সৃজনশীলতা প্রশ্নপদ্ধতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়

মো. শাহজাহান |

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাক্রম নতুনভাবে ঢেলে সাজানো হয়েছে। এতে শিক্ষার বহুবিধ উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এসব উদ্দেশ্য মূলত আগামী প্রজন্মকে উপযুক্ত ও দক্ষ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। এটা মাথায় রেখে শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের নানাবিধ গুণ বা যোগ্যতার বিকাশ সাধনের লক্ষ্যে অনেক বিষয়েরই পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। যুগের চাহিদা ও বৈশ্বিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে নতুন কিছু বিষয় সংযোজন করা হয়েছে। প্রতিটি শ্রেণির পঠনপাঠন কার্যক্রমের মাধ্যমে যেসব যোগ্যতা অর্জিত হবে বলে প্রত্যাশা করা হয়েছে, এর মধ্যে সৃজনশীলতা অন্যতম। প্রশ্ন হচ্ছে, সৃজনশীলতা বিকাশের প্রক্রিয়াটি কী এবং সে প্রক্রিয়ায় কী কী কার্যাবলি সম্পাদনের জন্য শিক্ষাক্রমে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে?

প্রথমে শ্রেণিশিক্ষকের পাঠদানের জন্য একটি পাঠপরিকল্পনা তৈরির কথা বলা আছে। ওই পাঠপরিকল্পনায় শিক্ষক অংশগ্রহণমূলক বা মিথস্ক্রিয়াভিত্তিক পাঠদানপদ্ধতি প্রয়োগের পাশাপাশি বিভিন্ন কাজের ব্যবস্থা করবেন। তিনি শ্রেণিকক্ষে কোনো বিষয় উপস্থাপন করার পর শিক্ষার্থীদের বাস্তব কোনো ঘটনা বা সমস্যা দেখিয়ে এর সঙ্গে শ্রেণির পাঠের অভিজ্ঞতার সংযোগ ঘটানোর চেষ্টা করবেন। তাতে শিক্ষার্থীরা পাঠগ্রহণের অভিজ্ঞতা এবং নিজেদের বুদ্ধিমত্তা খাটিয়ে ঘটনার প্রকৃতি চিহ্নিত করবে, ঘটনাটি জীবনের সঙ্গে কতটা যুক্ত বা প্রাসঙ্গিক, তা খুঁজে বের করবে, সমস্যার ক্ষেত্রে সমস্যার ধরন, আর সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় চিহ্নিত করবে। শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সহায়তা দেবেন। শিক্ষার্থীরা এ পাঠের প্রত্যাশিত শিখনযোগ্যতা কতটা অর্জন করল, তা যাচাই করার জন্য মৌখিক বা লিখিত প্রশ্ন করবেন, উত্তর জানার এবং সবশেষে শিক্ষার্থীদের দুর্বলতা চিহ্নিত করে তা নিরসনের ব্যবস্থা নেবেন।

অর্থাৎ শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতা বিকাশের মূল দায়িত্ব শ্রেণিকক্ষে পাঠদানকারী শিক্ষকের। এ জন্য মানসম্পন্ন পাঠ্যপুস্তক দরকার। পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও সরবরাহ করবে এনসিটিবি। সংশ্লিষ্ট বিষয়ের পাঠ্যপুস্তক যদি শিক্ষকের কাছে সহায়ক বলে মনে না হয়, বিশেষ করে পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু জীবনঘনিষ্ঠ না হয়, অনুশীলনী অংশে বুদ্ধিমত্তা পরিমাপে এবং শিক্ষার্থীদের মেধা অনুসারে সফলভাবে বিভাজনের উপযুক্ত প্রশ্নাবলি না থাকে, তাহলে এ ধরনের ঘাটতি পূরণে শিক্ষকের বাড়তি প্রয়াস জরুরি হয়ে পড়ে। এ জরুরি প্রয়োজনটাকে শিক্ষক যদি আমলে না নেন, তাহলে সেটা বোঝা এবং বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া দুঃসাধ্য। অবশ্য প্রতিষ্ঠানপ্রধান তৎপর হলে তিনি বা তাঁর প্রতিনিধির মাধ্যমে ক্লাস মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা জোরদার করে এ অপূর্ণতা দূর করতে পারেন।

শ্রেণিকক্ষের কাজের ধারাবাহিকতায় শিক্ষার্থীদের বাড়ির কাজ দেওয়া হয়। বাড়ির কাজ যেমন শিক্ষার্থীদের কাছে বোঝা মনে না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। পাঠ্যবই দেখে দেখে যাতে লিখতে না পারে কিংবা নিজে না করে অন্যকে দিয়ে করিয়ে আনতে না পারে, এমন সাবধানতা অবলম্বন করে বাড়ির কাজ দিতে হবে এবং তা আদায় করতে হবে। অতঃপর বাড়ির কাজ সযত্নে মূল্যায়ন করে

নম্বর দেওয়া ও সংরক্ষণের প্রতি গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে। শ্রেণিকক্ষে পাঠদান, শ্রেণিকক্ষের কাজ, বাড়ির কাজ ছাড়াও শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা বিকাশের প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে শ্রেণি অভীক্ষা বা অগ্রগতি অভীক্ষা গৃহীত হওয়ার কথা। যেসব প্রশ্ন-আইটেম এ অভীক্ষায় ব্যবহৃত হয়, তা অনেকাংশে সৃজনশীলতা বিকাশে সহায়ক নয়।

একাধিক বছর পেরিয়ে যখন শিক্ষার্থীরা শিক্ষার কোনো একটা স্তরের শেষ প্রান্তে উপনীত হয়, তখন স্তর সমাপনী পরীক্ষায় (যেমন পিইসি/ইবতেদায়ি সমাপনী, জেএসসি/জেডিসি, এসএসসি/দাখিল, এইচএসসি/ আলিম) অংশ নিয়ে থাকে। এসব পরীক্ষা কোনোটি যোগ্যতাভিত্তিক প্রশ্নপত্রে আবার কোনোটি সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতিতে গৃহীত হয়।

যোগ্যতাভিত্তিক অভীক্ষাপদ কিংবা সৃজনশীল প্রশ্ন-আইটেম তৈরি পেশাদারি কাজ। শিক্ষাক্রমে বর্ণিত সংশ্লিষ্ট বিষয়ের পাঠ বা অধ্যায়ের প্রত্যাশিত শিখনযোগ্যতা বা শিখনফল বিবেচনায় নিয়ে এবং জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে দক্ষতার বিভিন্ন স্তরে সজ্জিত করে প্রশ্ন-আইটেম তৈরি করতে হয়। এর সঙ্গে শিক্ষার্থীদের শ্রেণি ও বয়সভেদে প্রশ্ন-আইটেমের কাঠামোর স্তর, ভাষাগত বিন্যাস সাধন

করতে হয়। এ ক্ষেত্রে কোনো ব্যত্যয় ঘটলে দুর্বল প্রশ্ন-আইটেম তৈরি হবে এবং শিক্ষার্থীদের অন্য গুণাবলির পাশাপাশি সৃজনশীল

গুণাবলিও বিকশিত হলো কি না, সেটার মূল্যায়ন বাধাগ্রস্ত হবে।

প্রশ্ন-আইটেম সঠিকভাবে করার পরের পর্বটি হচ্ছে প্রণীত প্রশ্ন-আইটেম ব্যবহার করে পরীক্ষা গ্রহণ করা। পরীক্ষার হল এখানে গুরুত্ব পাবে। শিক্ষার্থীর নকলমুক্ত পরিবেশে সুষ্ঠুভাবে পরীক্ষা দিতে পারা নিশ্চিত করতে হবে। এরপর উত্তরপত্র মূল্যায়ন; নম্বর প্রদানের ক্ষেত্রে যথাযথ মানদণ্ড অনুসরণ করতে হবে। উত্তরপত্র মূল্যায়নকারীকে সব ধরনের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে হবে।

শিক্ষার্থীদের শিখনযোগ্যতা, বিশেষ করে সৃজনশীলতার বিকাশ অনেকগুলো পক্ষ ও উপাদানের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। যথা মানসম্পন্ন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি, শ্রেণি-উপযোগী ও শিক্ষার্থীবান্ধব পাঠ্যপুস্তক, শিক্ষক-সহায়িকা, সহায়ক পাঠসামগ্রী, প্রশ্নপত্র ইত্যাদি। শ্রেণিশিক্ষক, প্রতিষ্ঠানপ্রধান বা পরিদর্শক বা একাডেমিক সুপারভাইজর, প্রশ্নপ্রণেতা ও মডারেটর, শিক্ষক-প্রশিক্ষক, পরীক্ষক ও প্রধান পরীক্ষক, পরীক্ষার কক্ষের পর্যবেক্ষকসহ আরও অনেকে এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। এমন অবস্থায় সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবই পড়া থেকে বিমুখ করছে কিংবা গাইড ও নোটবইয়ের ওপর তাদের নির্ভরশীলতা বাড়াচ্ছে—এমন অভিযোগ করা সমীচীন নয়।

শিক্ষার্থীদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ও সমস্যা সমাধান করার দক্ষতা অর্জনসহ সামগ্রিক সৃজনশীলতা বিকাশের আয়োজন সফল হতে পারে এই প্রক্রিয়ায় নিয়োজিত সব পক্ষের দায়িত্ব সক্রিয়ভাবে ও আন্তরিকতার সঙ্গে পালনের মধ্য দিয়ে। তবে শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতা বিকাশের প্রক্রিয়ায় মূল নায়ক শ্রেণিকক্ষে পাঠদানকারী শিক্ষক। তাঁর কার্যক্রম সক্রিয়, সৃজনশীল ও গতিময় হওয়া দরকার।

মো. শাহজাহান: সাবেক বিশেষজ্ঞ, এনসিটিবি।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
রোববার থেকে সরকারি প্রাথমিকে মর্নিং স্কুল, খোলার প্রজ্ঞাপন জারি - dainik shiksha রোববার থেকে সরকারি প্রাথমিকে মর্নিং স্কুল, খোলার প্রজ্ঞাপন জারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে - dainik shiksha প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের গরমে কলেজে কোচিং, দুদিনে অসুস্থ ৮ ছাত্রী - dainik shiksha গরমে কলেজে কোচিং, দুদিনে অসুস্থ ৮ ছাত্রী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে নিবন্ধিত শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসির নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha নিবন্ধিত শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসির নতুন নির্দেশনা দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে জাল সনদে চাকরি করছে কয়েক হাজার হেলথ টেকনোলজিস্ট - dainik shiksha জাল সনদে চাকরি করছে কয়েক হাজার হেলথ টেকনোলজিস্ট ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক নেতা কাওছার শেখ - dainik shiksha আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক নেতা কাওছার শেখ please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0066139698028564