সময় এসেছে। আমি মনে করি এই মুহূর্তে সরকারের রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাত্রাকে টেকসই করে তুলতে এবং তরুণদের রক্ষা করতে সামাজিক অবক্ষয় থেকে দেশকে রক্ষা করার কাজে মনোযোগী হতে হবে। এটি রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্বও বটে। শুধু বক্তৃতা-বিবৃতি নয়, মাঠপর্যায়ে এ বিষয়ে যথেষ্ট সতর্ক ভূমিকা পালনের কোনো সহজ বিকল্প খুঁজে পাওয়া যায় না।

লেখক : ড. সুলতান মাহমুদ রানা, সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল - dainik shiksha সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0030028820037842