সিলেট মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দুর্নীতির বলি ২৩৭ জন, বেতন বন্ধ ১১ মাস

সিলেট প্রতিনিধি |

বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (সিলেট মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়) উপাচার্যের গাড়ি চালক আব্দুল কাইয়ুম। নিজের কাজ প্রতিদিনই করতে হচ্ছে তাকে। তবে ১১ মাস থেকে বেতন পাচ্ছেন না কাইয়ুম। 

কাইয়ুম বলেন, আমি ডিউটি ঠিকমতোই করছি; কিন্তু তারপরও বেতন পাচ্ছি না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শুধু আশ্বাস দিয়েই যাচ্ছে। শুধু আব্দুল কাইয়ুমই নন, একই অবস্থা এই মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর। এখানে কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন ২৪২ জন। এদের মধ্যে উপাচার্য-রেজিস্ট্রারসহ মাত্র ৫ জন নিয়মিত বেতন-ভাতা পাচ্ছেন। বাকি ২৩৭ জনেরই দীর্ঘ ১১ মাস ধরে বেতন-ভাতা বন্ধ রয়েছে। পদ সৃষ্টির আগেই অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে ও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রদানের অভিযোগ এনে তাদের বেতন-ভাতা বন্ধ রেখেছে কর্তৃপক্ষ। দীর্ঘদিন ধরে বেতন না পেয়ে বিপাকে পড়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। বেতন-ভাতার দাবিতে তাদের মধ্যে কয়েকজন আদালতে রিটও করেছেন।

বেতন বঞ্চিতদের দাবি, নিয়োগে অনিয়ম বা দুর্নীতি হয়ে থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ তা করেছে। তার বলি হতে হচ্ছে সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। পুরোনোদের বেতন-ভাতা বন্ধ রেখে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নতুন করে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করেছে বলেও জানান তারা। দেশের চতুর্থ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ২০১৮ সালে কার্যক্রম শুরু হয় সিলেট মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের। সম্প্রতি এর নামকরণ করা হয়েছে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়। প্রায় পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত এ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাসের জন্য জমি অধিগ্রহণ কাজই শুরু হয়। নগরের চৌহাট্টা এলাকায় ছোট একটি বাসায় অস্থায়ী ক্যাম্পাস করা হয়েছে। তবে গত ১৮ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণে ২ হাজার ৩৬ কোটি টাকার একটি প্রকল্প পাস হয়েছে একনেকে।

এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো শুরু হয়নি শিক্ষা কার্যক্রমও। তবে তেমন কোনো কার্যক্রম না থাকলেও প্রায় ২৪০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর নিয়োগ প্রদান করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে ১৭২ জন নিয়োগ পেয়েছেন অ্যাডহক ভিত্তিতে। অভিযোগ আছে, সরকারের নির্দেশনার পরোয়া না করে অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে বেশির ভাগ নিয়োগের ঘটনা ঘটেছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভিসি হিসেবে এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ডা. মোর্শেদ আহমদ চৌধুরীকে নিয়োগ দেয়া হয়। ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব পালন করেন শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অতিক্তি পরিচালক (অর্থ) নাঈমুল হক। এ দুজনের আমলেই নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে বিপুলসংখ্যক কর্মী নিয়োগ দেয়া হয়। সিলেট মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী, ইউজিসির অনুমোদিত পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে সিন্ডিকেটের পূর্বানুমতির প্রয়োজন হয়। এসব নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ভিসি ও ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অর্থের বিনিময়ে দেড় শতাধিক অ্যাডহক নিয়োগ দেন।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের নির্দেশনার তোয়াক্কা না করে ও সিন্ডিকেটের অনুমতি ছাড়া দুই শতাধিক কর্মী নিয়োগের অভিযোগের ভিত্তিতে তাদের বিরুদ্ধে তদন্তে নামে ইউজিসি। ইউজিসির তদন্তে নিয়োগ বাণিজ্য ও অনিয়মের সত্যতা পাওয়া যায়। এরপর দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তেও নিয়োগ বাণিজ্যের সত্যতা মেলে। গত ২২ জুন দুদকের সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. আনোয়ার হোসেনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সাবেক উপাচার্য (ভিসি) অধ্যাপক ডা. মো. মোর্শেদ আহমদ চৌধুরী ও সাবেক ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার মো. নাঈমুল হককে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা প্রদান করে আদালত। 

ভিসি অধ্যাপক ডা. মো. মোর্শেদ আহমদ চৌধুরীর মেয়াদ শেষ হওয়ায় তিনি বর্তমানে অবসরে আছেন এবং দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে সমালোচনার মুখে ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার মো. নাঈমুল হক চাকরি থেকে অব্যাহতি নেন। বর্তমানে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্বে আছেন অধ্যাপক ডা. এ এইচ এম এনায়েত হোসেন এবং রেজিস্ট্রার হিসেবে আছেন মো. ফজলুর রহমান। বিশ্ববিদ্যালয়টির একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ উঠলে তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশ ও মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার কথা বলে গত বছরের ডিসেম্বর থেকে বেতন-ভাতা বন্ধ রাখা হয়েছে সিলেট মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। এদের মধ্যে ৫৭ জনের স্থায়ী নিয়োগ রয়েছে। বাকিদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে অ্যাডহক ভিত্তিতে।

তারা বলেন, আগে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা দূর না করেই সম্প্রতি বিভিন্ন পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। আর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বন্ধ থাকলেও নিয়মিত পাচ্ছেন উপাচার্য ও রেজিস্ট্রার।

স্থানীয়ভাবে নিয়োগ পাওয়া ৫৭ জনের মধ্যে ১৫ জন বেতন-ভাতা বন্ধের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিট করেছেন। আর অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগ পাওয়া কর্মচারীরা তিনদফা দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন। এ ব্যাপারে কর্মচারী পরিষদের আহ্বায়ক মোহাজিরুল ইসলাম রাহাত বলেন, ১১ মাস ধরে বেতন পাচ্ছি না। আমরা মানবেতন জীবনযাপন করছি। অনেকে পরিবার নিয়ে গ্রামে চলে গেছে। এ অবস্থায় চাকরি স্থায়ীকরণ, বকেয়া বেতন-ভাতা প্রদান ও সুষ্ঠু কর্মপরিবেশের দাবিতে আমরা আন্দোলনে নেমেছি। তিনি বলেন, আমাদের বেতন দেয়া হচ্ছে না; কিন্তু কাজ করানো হচ্ছে। যে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের স্বাক্ষরে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা হচ্ছে তিনি বেতন পাচ্ছেন না। নিয়োগ অবৈধ হলে আমাদের দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে কেন?

এ ব্যাপারে সিলেট মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. এ এইচ এম এনায়েত হোসেন বলেন, যাদের বেতন-ভাতা বন্ধ তারা উচ্চ আদালতে রিট করেছেন। বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন, আর যাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়েছিল তাদের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। এ বিষয়ে আর কিছু জানার থাকলে রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে যোগাযোগ করার অনুরোধ করেন তিনি। মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মো. ফজলুর রহমান বলেন, ‘আগের ভিসি ও রেজিস্ট্রার লোকবল নিয়োগ সংক্রান্ত জটিলতা সৃষ্টি করে গেছেন, আমরা সেটি দূর করার চেষ্টা করছি। দ্রুত সিন্ডিকেট আহ্বান করা হবে। এই সিন্ডিকেটে যাদের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে তাদের ব্যাপারে কী করা যায় তা নিয়ে আলাপ হবে। আর কয়েকজন আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন। তাদের ব্যাপারে আদালতই সিদ্ধান্ত নেবেন। 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
চলতি মাসে টানা ৪ দিনের ছুটি মিলবে যেভাবে - dainik shiksha চলতি মাসে টানা ৪ দিনের ছুটি মিলবে যেভাবে সিইসিসহ পাঁচ কমিশনারের পদত্যাগ - dainik shiksha সিইসিসহ পাঁচ কমিশনারের পদত্যাগ রাষ্ট্রপতি যেকোনো সময় পদত্যাগ করতে পারেন - dainik shiksha রাষ্ট্রপতি যেকোনো সময় পদত্যাগ করতে পারেন বাতিল কারিকুলামে শিক্ষার্থীরা আরও একবছর ভুগবেন কেন? - dainik shiksha বাতিল কারিকুলামে শিক্ষার্থীরা আরও একবছর ভুগবেন কেন? ডিআইএতে টাকার খেলা, অভিযুক্তরাই স্কুল অডিটে - dainik shiksha ডিআইএতে টাকার খেলা, অভিযুক্তরাই স্কুল অডিটে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই নতুন অ্যাডহক কমিটি হবে - dainik shiksha সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই নতুন অ্যাডহক কমিটি হবে প্রাথমিকে স্বতন্ত্র ক্যাডার সার্ভিস চালুর দাবি - dainik shiksha প্রাথমিকে স্বতন্ত্র ক্যাডার সার্ভিস চালুর দাবি দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0050361156463623