সাম্প্রতিক সড়ক দুর্ঘটনা এবং শিক্ষার্থীদের আন্দোলন

ড. মো. সোহেল রহমান |

যে সময়ে এই লেখা লিখছি তখন মীম ও রাজীবের মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে। এক অভূতপূর্ব আন্দোলনের অভিজ্ঞতা আমরা পেলাম এর মাধ্যমে। ছোট ছোট শিশু সেই কাজ করে দেখিয়েছে, যা করার কথা আমাদের সরকারের বেতনভোগী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। ফেসবুকসহ অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ায় যেসব ভিডিও সবাই আমরা দেখছি, তা থেকে সড়ক নিরাপত্তার ব্যাপারে যতটুকু আইন অন্তত রয়েছে তারও প্রয়োগে আমাদের প্রচণ্ড ব্যর্থতার বিষয়টি পরিষ্কার; আইনের দুর্বলতার বিষয়টি না হয় আপাতত বাদই দিলাম। দেখা যাচ্ছে যে খোদ রাজধানীতেই ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলছে নিশ্চিন্তে; উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের গাড়ি কিংবা বিভিন্ন বাহিনীর গাড়ি, এমনকি পুলিশের গাড়িও চালকরা নিশ্চিন্তে চালিয়ে যাচ্ছেন মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্স দিয়ে!

আসলে এ ঘটনাগুলো হঠাৎ করে আসা কোনো ঘটনা নয়। কোনো নিয়ম মেনে চলার সংস্কৃতিই আসলে আমাদের মধ্যে নেই। তাই ট্রাফিক সপ্তাহ এলে আমরা হয়তো সাবধানে গাড়ি বের করি। সাধারণ সময়ে আমরা নিয়ম না মেনেই গাড়ি চালিয়ে অভ্যস্ত। আর এই ‘আমরা’-এর মধ্যে ভিভিআইপি থেকে শুরু করে আপামর জনসাধারণ—সবাই অন্তর্ভুক্ত। কিংবদন্তিসম প্রয়াত সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ‘বহুব্রীহি’ নাটকের কথা মনে পড়ে যায়, যেখানে সোবহান সাহেবের প্রণীত সাপ্তাহিক সত্য দিবসের বিষয়টিকে আনিস মূল্যায়ন করেছিলেন এভাবে যে সবাই তাহলে ওই একটি দিনই সত্য বলবে আর বাকি দিনগুলোতে মিথ্যাচারই চলবে; আমাদের অবস্থা আসলে সে রকমই!

কিছুদিন আগের কথাই মনে করুন, হঠাৎ করেই উল্টো পথে চলার বিষয়টি নিয়ে অনেক হৈচৈ হলো; দেখা গেল যে যত বেশি উচ্চপদস্থ বা (যেকোনোভাবে) ক্ষমতাবান, তাঁর উল্টো পথে চলার প্রবণতা ততই বেশি। কিন্তু আমরা সেই ঘটনা কিন্তু ভুলেই গেছি। এই ‘ছোট ছোট’ নিয়ম না মেনে চলার প্রবণতা এখন আমাদের মধ্যে গেঁথে গেছে। আর আমাদের দেশটিই এমন যে মনে হয় আইন-কানুন এবং নিয়ম আসলে সবার জন্য প্রযোজ্য নয়। ফেসবুকে একটি ভিডিও দেখলাম, যেখানে পুলিশের একজন ওসি উদ্ধতভাবে শিক্ষার্থীদের বলছেন যে তাঁর গাড়িতে সমস্যা আছে কি না আছে সেটা দেখার মালিক তিনি নিজে; যার অর্থ এই দাঁড়ায় যে তিনি নিজেই আইন। তো বলছিলাম, নিয়ম মানার সংস্কৃতির কথা। আইন-কানুন এবং নিয়ম মেনে চলার সংস্কৃতি আমাদের দেশে থাকবে কেমন করে? আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বই যে নিয়ম ভাঙার উদাহরণ তৈরি করে চলে নিয়মিত!

আমাদের শিক্ষার্থীদের এই অসাধারণ আন্দোলনে সমর্থন না দিয়ে উপায় নেই। আমরা জানি যে এতে সাময়িকভাবে আমাদের অনেকেরই অনেক সমস্যা হচ্ছে; আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা নানাভাবেই সেই সমস্যাগুলোর মাত্রা কমিয়ে রাখার চেষ্টাও সর্বাত্মকভাবে করে চলছে। ঢাকায় প্রচণ্ড ট্রাফিক জ্যামে আমরা প্রতিদিনই অ্যাম্বুল্যান্সকে নিশ্চল আটকে পড়ে থাকতে দেখি; কিন্তু এ আন্দোলনের সময় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা অ্যাম্বুল্যান্সের জন্য আলাদা লেন করে উন্নত পাশ্চাত্য দেশগুলোর মতো জরুরি লেনের ধারণাকে বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছে! আরেক দিকে পরিবহন শ্রমিক ও মালিকদের সংগঠন অলিখিত পরিবহন ধর্মঘটের মাধ্যমে মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে জনগণের ভোগান্তি আরো বাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা কেন? এটি মোটেই কাম্য নয়। যথাযথ লাইসেন্সধারী চালকের দ্বারা চালিত ফিটনেসসহ গাড়ি অর্থাৎ আইনসিদ্ধভাবে কোনো পরিবহন চালানোর ব্যাপারে আমাদের এই কোমলমতি আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা কোনো বাধা দিয়েছে বলে তো আমাদের জানা নেই!

এবার কিছু টেকনিক্যাল কথা বলা যাক। আমরা দাবি করি, আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ছি। সেই লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রকল্পও আমরা নিয়েছি, নিচ্ছি। বিআরটিএ এখন যে লাইসেন্স প্লেটটি দেয় তাকে আমরা বলি ডিজিটাল নাম্বার প্লেট, যাতে একটি আরএফআইডি ট্যাগ রয়েছে এবং আরএফআইডি চেকপোস্টের মাধ্যমে এই ডিজিটাল নাম্বার প্লেটসহ গাড়িগুলো শনাক্ত করতে পারার কথা। কিন্তু ছয় বছর আগে এ প্রকল্প শুরু হওয়ার পর অনেক ডিজিটাল নাম্বার প্লেট ইস্যু হলেও সারা দেশের মধ্যে শুধু রাজধানীতে ১২টি স্থানে এই চেকপোস্ট বসানো হয়। ফলে এর সুফল পাওয়া দুরাশা মাত্র। এরূপ অনেক সুফলই আমরা পাচ্ছি না, যা হয়তো আরেকটু সচেতন হলে আর সদিচ্ছা থাকলে পাওয়া যেত। যা বলছিলাম, এ আন্দোলনের মাধ্যমে ছোট ছোট শিশু সেই কাজ করে দেখিয়েছে, যা করার কথা আমাদের সরকারের। কিন্তু এই যে গাড়ির ফিটনেস কিংবা চালকের লাইসেন্স মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যায় আর মালিক কিংবা চালক নির্বিকার থাকে, এটাই বা কেন? একজন চালকের লাইসেন্স যে মেয়াদোত্তীর্ণ কিংবা একটি গাড়ির ফিটনেসের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে এই তথ্য তো নিশ্চিতভাবেই বিআরটিএর তথ্যভাণ্ডারে রয়েছে। এখন সেই চালক কিংবা মালিককে এসএমএসের মাধ্যমে সতর্ক করা, তার বা তাদের মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার বিষয়টি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানানো এবং আরএফআইডি চেকপোস্টের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেই গাড়িগুলো শনাক্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া—এগুলো আমরা করতে পারছি না কেন?

 

লেখক : অধ্যাপক, কম্পিউটার কৌশল বিভাগ, বুয়েট।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের মানদণ্ড কী? - dainik shiksha শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের মানদণ্ড কী? অবসর-কল্যাণে শিক্ষার্থীদের দেয়া টাকা জমার কড়া তাগিদ - dainik shiksha অবসর-কল্যাণে শিক্ষার্থীদের দেয়া টাকা জমার কড়া তাগিদ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে সুপ্রিম কোর্টের ফতোয়ার রায় পাঠ্যপুস্তকে নিতে হবে - dainik shiksha সুপ্রিম কোর্টের ফতোয়ার রায় পাঠ্যপুস্তকে নিতে হবে সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি - dainik shiksha সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি - dainik shiksha বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0027859210968018