সুন্দরবন বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ |

আজ সুন্দরবন দিবস। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনভূমি সুন্দরবনকে নানান বিশেষণে বিশেষায়িত করা হয়। ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর থেকে সুন্দরবন নিয়ে বিদেশি পর্যটকদের কাছেও যোগ হয়েছে ভিন্ন মাত্রা। দশ হাজার বর্গ কিলোমিটার বিশিষ্ট এই বনভূমি গঙ্গা ও  ব্রহ্মপুত্র  মোহনায় অবস্থিত এবং বাংলাদেশ ও ভারতের  পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে প্রসারিত।

২০০১ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের আওতায় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী ও পরিবেশবাদী সংগঠনের অংশগ্রহণে জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে ওই দিনটিকে ‘সুন্দরবন দিবস’ ঘোষণা করা হয়। 

এবার এই দিবসের আগে গত ১২ ফেব্রুয়ারি সুন্দরবনে একটি বাঘের মরদেহ পাওয়া গেছে। সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের কচিখালী এলাকার একটি খালের পাড় থেকে বাঘটির মরদেহ পাওয়ার খবরটি নিশ্চিত করেন খুলনার বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো। বাঘটির ময়নাতদন্তের জন্য গত মঙ্গলবার সকালে প্রাণিসম্পদ বিভাগের একটি টিম সুন্দরবনের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। এজন্য প্রাণিসম্পদ বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করে একটি টিম পাঠানো হয়। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পেলে মৃত্যুর সঠিক কারণ জানা যাবে বলে জানায় বনবিভাগ। 

এরকম খবর পত্রিকায় মাঝে মাঝেই প্রকাশ হয়। এতে প্রশ্ন জাগে, কেমন আছে সুন্দরবন?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাকৃতিক অক্সিজেন ভান্ডার বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন বুক দিয়ে উপকূলবাসীকে রক্ষা করলেও নানান কারণে নিজে ভালো নেই। ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী রক্ষায় ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিম গঠিত হয়। বন বিভাগের পক্ষ থেকে ঐ টিম সদস্যদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। 

২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের সর্বশেষ ক্যামেরা ট্রাকিং জরিপ থেকে জানা গেছে, সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বর্তমান বাঘের ১১৪টি। ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিম সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হলে, এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতে পারতো।

জানা যায়, সুন্দরবনে পরিবেশবান্ধব সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন এক প্রকল্প সম্পূর্ণ সরকারি অর্থে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এর মাধ্যমে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে করমজল, কটকা, কচিখালী, দুবলা, হারবাড়িয়া, কলাগাছিয়ার উন্নয়নসহ পাশাপাশি নতুন চারটি পরিবেশবান্ধব পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলা হচ্ছে। এই নতুন চারটি পর্যটনকেন্দ্র (ইকোট্যুরিজম) হচ্ছে আন্দারমানিক, আলীবান্দা, কালাবগি ও শেখেরটেক। এই প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে ২৮ কোটি ৬৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা। ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। এটি শেষ হবে চলতি বছরের ডিসেম্বরে।

এছাড়াও, সুন্দরবনে বর্তমানে তিনটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে সুন্দরবনে পরিবেশবান্ধব সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন প্রকল্প, সুন্দরবন সুরক্ষা প্রকল্প এবং সুন্দরবন বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্প।

পত্রিকান্তরে জানা গেছে, ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি থেকে সুন্দরবন সুরক্ষা প্রকল্প চলমান রয়েছে। এই প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে, ১৫৭ কোটি ৮৭ লাখ ৫১ হাজার টাকা। এই প্রকল্পের প্রধান কাজ হচ্ছে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে বন বিভাগের ২৮টি নতুন ক্যাম্প ও দুটি রেঞ্জ অফিস নির্মাণ। এছাড়া সুন্দরবনের আশপাশের লোকালয়ে বন বিভাগের যেসব জায়গা রয়েছে, সেখানে সামাজিক ও ম্যানগ্রোভ বনায়ন করা। এই বনায়ন থেকে স্থানীয় মানুষের জ্বালানিসহ কাঠের চাহিদা পূরণ হবে। ফলে সুন্দরবনের কাঠ কাটা বন্ধ হবে। পাশাপাশি সুন্দরবনের ভরাট হয়ে যাওয়া ভোলা ও আড়ুয়াবেড় নদী এবং ভুরা ও খরমা খাল পুনর্খনন করা হবে। এর পাশাপাশি সুন্দরবনকেন্দ্রিক কিছু গবেষণা ও জরিপকাজ এই প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

সুন্দরবনে বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্প চলমান রয়েছে ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে। এই প্রকল্প ২০২৫ এর মার্চে শেষ হবে। এই প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে ৩৫ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। এই প্রকল্পের আওতায় সুন্দরবনের বাঘশুমারি করা হচ্ছে। সুন্দরবন বন বিভাগের পক্ষ থেকে ধারণা করা হচ্ছে, প্রকল্প তিনটি বাস্তবায়িত হলে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য, সুন্দরীগাছের আগামরা রোগের কারণ এবং সুন্দরবনে ধারণক্ষমতা অনুযায়ী বাঘ, হরিণ, শূকর, বানরসহ প্রাণিকুলের জীবনচক্র ও জলজ সম্পদ সম্পর্কে বিস্তারিত জানা সম্ভব হবে।

গত বছর সুন্দরবন দিবসের প্রাক্কালে সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেছিলেন, সুন্দরবন একটি বিশাল সম্পদের আধার। এই বনের ৩৩ শতাংশই জলাভূমি। শুধু সুন্দরবনের উপরিভাগ নয়, সুন্দরবনের জলাভূমিতেও রয়েছে বিশাল জলজ সম্পদ, যার অধিকাংশই রয়েছে আমাদের অজানা। তবে বর্তমানে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ও জলজ সম্পদ নিয়ে প্রকল্পভিত্তিক ও বিদেশি অনুদানে কিছু গবেষণা হচ্ছে। সুন্দরবন একাডেমির পক্ষ থেকেও সুন্দরবনের ওপর কিছু কিছু গবেষণার কাজ করা হয়। কিন্তু এসব গবেষণা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম।

প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াবহতা থেকে প্রতিনিয়ত আমাদের রক্ষা করে যাচ্ছে সুন্দরবন। গবেষণা অনুযায়ী, সুন্দরবন প্রতি বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করে তিন হাজার কোটি টাকার সম্পদ। আরো চমকপ্রদ তথ্য হচ্ছে; সুন্দরবন বছরে গড়ে প্রায় ১৬ কোটি টন কার্বন ধরে রাখতে সক্ষম, আন্তর্জাতিক বাজারে যার মূল্য পাঁচ থেকে ছয় মিলিয়ন ডলার। 

ইতিহাস বিশ্লেষণে জানা যায়, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সুন্দরবনসহ পুরো বাংলার দায়িত্ব নেয়ার আগে মোগল রাজাদের অধীনে ছিল এই বন। এই কোম্পানি সুন্দরবনের মানচিত্র তৈরি করে। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারত ভাগের সময় এ বনের ছয় হাজার ১৭ কিলোমিটার তৎকালীণ পূর্ব পাকিস্তানে পড়ে, যা বাংলাদেশের সমগ্র বনভূমির ৪৪ শতাংশ। ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে সুন্দরবনে তিনটি অভয়ারণ্য ও ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে তিনটি ডলফিন অভয়ারণ্য প্রতিষ্ঠা করা হয়। 

বরাবর সুন্দরবন আমাদের সাথে মাতৃসুলভ আচরণ করছে। আমফানের আঘাত হানার আগে তার প্রবল শক্তি হ্রাস করে গতিমাত্রা কমিয়ে দিয়েছিল এই সুন্দরবন। সুন্দরবন যে কতবার ঘূর্ণিঝড়সহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে আমাদের রক্ষা করেছে, তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। সুন্দরবন দেশের সব উপকূলকে ইতিহাসের কালাপাহাড়ের মতো আগলে রেখেছে সবসময়। দিয়েছে সুন্দরী, গেওয়াসহ নানা বৃক্ষের মজবুত বেষ্টনী। আর অসংখ্য নদীনালা এখানে বছরের পর বছর ধরে প্রাণী ও সম্পদ রক্ষা করে আসছে। সুন্দরবন নিজে ক্ষতবিক্ষত হয়ে উপকূলবাসীকে রক্ষা করেছে। এ বনের কারণে বিগত পাঁচ-ছয়টি ভয়াবহ ঝড়ের গতিবেগ কমে যায়। ভয়ঙ্কর ঝড় এ বনের উপর আঘাত করার পর দুর্বল হয়ে পড়ে। উপকূল রক্ষায় এ বন তাই ঢাল হিসেবে কাজ করছে। বিশেষ করে ২০০৭ এ ঘূর্ণিঝড় সিডর এবং ২০০৯ এ ঝড় আইলার তাণ্ডব থেকে সুন্দরবন উপকূলবাসীকে রক্ষা করেছে। এ ছাড়া ঘূর্ণিঝড় বুলবুল ও ফণী থেকেও রক্ষা করেছে সুন্দরবন। 

এই সুন্দরবনকে বাঁচাতে দীর্ঘমেয়াদি তথা টেকসই পরিকল্পনা নিতে হবে। এই কাজে এগিয়ে আসতে হবে সব শ্রেণির মানুষকে। মনে রাখতে হবে, সুন্দরবন বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে। 
লেখক: সাংবাদিক


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান - dainik shiksha সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! - dainik shiksha শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! হিটস্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু লিখিততে প্রক্সি দিয়ে পার, মৌখিক পরীক্ষায় এসে ধরা - dainik shiksha লিখিততে প্রক্সি দিয়ে পার, মৌখিক পরীক্ষায় এসে ধরা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষক কেনো বদলি চান - dainik shiksha শিক্ষক কেনো বদলি চান ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে - dainik shiksha ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0065739154815674