সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৭

দৈনিকশিক্ষা প্রতিবেদক |

পুরান ঢাকার সিদ্দিক বাজারে ক্যাফে কুইন ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণে নিহতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১৭ জন; ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ায় মঙ্গলবার রাত পৌনে ১১টার দিকে উদ্ধারকাজ স্থগিত হয়। বুধবার সকাল ৯টার পর উদ্ধারকাজ ফের শুরু হয়। 

ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী মঙ্গলবার রাত ১১টার পর বলেন, “পিলারগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। ফলে ভেতরে ঢুকে উদ্ধার কাজ চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই উদ্ধার অভিযান রাতের মত স্থগিত করা হয়েছে। আমরা কাল আবার দেখব।”  

মঙ্গলবার বিকালে নর্থ সাউথ রোডের ১৮০/১ হোল্ডিংয়ের সাত তলা ওই ভবনে বিকট বিস্ফোরণ ঘটে। ভবনে থাকা বিভিন্ন দোকানের কর্মচারীদের পাশাপাশি সামনে রাস্তায় থাকা যানবাহনের যাত্রী ও পথচারীরাও হতাহত হন।

বিস্ফোরণের পর থেকে শতাধিক মানুষকে আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকলে কলেজ হাসপাতাল এবং শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটে নেয়া হয়। তাদের মধ্যে অর্ধশতাধিক ব্যক্তিকে ভর্তি রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে, বাকিরা চিকিৎসা নিয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন।

বিস্ফোরণে ক্যাফে কুইন ভবনের প্রথম দুটি তলার ছাদ ধসে বেজমেন্টে পড়েছে। সে কারণে ভেতরে আরও কেউ আটকা পড়ে থাকতে পারেন বলে আশঙ্কা করা হলেও তাদের সংখ্যা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারছেন না উদ্ধারকর্মীরা। কীভাবে সেখানে এত বড় বিস্ফোরণ ঘটল, সে বিষয়েও কিছু জানাতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস।

ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক সাংবাদিকদের বলেছেন, বিস্ফোরণের ঘটনা নাশকতা না দুর্ঘটনা,বিশেষজ্ঞরা তা তদন্ত করে দেখছেন।

ভয়াবহ বিস্ফোরণ

ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা সিদ্দিক বাজারের ওই ভবনে বিস্ফোরণের খবর পান বিকাল ৪টা ৫০ মিনিটের দিকে। প্রথমে ছয়টি ইউনিট সেখানে গেলেও পরে তা বেড়ে হয় ১১টি। ডিএমপির কাউন্টারিজম ইউনিটের বম ডিসপোজাল ইউনিট এবং সেনাবাহিনীর মিলিটারি পুলিশের একটি দলও পরে তল্লাশিতে যোগ দেয়।

সাত তলা যে ভবনে বিস্ফোরণ ঘটেছে, তার নিচের দুটো তলায় স্যানিটারি সামগ্রী আর গৃহস্থালী সামগ্রীর বেশ কয়েকটি দোকান ছিল। তার উপরে ছিল ক্যাফে কুইন নামের একটি খাবার হোটেল। সে কারণে ওই নামেই ভবনটি স্থানীয়রা চেনে। 

বিস্ফোরণে দেয়াল ভেঙে যাওয়ার পাশাপাশি ভেতরের জিনিসপত্র ছিটকে বাইরে বেরিয়ে আসে। ভবনের উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে থাকা সাভার পরিবহনের একটি বাসও ক্ষতিগ্রস্ত হয় বিস্ফোরণের ধাক্কায়।

ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হাফিজ আকতার বিকালে বলেন, “অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জীবনহানি অনেক ঘটেছে। সাম্প্রতিককালে এ ধরণের বিস্ফোরণের কোনো ঘটনা ঘটেনি।”

পাশের সাকি প্লাজা নামের পাঁচ তলা ভবনের ওপরে চারটি ফ্লোরে ব্র্যাক ব্যাংকের গুলিস্থান শাখা এবং ব্র্যাক ব্যাংকের এসএমই সার্ভিস সেন্টার। বিস্ফোরণের ধাক্কায় কাচ ভেঙে ব্যাংকের অফিস কক্ষগুলোর পর্দা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়।

ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন রাত ৮টার দিকে ঘটনাস্থলে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ভবনের নিচের কলামগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সেখানে তারা যেতে পারছেন না। সেনাবাহিনীর বিশেষজ্ঞরা এসেছেন। একটু ‘স্টেবল’ হলে নিচের দিকে অভিযান চালানো হবে।

সে সময় এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “বিস্ফোরণ যখন ঘটে মার্কেট তখন খোলা ছিল; ক্রেতা, বিক্রেতা, কর্মচারীরা ছিলেন। কতজন ভেতরে আটকা পড়ে আছে তা তাদের জানা নেই। সেনাবাহিনীর সদস্যরা যন্ত্রপাতি নিয়ে এসেছেন, তাদের সব যন্ত্রপাতি দিয়ে নিচতলা এবং আন্ডারগ্রাউন্ডে উদ্ধার অভিযান চালানো হবে।”

এর ঘণ্টা তিনেক পর ফায়ার সার্ভিস রাতের মত উদ্ধার অভিযান স্থগিত ঘোষণা করে।

 বিস্ফোরণের কারণ

বিস্ফোরণের কারণ জানতে চাইলে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক সাংবাদিকদের বলেন, “বিশেষজ্ঞরা তদন্ত করে দেখছেন বিস্ফোরণের ঘটনা নাশকতা না দুর্ঘটনা। আপনারা জানেন যে গ্যাস জমে বিস্ফোরণ হতে পারে। আমাদের বিশেষজ্ঞরা তদন্ত করে বলতে পারবেন যে এটি নাশকতা না কোনো দুর্ঘটনা।”

ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক মাইন উদ্দিন সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, “দোকান মালিক সমিতির লোকজন বলেছেন, নিচে কোনো গ্যাসের লাইন নেই। তবে পানির রিজার্ভ ট্যাংক রয়েছে। কোথায় কী ঘটেছে তা তদন্ত করে আপনাদের পরে জানাব।”

রাজউক চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিঞাও রাতে  ঘটনাস্থলে আসেন। উপস্থিত সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “মনে হচ্ছে ভবনটির কোথাও লিকেজ ছিল। এ কারণে অনেক গ্যাস জমে থাকতে পারে। হয়ত তখন কেউ ম্যাচের কাঠি জ্বালানোর ফলে এমন ঘটনা ঘটতে পারে। তবে ফায়ারের কর্মকর্তারা এখনো চূড়ান্তভাবে কিছু বলেনি।”

তিনি জানান, পুলিশ ও রাজউক কর্মকর্তারা ভবন মালিকের সাথে কথা বলেছেন। ভবনের ভেতর থেকে লোকজন সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ভেতরে থাকা মালামাল সরিয়ে নিতে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা কাজ করছেন।

হাসপাতালে আহাজারি

বিস্ফোরণের ঘটনাস্থল থেকে শতাধিক ব্যক্তিকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে হাসপাতালের পরিবেশ। 

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া জানান, এ পর্যন্ত ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে, তাদের মধ্যে ১৫ জন পুরুষ এবং ২ জন নারী।

তারা হলেন, মমিনুল ইসলাম (৩৮), তার স্ত্রী নদী আক্তার, মোহাম্মদ সুমন (২১), মুনসুর হোসাইন (৪০), ইসহাক মৃধা (৩৫), মো. ইসমাইল হোসেন (৪২), মো. রাহাত (১৮) ও আলামিন (২৩), মাইনউদ্দিন (৫০), নাজমুল হোসেন (২৫), ওবায়দুল হাসান বাবুল (৫৫), আবু জাফর সিদ্দিক (৩৪), আকৃত্তি বেগম (৭০), মো, ইদ্রিস মীর (৬০), হৃদয় (২০), নুরুল ইসলাম ভুইয়া (৫৫) ও মো. সিয়াম (১৯)। তাদের মরদেহ হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলছে।

আহতদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা গুরুতর বলে জানান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক।

ঢাকা মেডিকেলে যারা ভর্তি হয়েছেন, তাদের মধ্যে আছেন আজিম (১৫), নোমান (৩২), ফাইজু (১৫), আশিক (২৩), কাউছার (৩৭) সিয়াম (৫০), শাকিল (২৩), শহিদুল (৩৪), শাহিন ( ৪২),  ফয়সাল (২২),  লিটন (২৫), মো. হাসান (৩০), মোস্তফা (৩০) নাজির (৩০), নির্জর (২৮), খলিল (৪০), রুহুল আমিন (৩২), রশিদ (৫৪), শিবলী (৩৫),  হাসান ( ২০), তোফাজ্জল (৩০), সজীব (২৪), সুমি ( ১৮), রকেয়া (৫০), রিয়াজ (২০), জাহান (২৫), শাহ আলম ( ৩০), নূর আলম (১৮), জাহান আলী (২০), মজনু (২৮), সেলিনা (৩৬), মোস্তাফিজুর (১১), রাজিব (৪২), ফারদিন (২২), মিলন (২৬), নার্গিস (৩০), হুমায়ুন কবির (৪৮), সুমন (২১), তুষার (১৮), সাইফুল (২০), আলামিন (২৫), শহিদুল (৪৮), মশারফ (৫০), জাহান ( ১৯), আলাউদ্দিন (২৩), সুমন চক্রবর্তী (৪১), তুহিন (১০),  আলাউদ্দিন (২০), জয়নাল (৫০), মহাম্মদ ঈসমাইল ( ৪২), সুলাইমান ( ২৪) ও জামাল (৩৬)। এছাড়া আরও অন্তত ছয়জন ভর্তি আছেন, যাদের নাম জানা যায়নি।

আহতদের মধ্যে দগ্ধ আটজনকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে নেওয়া হয়েছে। তাদের সবার অবস্থা সঙ্কটাপন্ন বলে জানিয়েছেন ইনস্টিটিউটের চিকিৎসকরা।

ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক এবং আবাসিক সার্জন ডা. এস এম আইয়ুব হোসেন বলেন, “চারজনের শরীরের ৫০ শতাংশের বেশি পুড়েছে। একজনের ৯৮ শতাংশ পুড়ে গেছে।”

দেহের ৫৫ শতাংশ এবং ৩০ শতাংশে আগুনের ক্ষত নিয়েও বার্ন ইনস্টিটিউটে এসেছেন রোগীরা। কারও শরীরের ১৫ শতাংশের বেশি আগুনে পুড়ে গেলে চিকিৎসকরা ওই রোগীর অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হিসেবে বিবেচনা করেন।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষক লাঞ্ছিত ও পদত্যাগে বাধ্য করার প্রতিবাদ, কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি বিটিএর - dainik shiksha শিক্ষক লাঞ্ছিত ও পদত্যাগে বাধ্য করার প্রতিবাদ, কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি বিটিএর মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের দাবি - dainik shiksha মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের দাবি আন্দোলনে অসুস্থ ১১ নার্সিং শিক্ষার্থী - dainik shiksha আন্দোলনে অসুস্থ ১১ নার্সিং শিক্ষার্থী প্রধান শিক্ষককে জোর করে পদত্যাগপত্রে সই - dainik shiksha প্রধান শিক্ষককে জোর করে পদত্যাগপত্রে সই জলবায়ু পরিবর্তন মারাত্মক প্রভাব ফেলছে শিক্ষা খাতে - dainik shiksha জলবায়ু পরিবর্তন মারাত্মক প্রভাব ফেলছে শিক্ষা খাতে বয়স ৩৫ করার দাবিতে শাহবাগে চাকরি প্রত্যাশীদের মহাসমাবেশ - dainik shiksha বয়স ৩৫ করার দাবিতে শাহবাগে চাকরি প্রত্যাশীদের মহাসমাবেশ এমপিওভুক্তি: দীপু মনির ভাই টিপুচক্রের শতকোটি টাকার বাণিজ্য - dainik shiksha এমপিওভুক্তি: দীপু মনির ভাই টিপুচক্রের শতকোটি টাকার বাণিজ্য অধ্যক্ষকে পদত্যাগে বাধ্য, আওয়ামী লীগ নেতাকে স্থলাভিষিক্ত করার চেষ্টা - dainik shiksha অধ্যক্ষকে পদত্যাগে বাধ্য, আওয়ামী লীগ নেতাকে স্থলাভিষিক্ত করার চেষ্টা ভুয়া নিয়োগে এমপিও: এক মাদরাসার ১৫ শিক্ষকের সনদ যাচাই করবে অধিদপ্তর - dainik shiksha ভুয়া নিয়োগে এমপিও: এক মাদরাসার ১৫ শিক্ষকের সনদ যাচাই করবে অধিদপ্তর বার্ষিক পরীক্ষার উদ্দীপকসহ ও উদ্দীপক ছাড়া প্রশ্ন - dainik shiksha বার্ষিক পরীক্ষার উদ্দীপকসহ ও উদ্দীপক ছাড়া প্রশ্ন একসঙ্গে তিন প্রতিষ্ঠান থেকে বেতন তুলতেন মাদরাসা কর্মচারী - dainik shiksha একসঙ্গে তিন প্রতিষ্ঠান থেকে বেতন তুলতেন মাদরাসা কর্মচারী কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.003046989440918