সাগর স্নাত সোনাগাজী উপজেলার বাসিন্দা নুসরাত জাহান রাফি মাদ্রাসায় পড়ুয়া মেধাবী ছাত্রী। সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ- দৌলার যৌন নিপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে তার বিরুদ্ধে সোনাগাজী থানায় গত ২৭ মার্চ শ্নীলতাহানির অভিযোগ দায়ের করে। ঘটনার পর অভিযোগ দায়ের করতে গেলে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কর্তৃক নুসরাতকে জিজ্ঞাসাবাদের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। অভিযুক্ত সিরাজ-উদ-দৌলা তার অনুগতদের মাধ্যমে মামলা প্রত্যাহারের জন্য চাপ দিতে থাকে এবং তার পক্ষে মানববন্ধন করায়।
কিন্তু সাহসী নুসরাত দমে যাওয়ার পাত্রী নয়; সে মামলা প্রত্যাহার করে নেয়নি। নুসরাতের মা-বাবাসহ গোটা পরিবার তার পাশে থেকে মামলায় লড়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। এরই ফলে অধ্যক্ষের অনুগতরা নুসরাতকে আলিম পরীক্ষা চলাকালেই আগুনে পুড়িয়ে এমনভাবে হত্যা করার ব্যবস্থা নেয়, যাতে সে আত্মহত্যা করেছে বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। নুসরাত এই মাদ্রাসাতেই এবার আলিম পরীক্ষা দিচ্ছিল। প্রতারণার মাধ্যমে পরীক্ষা কেন্দ্রের ছাদে নিয়ে নুসরাতকে পুনরায় মামলা তোলার জন্য চাপ দেয়, মেরে ফেলার হুমকি দেয়। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও তাদের কথায় রাজি হয়নি নুসরাত।
বোরখা পরা চারজন তার হাত-পা বেঁধে শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয়। আগুনে নুসরাতের হাতের বাঁধন পুড়ে গেলে সাহসী এবং তেজস্বী নুসরাত সে অবস্থায় দৌড়ে নিচে নেমে তার শরীরে আগুন দেওয়ার ঘটনা বর্ণনা করে। মৃত্যুর আগে হাসপাতালে ডাক্তারদের কাছে তার শরীরে আগুন দেওয়ার ঘটনায় অপরাধীকে শনাক্ত করার চেষ্টা করে। অপরাধীকে কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তির আওতায় আনা ছিল নুসরাতের প্রত্যয়। এ হত্যার ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নুসরাতের পাশে থেকেছেন।
আজকে সারা বাংলার মানুষ নুসরাত হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবিতে সোচ্চার। মহান সংসদে জঙ্গিবাদ ও যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়ে ১৪৭ বিধিতে আনা একটি প্রস্তাবের ওপর সাধারণ আলোচনা শেষে সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়। আলোচনায় নুসরাত হত্যার বিষয়টি গুরুত্ব পায়। দ্রুত বিচারের মাধ্যমে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিষয়ে সাংসদরা বক্তব্য দেন। নুসরাতের এই বীরত্বপূর্ণ মৃত্যু আমাকে স্মৃতিকাতরতায় আচ্ছন্ন করে। ১৯৯৬ সালের অক্টোবরে সোনাগাজীতে উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে যাই। একজন নারী হিসেবে এ ধরনের একটি সন্ত্রাসের জনপদে দায়িত্ব পালন করাটা খুবই চ্যালেঞ্জিং ছিল। সেই সময় আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকলেও রাজনৈতিক সহিংসতার দিক থেকে বিএনপি কোনো অংশেই কম শক্তিশালী ছিল না। সেখানে সকালে যদি বিএনপির পক্ষভুক্ত একজনকে হত্যা করা হতো, তাহলে দেখা যেত এক ঘণ্টার মধ্যেই আওয়ামী লীগের পক্ষের একজনকে হত্যা করা হয়েছে।
কেউই বিচারের অপেক্ষায় বসে থাকত না। প্রতিশোধ স্পৃহা ছিল মারাত্মক। দায়িত্ব পালনকালে অনেক নতুন নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি। যেমন এসএসসি পরীক্ষার আগে শুনতে পেলাম, পরীক্ষা শেষে মেয়েদের পরীক্ষা সেন্টার থেকে পছন্দের অনেক মেয়েকেই কিডন্যাপ করা হয় বা নানা রকম হয়রানি করে। আর ছেলেদের কেন্দ্রে সরকারি দলের ছাত্ররা বিরোধী পক্ষের ছাত্রদের মারধর করে হাত-পা ভেঙে দেয়। ঘটনাটি জানার পর আমার দায়িত্ব পালনকালে চেষ্টা করেছি শেষ পরীক্ষার দিন কেন্দ্রগুলোতে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা দিতে, যাতে পরীক্ষার শেষ দিনে কোনো অঘটন না ঘটে। কিন্তু নুসরাতের দাখিল পরীক্ষা শেষে তাকে সেই ধরনেরই একটি ঘটনার শিকার হতে হয়েছিল। সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা কর্তৃক যৌন নিপীড়নের মামলা দায়েরের ঘটনার প্রেক্ষাপট বলতে গিয়ে নুসরাত জানিয়েছে, ২০১৭ সালে দাখিল পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে সে দুস্কৃতকারীদের দ্বারা চুন মিশ্রিত গরম পানির হামলার শিকার হয়েছিল। আর এই ঘটনাকে পুঁজি করেই অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা তাকে যৌন নিপীড়ন করে। সোনাগাজীতে দায়িত্ব পালনকালে বক্তারমুন্সী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে আনা ১৫-১৬টি অভিযোগের মধ্যে ছেলেশিশুদের যৌন নিপীড়নের অভিযোগ ছিল। যতদূর মনে আছে, সেই অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলায় তার সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়।
স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে নুসরাতের মতো নীতি-নৈতিকতাহীন শিক্ষকের সঙ্গে পরিচয় না ঘটলেও চাকরি জীবনে প্রবেশ করার পর কিছু নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয়েছে। প্রশিক্ষণ চলাকালে আমাদের এক পুরুষ সহকর্মী ধারণা দেন যে, মাঠে আমাদের জ্যেষ্ঠ সহকর্মীদের মধ্যে কেউ কেউ নানা ধরনের অনৈতিক আচরণ করে থাকেন। অনেকেরই চারিত্রিক স্খলন রয়েছে; আমরা যেন সতর্ক থাকি। আমি তখন ভাবতেও পারিনি যে, একজন ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে মাঠে দায়িত্ব পালন করার সময়ও নারী হয়ে জন্ম নেওয়ার কারণে যথেষ্ট পরিমাণে নিজেদের নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে; যাতে যৌন নিপীড়নের শিকার হতে না হয়। সহকর্মীর কথাটি শুনে প্রথমে একটু ধাক্কা লেগেছিল।
মন খারাপ হলেও সেই পরামর্শ মাথায় রেখেই কর্মস্থলে প্রবেশ করি। মাঠ প্রশাসনে আমরাই প্রথম নারী কর্মকর্তা বিধায় আমাদের পোস্টিং দেওয়ার সময় কোনো জেলাতেই দু'জনের কম পোস্টিং দেওয়া হয়নি। আমরা কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার শুরুতেই ম্যাজিস্ট্রেসি শেখার জন্য আমাদের কোর্ট অ্যাটাচমেন্ট দেওয়া হয়। আমাকে দেওয়া হয় সদর উত্তরের এসডিও মহোদয়ের সঙ্গে, যিনি খুব ভালো মানুষ। আর আমার অপর সহকর্মীকে অ্যাটাচমেন্ট দেওয়া হয় সদর দক্ষিণের এসডিও মহোদয়ের সঙ্গে। দু'দিন কোর্টে ওঠার পরেই আমার সেই সহকর্মী এসডিও মহোদয়ের অনৈতিক ও অসঙ্গতিপূর্ণ আচরণ আঁচ করতে পেরে তার সঙ্গে এজলাসে উঠতে চাইছিল না। সে আমার সঙ্গে সদর উত্তরের এসডিও মহোদয়ের এজলাসে উঠে মামলা পরিচালনা শিখতে থাকে। কয়েক মাস পরে সে চেষ্টা করে সেখান থেকে বদলি হয়।
নারী সহকর্মীর নতুন কর্মস্থলে চলে যাওয়ার পর আমি অনেকটা একা হয়ে পড়ি। এ সময়ে আরও দু'একজনের বাজে মনোভাব বুঝতে পারি। কোনো এক ছুটির দিনে আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মধ্যে একজন একটি কাজ বুঝিয়ে দেওয়ার বাহানা করে আমাকে তার বাসায় যাওয়ার জন্য বলেন। আমি জানতাম তার স্ত্রী কর্মস্থলে নেই। এ অবস্থায় একা তার বাসায় যাওয়া কোনো রকমেই সম্মানজনক হবে না মনে করে আমি আমার ব্যাচমেট একজন পুরুষ সহকর্মীসহ তার বাসায় যাওয়ার অনুমতি চাইলাম। তিনি এতে অনাগ্রহ দেখালেন। তখন বিষয়টি আমার কাছে একেবারেই পরিস্কার হয়ে যায় যে, তার খারাপ অভিসন্ধি ছিল। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আমি একদিন কালেক্টরেটের বারান্দায় বেশ উচ্চ স্বরেই জানান দিই, চাকরি করি সম্মানের জন্য। সেই সম্মানই যদি না থাকে, তবে চাকরিটা ছেড়ে দেব।
তবে যার কারণে চাকরি ছাড়তে হবে, তার চাকরিটা আগে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করব। এরপর অবশ্য আর কখনোই আমাকে তেমন কোনো অপ্রীতিকর অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়নি। আমি মনে করি বুদ্ধিমত্তা, দৃঢ় মনোবল এবং সাহস একটি মানুষের অনেক বড় শক্তি; যা তাকে সুরক্ষা দেয়। প্রত্যেককেই নিজের নিজের অবস্থান থেকে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা উচিত। শুধু প্রতিবাদী ভূমিকা নয়, এর প্রতিকারে উপযুক্ত ব্যবস্থাও গ্রহণ করা উচিত। কিন্তু আমরা বেশিরভাগ সময়ই লোকলজ্জা, আমাদের সামাজিক, পারিবারিক, বংশ মর্যাদা, চাকরিগত অবস্থান, সবকিছু মিলিয়ে এসব নির্যাতন, নিপীড়নের ঘটনাগুলো চেপে যাই। হয়তো শুধু সেই ব্যক্তিটিকেই জানান দেওয়া হয়, তার অনৈতিক প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের মাধ্যমে। কিন্তু এই যৌন নিপীড়নমূলক আচরণের জন্য তার বিরুদ্ধে নুসরাতের মতো প্রাতিষ্ঠানিক অভিযোগ দায়ের করা সাধারণত হয়ে ওঠে না।
আমাদের নারী সহকর্মীদের অনেকের কাছেই এ ধরনের আরও উদাহরণ রয়েছে। আজকে মনে প্রশ্ন জাগে, আমরা কেন পারলাম না এটাকে জবাবদিহির আওতায় আনতে। আমার কাছে মনে হয় আমাদের চেয়ে নুসরাত অনেক বেশি সাহসী। আমরা বড় বড় মর্যাদাকর অবস্থানে থেকে যা পারিনি, তা সে করে দেখিয়েছে। বান্ধবীদের কাছে লেখা চিঠিতে নুসরাত উল্লেখ করেছে, 'আমি লড়ব শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত। আমি প্রথমে যে ভুলটা করেছি আত্মহত্যা করতে গিয়ে। সেই ভুলটা দ্বিতীয়বার করব না। মরে যাওয়া মানে তো হেরে যাওয়া। আমি মরব না, আমি বাঁচব। আমি তাকে শাস্তি দেব। যে আমায় কষ্ট দিয়েছে। আমি তাকে এমন শাস্তি দেব, যে তাকে দেখে অন্যরা শিক্ষা নেবে। আমি তাকে কঠিন থেকে কঠিনতম শাস্তি দেব। ইনশাআল্লাহ।' আমি মনে করি, মৃত্যুর পর নুসরাত অনেক বেশি শক্তিশালী। নুসরাত মৃত্যুকে জয় করেছে। যৌন নিপীড়কের জন্য আতঙ্কের এক নাম মৃত্যুঞ্জয়ী নুসরাত।
বর্তমানে ধর্ষণ যেন নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিশু থেকে বয়স্ক কারোরই ধর্ষকের হাত থেকে নিস্তার নেই। নারী যেন শুধুই পুরুষের ভোগ্যপণ্য। নারী হয়ে জন্মেছে সে পুরুষের জৈবিক চাহিদা মেটানোর জন্য। বাবা-চাচা-মামা-ভাই কারও দ্বারাই যখন নারী নিরাপদ থাকে না, তখন করণীয় কী? মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে আমি গাজীপুর মহিলা ও শিশু-কিশোরী হেফাজতিদের নিরাপদ আবাসন কেন্দ্র ভিজিটকালে দেখেছি, বাবার দ্বারা ধর্ষিত মেয়ের গর্ভে সন্তান। বিশ্বাস করা যায়? বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির সাবেক নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী একদিন আমার সঙ্গে একটি ঘটনা শেয়ার করেন। একজন বাবা তার চারটি কন্যাকে ধর্ষণ করেছে। পঞ্চম কন্যাটিকে বাবার নিপীড়ন থেকে রক্ষা করার জন্য মা এসে তাদের কাছে রেখে গেছেন। অন্তত একটি মেয়ে ভালো থাকুক বাবার এই কুরুচিপূর্ণ মানসিকতা থেকে। এই যে বিকৃত মানসিকতা এর হাত থেকে কীভাবে আমরা রেহাই পাব।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থাপিত আমাদের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার ভিজিট করতে গিয়ে একদিন দেখতে পাই, ছয় বছরের শিশুর যৌনাঙ্গ ছুরি দিয়ে কেটে তার ওপর পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়েছে। অথচ তার শরীরে এমন কোনো সৌন্দর্য প্রস্ম্ফুটিত হয়নি বা যৌন আবেদন জাগানোর মতো কোনো অবস্থা তৈরি হয়নি; যা কোনো পুরুষের মনে লালসা জাগাতে পারে। কিন্তু তা হয়েছে। সেই নরপিশাচ শিশুটির বুকের দুটি নির্ধারিত স্থানে কামড়ে দিয়েছে। মেয়েটির মাথায় আমি হাত রাখতেই ওর চোখ বেয়ে শুধুই অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। কোনো কথা বলতে পারছিল না। আর কতকাল আমাদের এই ধরনের ঘটনা সয়ে যেতে হবে। এটি থেকে বের হয়ে আসা খুব জরুরি। আমার মনে হয়, সৌদি আরবের মতো চুরি করলে হাত কেটে ফেলার মতো একটি নিবর্তনমূলক আইন প্রণয়ন করে এই বীভৎসতার হাত থেকে নিস্তার পাওয়া সম্ভব হতে পারে। কারণ তখন সারা জীবনের পৌরুষত্বের অমূল্য সম্পদ নিশ্চয়ই ক্ষণিকের তৃপ্তির জন্য হারাতে চাইবে না। ঘরের ভেতরে ও বাইরে যৌন নিপীড়কদের হাত থেকে নারীকুলের নিরাপদ থাকার ব্যবস্থা করা এখন সময়ের দাবি।
লেখক: সাবেক সিনিয়র সচিব, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়
সৌজন্যে: দৈনিক সমকাল