সিন্ডিকেটের তৎপরতায় নতুন পাঠ্যবই ছাপা চ্যালেঞ্জের মুখে

দৈনিক শিক্ষা ডেস্ক |

একদিকে করোনার কারণে কাজে ধীরগতি অন্যদিকে প্রকাশকদের একটি সিন্ডিকেটের তৎপরতায় নতুন শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যক্রম নিয়ে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে। সরকারের কঠোর নজরদারির কারণে কয়েক বছর সক্রিয় হতে না পারলেও এবার সেই পুরনো কৌশলে বইয়ের সকল কাজ কব্জা করতে তৎপর হয়েছে একটি চক্র।

তারা জোটবদ্ধভাবে সরকারের প্রাক্কলিত দরের চেয়ে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমে দরপত্র জমা দিয়েছেন। এতে সরকারের টাকা সাশ্রয়ের আশা জাগলেও বইয়ের মান রক্ষা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। বইয়ে কাগজ ও ছাপা নিম্নমানের হতে পারে এই আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) কর্মকর্তারা। উদ্বিগ্ন অনেক প্রকাশকও। মঙ্গলবার (২১ জুলাই) জনকণ্ঠের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন বিভাষ বাড়ৈ।

প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, এমন পরিস্থিতিতে বইয়ের মান নিয়ে কোন আপোস নয়-সরকারের এমন নীতিতে অটল থাকার পরামর্শ দিয়েছেন পাঠ্যবই প্রকাশ ও শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তবে এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা আশ^স্ত করে বলেছেন, মনে রাখতে হবে কাউকেই এখনও আমরা কার্যাদেশ দেইনি। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি কার্যাদেশ চূড়ান্ত করেনি। কম রেটে বই ছাপা সম্ভব কিনা মূল্যায়ন কমিটি তা যাচাই-বাছাই করে দেখে সিদ্ধান্ত নেবে। এখনও বহু পথ বাকি। বইয়ের মান রক্ষায় সরকার কোন আপোস করবেনা।

কেবল কম রেটে দরপত্র হলেই হবেনা। কাজ দেয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই অন্য সকল যোগ্যতা, সক্ষমতা শতভাগ যাচাই বাছাই করেই দেয়া হবে। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি সকল কিছু দেখবে। আমরা সতর্ক আছি। জানা গেছে, আগামী শিক্ষাবর্ষে মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরে প্রায় ৭০ লাখ কপি বইয়ের চাহিদা কমেছে। তবে প্রাথমিক স্তরে বইয়ের সংখ্যা কমছে না। এই দুই স্তরের বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপার কাজই বিশেষ সিন্ডিকেটের খপ্পরে পড়তে যাচ্ছে বলে ইতোমধ্যেই সতর্ক পাঠ্যবই সংশ্লিষ্টরা।

এর আগে সরকারের বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণের শুরুর দিকে বিশেষ একটি চক্র জোটবদ্ধ হয়ে টেন্ডার জমা দিত সরকারের প্রাক্কলিত দরের চেয়ে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ কমে। যারা কম দামে কাজের কথা বলে নিম্নোমানর কাগজে বই ছাপিয়ে সরকারের কাছে হস্তান্তর করত। এরপর গত কয়েক বছর ধরে সরকারের কঠোর নজরদারির কারণে চক্রটি সক্রিয় হতে পারেনি। বই ছাপা ও কাগজের মানও এই সময়ে ভাল হয়।

তবে এবার করোনার কারণে নানা সীমাবদ্ধতার সুযোগে আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে নাম গোত্রহীন কিছু প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানও। যারা ভাল মানের কিছু প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মিলে কাজ বাগিয়ে নেয়ার কৌশল নিয়েছে। যার অংশ হিসেবে তারা জোটবদ্ধভাবে সরকারের প্রাক্কলিত দরের চেয়ে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ কমে দরপত্র জমা দিয়েছে। এর পরই তোলপাড় শুরু হয়েছে চারদিকে।

এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, চারজন প্রভাবশালী মুদ্রাকর জোটবদ্ধভাবে সরকারের প্রাক্কলিত দরের চেয়ে ২৫/৩০ শতাংশ কম মূল্যে দরপত্রে অংশ নিয়েছেন। এতে ওই চারজনের কব্জায় চলে যাচ্ছে মাধ্যমিক স্তরের প্রায় অর্ধেক পাঠ্যবই ছাপার কাজ। পেশাদার ও সাধারণ মুদ্রাকরদের অনেকেই বই ছাপার কাজ পাচ্ছেন না। ওই সিন্ডিকেটে (জোট) বিএনপিপন্থী মুদ্রাকর, নিষিদ্ধ নোট-গাইড বইয়ের ব্যবসায়ী ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের আশির্বাদপুষ্ট প্রকাশকও রয়েছেন।

এমন অবস্থায় এনসিটিবির কর্মকর্তারা বেকায়দায় পড়েছেন। কারণ রাতারাতি গজিয়ে ওঠা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গত বছর সরকারের বই ছেপে বিক্রির অনুমোদন নিয়ে নি¤œমানের কাগজের বই ছাপার অভিযোগ রয়েছে। ওইসব প্রতিষ্ঠানের কব্জায়ও এবার বিপুল সংখ্যক বই ছাপার কাজ চলে যেতে পারে এই চিন্তায় কপালে ভাঁজ পড়েছে কর্মকর্তাদের।

এনসিটিবি’র সদস্য (টেক্সট) প্রফেসর ফরহাদুল ইসলাম বলছিলেন, আমরা যখন বইয়ের প্রাক্কলিত কস্ট (দাম) নির্ধারণ করি, তখন টন প্রতি কাগজের মূল্য ছিল ৭০ হাজার টাকা; বর্তমানে এটি কমেছে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা অপ্রত্যাশিত কম দামে টেন্ডার ড্রপ করেছেন। তারা মাধ্যমিকে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ কমে এবং প্রাথমিকে ২৬ থেকে ৩০ শতাংশ কম মূল্যে টেন্ডার জমা দিয়েছেন।

আমরাও কিছুটা শঙ্কায় আছি তারা কোয়ালিটি বই কিভাবে দেবেন। তবে তাদের চাপে রাখার কিছু পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। প্রথমত, তাদের কাছ থেকে পিজি (পারফরমেন্স গ্যারান্টি বা জামানত) আগে রাখা হত ১০ শতাংশ, এবার এটি ২০ শতাংশ করা হচ্ছে। আগে এনসিটিবির পাশাপাশি, ডিপিই (প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর) এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় বই ছাপার কাজ মনিটরিং করত। এবার আরও একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে মন্ত্রণালয়ে।

বেশ কয়েকটি লটের বই ছাপার কাজ করে এমন এক ব্যবসায়ী এবারও কাজ পাবেন ধরে নিয়েই বলছিলেন, আমি অনেক কাজ পাব। তবে অনেকেরই যোগ্যতা নেই এটা সরকারকে খেয়াল করতে হবে। না হয় বইয়ের মান অনেক বছর পর আবার প্রশ্নের মুখে পড়বে।

বারতোপা প্রিন্টার্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অনুপ কুমার দে বলেন, প্রাক্কলিত রেটের ৩০/৩৫ শতাংশ কম রেট দিয়ে দরপত্র জমা দেইনি। কারণ, কম রেটে ভাল কাজ করতে পারব না। তাই আমাদের ছাপাখানা দেশের বৃহৎ হলেও আমরা কাজ পাচ্ছি না, এটাই বাস্তবতা।

জানা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে কাগজ তৈরির পাল্পের দামে দরপতন, নতুন অর্থবছরে বাজেটে কাগজের ওপর ১০ শতাংশ ভ্যাট (২৫ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ) হ্রাস এবং আন্তর্জাতিক বাজারে কাগজের তৈরি বিভিন্ন সামগ্রী রফতানি বন্ধ থাকায় টন প্রতি কাগজের দাম কমেছে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। এসব সরকারের প্রাক্কলিত দামের চেয়ে কম দামে দরপত্র জমা দিয়েছে মুদ্রাকর প্রতিষ্ঠানগুলো। ২০২১ শিক্ষাবর্ষের জন্য প্রাক-প্রাথমিক থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত বিনামূল্যে বিতরণের জন্য প্রায় সাড়ে ৩৪ কোটি বই ছাপানো হচ্ছে।

এর মধ্যে মাধ্যমিকে প্রায় ২৪ কোটি সাত লাখ বই ছাপানো হবে। মাধ্যমিকের বই ছাপার প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৫০ কোটি টাকা। প্রাথমিকের বই ছাপার প্রায় (গত বছরের চাহিদা অনুযায়ী) দশ কোটি ৫৪ লাখ বইয়ের দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় ৩৫ কোটি বই ছাপার জন্য সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১১৫০ কোটি টাকা। কিন্তু মুদ্রাকররা অস্বাভাবিক কম মূল্যে দরপত্র আহ্বান করায় ওই টাকা থেকে প্রায় ৩০০ কোটি সাশ্রয় হচ্ছে বলে এনসিটিবি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

এনসিটিবি জানিয়েছে, প্রাথমিকের সাড়ে ১০ কোটি বই ছাপাতে বিগত বছরের ন্যায় এবারও ৯৮টি লটে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর। বিদেশী দুটি প্রতিষ্ঠানসহ দেশীয় শতাধিক প্রতিষ্ঠান এতে অংশ নিয়েছে। দরপত্রের প্রাথমিক মূল্যায়নে দেখা গেছে, প্রায় সবকটি প্রতিষ্ঠানই প্রাক্কলিত দরের চেয়ে ২৬ থেকে ৩০ শতাংশ কমে দরপত্র জমা দিয়েছে।

এতে গত বছরের চেয়ে প্রায় ৫০ কোটি টাকা সাশ্রয় হচ্ছে। প্রতি ফর্মা ২ টাকা ১০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত বছর প্রাথমিকের একটি বই ছাপতে গড়ে খরচ ২৩ টাকা; এ বছর যা ১৮ টাকা ৩২ পয়সা পড়ছে। যদিও এনসিটিবি’র বিতরণ নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক মোঃ জিয়াউল হক বলেন, কোন কেলেঙ্কারির সুযোগ নেই। আমরা অত্যন্ত কঠোর রয়েছি।

কেউ যদি খারাপ বই দেয়ার চেষ্টা করে তা পারবে না। গত বছর আমরা একজনের ৩০ হাজার বই বাতিল করেছি। একজনের ৪০ ফর্মার ৫০ হাজার বই, আরেকজনের ২৬ হাজারের বেশি বই কেটে ফেলা হয়েছে। নিম্নমানের বই আমরা নেব না। চলতি অর্থাৎ ২০২০ শিক্ষাবর্ষে সারা দেশের চার কোটি ২৭ লাখ ৫২ হাজার ১৫৮ জন শিক্ষার্থীর কাছে ৩৫ কোটি ৩৯ লাখ ৯৪ হাজার ১৯৭ কপি পাঠ্যবই বিতরণ করা হয়। এর মধ্যে প্রাথমিকের ১০ কোটি ৫৪ লাখ দুই হাজার ৩৭৫ কপি এবং মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের ২৪ কোটি ৭৭ লাখ ৪২ হাজার ১৭৯ কপি বই বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়। 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা - dainik shiksha মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা - dainik shiksha দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0040559768676758