সীমাহীন দুর্ভোগ থেকে দুঃসহ যন্ত্রণায় সহস্রাধিক শিক্ষার্থী

মিলন কর্মকার রাজু, কলাপাড়া (পটুয়াখালী) |

কাদা পানিতে হাঁটতে হাঁটতে সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী মরিয়ম বেগমের পা ফুলে উঠেছে। পায়ের গোড়ালী ও আঙুলের ফাঁকে সৃষ্টি হয়েছে ক্ষত। রাত হলেই জ্বর। এ অবস্থার মধ্যে তাকে প্রতিদিনই মাদরাসা আসা যাওয়া, প্রাইভেট, কোচিং ক্লাসসহ দৈনন্দিন কাজকর্ম করতে হচ্ছে। একই অবস্থা তার ছোট বোন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী মারুফা বেগম ও ছোট ভাই প্রাক প্রাথমিকের ছাত্র মুসারও। এ তিন ভাই-বোনের মতো শিক্ষার আলোতে আলোকিত হওয়ার স্বপ্ন দেখা চারটি বিদ্যালয়ের সহস্রাধিক শিক্ষার্থী ও পাঁচ শতাধিক পরিবারের সীমাহীন দুর্ভোগ এখন দুঃসহ যন্ত্রণায় রূপ নিয়েছে। 

পটুয়াখালীর কলাপাড়ার মহিপুর ইউনিয়নের তিনটি গ্রাম জুড়ে গত দেড় মাস স্থায়ী জলাবদ্ধতা এখন ভোগান্তিতে পরিণত হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে নিজামপুর বাঁধ ভেঙে যাওয়ার পর এখন নিঃস্ব হওয়ার পথে হাজার হাজার মানুষ। 

দুর্ভোগকবলিত এসব এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বাড়ির সামনে পানি কম সেখানেও হাঁটু পানি। ডুবে আছে বাড়ির পুকুর, ফসলি জমি ও চলাচলের রাস্তা। জোয়ারের ফলে শত শত বসত ঘর ২-৩ ফুট পানিতে সকাল ও রাতে প্লাবিত হচ্ছে। এ অবস্থা চলছে গত দেড় মাস ধরে। বাধ্য হয়ে অধিকাংশ পরিবারকে নিজ ঘর বাড়ি ফেলে রাত কাটাতে হচ্ছে অন্যের বাড়িতে। কেউ বা আশ্রয় নিয়েছে আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি ঘরে। যারা এ জলাবদ্ধতার মধ্যে বসবাস করছে তারা পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। 

গ্রামের পর গ্রাম এভাবে পানিতে ডুবে থাকায় নিজামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মহীপুর কো অপারেটিভ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ইউসুফপুর বালিকা দাখিল মাদরাসা ও সুধীরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহস্রাধিক  শিক্ষার্থীকে প্রতিদিন হাঁটুসমান কাদা পানি, কখনও বুক সমান পানিতে ভিজে ক্লাস পরীক্ষায় অংশ নিতে হচ্ছে। 
২০০৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ নভেম্বর। সিডরের রাতে সুধীরপুর গ্রামের বাঁধের ওপর দিয়ে নিরাপদে আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার পথে পানির স্রোতে পড়ে মারা যায় ইউসুফপুর বালিকা দাখিল মাদরাসা চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী তানজিলা ও তার বোন ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী মমতাজ। 

নিজামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, বুক সমান পানির মধ্য দিয়ে শত শত শিক্ষার্থী পরীক্ষার জন্য স্কুলে আসছে। অনেক অভিভাবক শিশু শিক্ষার্থীকে স্কুলের বারান্দায় পানির মধ্যে নামিয়ে দিয়ে পাশ্ববর্তী রাস্তায় হাঁটুসমান পানিতে অপেক্ষমাণ। এ বিদ্যালয়ের নিচতলায়ও তখন হাঁটু সমান। সাগরঘেঁষা আন্ধারমানিক নদীর পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় বাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে ঢেউয়ের তোড়ে কূলে ভিড়ানো নৌকা ও ট্রলারও স্কুলের চারদিকে নোঙর করে আছে। 
তিন সন্তানের জননী ফাতেমা বেগম বলেন, ঘরের মধ্যে পানি। গত সাত দিন ধরে প্রতিবেশীর ঘরে স্বামী, সন্তান নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। শত দুর্ভোগের মধ্যেও সন্তানের পরীক্ষা। তাই পানিতে ডুবে যাতে কোন বিপদ না হয়, এজন্য শিশু মুসাকে পরীক্ষার জন্য স্কুলে নিয়ে এসেছেন। পরীক্ষা শেষে আবার তাকে নিয়ে যাবেন এজন্য দাড়িয়ে আছেন পানির মধ্যে। এ বিদ্যালয়ে তার ৫ম শ্রেণিতে ফাতেমাও পরীক্ষা দিতে এসেছে বুকসমান পানির মধ্য দিয়ে। একই সাথে স্কুলে এসেছে প্রতিবেশীদের সন্তান মুনিয়া, হনুফা, নাঈম, সাদিয়া ও সানজিদাসহ শতশত শিক্ষার্থী। তাদের জন্য অপেক্ষমান আরও অন্তত ২০ জন অভিভাবক।

গৃহবধু রিজিয়া বেগম জানালেন, তার ঘরের মেঝেয় হাঁটু পানি। তার দুই মেয়ে মুনিয়া ও হনুফা পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। এই পানির মধ্য দিয়ে স্কুলের আসা যাওয়া করতে গিয়ে ঠাণ্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে এখন জ্বর, সর্দি, কাশি কমছেই না। পায়ে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু পরীক্ষার জন্য অসুস্থ্য অবস্থায় স্কুলে আসতে হয়েছে। এভাবে দূর্ভোগের কথা জানালেন এলাকার অর্ধশতাধিক অভিভাবক।

মহীপুরের এ হাজারো মানুষের সমস্যা থেকে মুক্তির আবেদন জানিয়ে পটুয়াখালী জেলা প্রশাসক, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে লিখিত আবেদন করেছে গ্রামবাসীরা। কিন্তু সমস্যা সমাধানে কোন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না জানালেন দুর্ভোগ কবলিত গ্রামের নুরুল আমিন। তিনি বলেন, ঠিকাদার অর্ধেক কাজ করে ফেলে রেখে চলে গেছে। যেটুকু মাটি দেয়া হয়েছিলো গত ১৫ দিনে তাও ভেসে গেছে। এ কারণে এখন ভাসছে হাজার হাজার মানুষ।
ইউসুফপুর বালিকা দাখিল মাদরাসা সুপার মাওলানা শফিকুল ইসলাম দৈনিকশিক্ষা ডটকমকে জানান, মাদরাসা ৪১৯ শিক্ষার্থীর মধ্যে নিজামপুর, সুধীরপুর ও পুরান মহিপুর গ্রামের দুই শতাধিক ছাত্রী রয়েছে। কিন্তু এই তিনটি গ্রামই এখন পানিতে নিমজ্জিত। এ কারণে মাদরাসা উপস্থিতি কমে গেছে। যারাও আসছে, কর্দমাক্ত পানির মধ্য দিয়ে হাঁটাচলা করতে করতে এবং ভেজা পোষাকে কয়েক ঘন্টা ক্লাস করায় অনেক ছাত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাদের পায়ের বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিয়েছে।

নিজামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আব্দুস সালাম দৈনিকশিক্ষা ডটকমকে জানান, মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে বুকসমান পানিতে প্রতিদিন যেভাবে শিক্ষার্থীরা আসছে তাতে যে কোন মুহূর্তে ভয়াবহ দূর্ঘটনা ঘটতে পারে। কেননা গোটা বর্ষা ধরেই স্কুল মাঠ ও আসা যাওয়ার রাস্তা ৩ থেকে ৫ ফুট পানিতে নিমজ্জিত থাকে। অমাবশ্যা ও পূর্নিমার প্রভাবে জোয়ারে এখন স্কুলও প্লাবিত হচ্ছে। জরুরী ভিত্তিতে নিজামপুর বাঁধ ও অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের রাস্তা মেরামত না হলে দুর্ঘটনা ও দুর্ভোগ ক্রমশ বাড়বে।

কলাপাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকেীশলী মো. আবুল খায়ের দৈনিকশিক্ষা ডটকমকে জানান, নিজামপুরে বাঁধ মেরামতে তিনটি প্যাকেজে  ৯০ লাখ টাকা মাটির কাজ শুরু হয়েছিল। কিন্তু ঠিকাদার মাটি না পাওয়ায় বাঁধ মেরামত করতে পারছে না। তবে এ বাঁধ মেরামতে জরুরি পদক্ষেপ নেয়া হবে।

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে খাড়িয়া ভাষা সংরক্ষণে উদ্যোগ গ্রহণের আহবান প্রধান বিচারপতির - dainik shiksha খাড়িয়া ভাষা সংরক্ষণে উদ্যোগ গ্রহণের আহবান প্রধান বিচারপতির উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি - dainik shiksha উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি শিক্ষক হতে চান না শিক্ষক দম্পতিদের কৃতী সন্তানরা - dainik shiksha শিক্ষক হতে চান না শিক্ষক দম্পতিদের কৃতী সন্তানরা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0032229423522949