সোয়া চার লাখ ভগ্নহৃদয়ের জন্য

দৈনিক শিক্ষা ডেস্ক |

‘তুমি কেরানির চেয়ে বড়, ডেপুটি-মুন্সেফের চেয়ে বড়, তুমি যাহা শিক্ষা করিতেছ তাহা হাউইয়ের মতো কোনোক্রমে ইস্কুলমাস্টারি পর্যন্ত উড়িয়া তাহার পর পেন্সনভোগী জরাজীর্ণতার মধ্যে ছাই হইয়া মাটিতে আসিয়া পড়িবার জন্য নহে, এই মন্ত্রটি জপ করিতে দেওয়ার শিক্ষাই আমাদের দেশে সকলের চেয়ে প্রয়োজনীয় শিক্ষা, এই কথাটা আমাদের নিশিদিন মনে রাখিতে হইবে। এইটে বুঝিতে না পারার মূঢ়তাই আমাদের সকলের চেয়ে বড় মূঢ়তা। আমাদের সমাজে এ কথা আমাদিগকে বোঝায় না, আমাদের স্কুলেও এ শিক্ষা নাই।’ 

-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

প্রতিবছর পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল যেদিন প্রকাশিত হয়, সেদিন আমার বুকটা ভেঙে যায়। আমি জানি না পৃথিবীর আর কোথায়, কোন পাবলিক পরীক্ষায় ১০০ জনের মধ্যে ৩৩ জন পাস করতে না পারা লোকে স্বাভাবিকভাবে নেয়। ভাবটা এমন, ৩ জনে ১ জনের তো ফেল করারই কথা!

১২ জুলাই এবারের আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের আহমেদ জাওয়াদ চৌধুরী প্রথমবারের মতো স্বর্ণপদক পেয়েছে। দেশে ফেরার পর থেকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছার স্রোতে ভাসছে দলের সদস্যরা। উপদলনেতা হিসেবে তার ছিটেফোঁটা আমার কপালেও জুটছে। তাই আনন্দের সাগরেই ছিলাম। বৃহস্পতিবার এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর আমার মনের পর্দায় ভেসে উঠল হতাশ একদল ছেলেমেয়ের ছবি। প্রথম আলোর ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখলাম, তাদের সংখ্যা নেহাত কম নয়। সব বিভাগ মিলে মোট ১২ লাখ ৮৮ হাজার ৭৫৬ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে উত্তীর্ণ হয়েছে ৮ লাখ ৫৮ হাজার ৮০১ জন। অর্থাৎ ৪ লাখ ২৯ হাজার ৯৫৫ জন শিক্ষার্থী উচ্চমাধ্যমিকের চৌকাঠ পেরোতে পারল না। এটা মোটেই ছোট কোনো সংখ্যা নয়। উইকিপিডিয়া বলছে, বিশ্বে ২৩৬টি দেশ ও অঞ্চল আছে। এর মধ্যে ৬৩ টির জনসংখ্যা সোয়া চার লাখের কম।

এই যে একটা পাবলিক পরীক্ষা, যার সাফল্য ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করে, সেটিতে প্রতি তিনজনে একজন ফেল করে কীভাবে? কারণটা কী? কারণগুলো কি আমরা কখনো খতিয়ে দেখেছি?

২০০৯ সালে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করে যুগোপযোগী একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু সেই নীতি মাঠে থাকা সত্ত্বেও কে বা কারা পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ওপর প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা চাপিয়ে দেয়। ২০১০ সাল থেকে অষ্টম শ্রেণিতেও জুনিয়র সার্টিফিকেট পরীক্ষা নামে আরেকটি পাবলিক পরীক্ষা শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে বাংলাদেশ বিশ্বের একমাত্র দেশে পরিণত হয়েছে, যেখানে ১২ বছরের শিক্ষাজীবনে শিক্ষার্থীদের চার-চারটি পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়। এভাবে আমাদের সম্পূর্ণ শিক্ষা হয়ে পড়েছে পরীক্ষামুখী, জিপিএ-৫ অন্বেষী। শিক্ষার্থীরা সবাই পরিণত হয়েছে পরীক্ষার্থীতে। আর আমাদের পরীক্ষাপদ্ধতি এমন যে এখানে সৃজনশীল শিক্ষার্থীদের কপাল প্রায়ই পোড়ে। কারণ, এই পদ্ধতি এখনো গণিতের সমস্যা সমাধানে মুখস্থবিদ্যাকেই উপজীব্য করে রেখেছে। পড়ানোর কথা বাদই দিলাম। অবকাঠামোর কথাও বরং থাক।

আমাদের সবচেয়ে বড় বোকামি হয়ে যাচ্ছে, আমরা আমাদের সব ছেলেমেয়েকেই সাধারণ শিক্ষা, কেরানি বানানোর শিক্ষাতে আটকে রাখতে চাই। ফলে আমাদের শিক্ষার্থীদের, যাদের অন্য অনেক কিছু করার সামর্থ্য আছে, তাদেরও রাত জেগে মোগল সাম্রাজ্যের সীমানা মুখস্থ করতে হয়। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের আবির্ভাবের ফলে বিশ্বজুড়ে কারিগরি শিক্ষার প্রসারে এখন জাতিগুলো মনোযোগী হয়েছে। বিস্তার ঘটছে এসব বিষয়ের বৈশ্বিক সনদের, যার মূল্যও বাড়ছে। সাধারণ শিক্ষার প্রতি আগ্রহী এসব তরুণ শেষ পর্যন্ত একটি চাকরির জন্য হাপিত্যেশ করতে থাকে।

এ প্রসঙ্গে কয়েক বছর আগের একটি অভিজ্ঞতার কথা বলা যায়। সে সময় সিঙ্গাপুরে জাহাজশিল্পে গিয়ে আমাদের ঝালাইকরদের (ওয়েল্ডার) দুরবস্থা দেখেছি। হাতের কাজে অন্য দেশের কর্মীর চেয়ে বেশি দক্ষ হওয়া সত্ত্বেও তাদের মাসিক মজুরি কম। জানতে পারলাম, অন্য দেশের কর্মীরা একটি আন্তর্জাতিক সনদ নিয়ে এসে এ কাজে যোগ দিয়েছে। কিন্তু আমাদের ভাইটি কাজ শিখেই সেখানে পাড়ি দিয়েছে। জানলাম, ওই সনদের পরীক্ষা বাংলাদেশে দেওয়া যায় না এবং সেটির ফিও ২০ হাজার টাকার মতো। সঙ্গে সিঙ্গাপুরে যাতায়াত আর থাকা-খাওয়ার খরচও আছে। ফলে আমাদের কর্মীদের আগ্রহ থাকে না। অন্যদিকে ভারত সরকার নিজে উদ্যোগী হয়ে ওই সনদ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানকে নিজ দেশে নিয়ে যায় এবং যেসব শ্রমিক ওই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারে, তাদের পরীক্ষার ফিও সরকার দেয়। ফলে তাদের মধ্যে ওই বৈশ্বিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ রয়েছে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে রাজমিস্ত্রিদের জন্য আন্তর্জাতিক সনদের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। লারসেন অ্যান্ড টারবোর মতো বৈশ্বিক সংস্থার সঙ্গে বৈদ্যুতিক কর্মীদের আন্তর্জাতিক সনদের ব্যবস্থা তো ওদের অনেক দিন ধরেই আছে। এসবের মাধ্যমে ২০২২ সালের বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে কাতারে যেসব নতুন স্থাপনা তৈরি করা হচ্ছে, সেখানকার কর্মী নিয়োগে আমাদের কর্মীরা দারুণভাবে মার খেয়ে গেছে। ইউরোপে যে নতুন প্রযুক্তিভিত্তিক কর্মিবাজার এখন উন্মুক্ত হচ্ছে, সেখানেও আমাদের এ অবস্থা হবে। কারণ, বিশ্ববাজারে দক্ষ কর্মীর চাহিদা ক্রমান্বয়ে বাড়বে, অদক্ষ শ্রমিকের চাহিদা কমবে। আর কেরানির কাজগুলো রোবটই করে ফেলবে।

শুধু বিশ্ববাজার নয়, আমাদের পোশাকশিল্পেও এখন একটি গুণগত পরিবর্তন সূচিত হয়েছে, স্বয়ংক্রিয়করণ বা অটোমেশন। এ শিল্পের জন্য কি আমরা লোক তৈরি করছি?

২০০৯ সালের শিক্ষানীতির মূল দর্শন মেনে নিয়ে আমাদের দ্রুত অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা দরকার। তারপর শিক্ষাকে সাধারণ ও কারিগরি শিক্ষায় ভাগ করে যার যেদিকে আগ্রহ, সেদিকে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। নতুবা এই মন খারাপ করা পরিসংখ্যান দেখে যেতেই হবে। পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের দিনে যেন মন খারাপ না হয়, তার জন্য দরকার শিক্ষাব্যবস্থার গোড়ার দিকে নজর দেওয়া। সে জন্য বিদেশি বিশেষজ্ঞের দরকার নেই। আমাদের শিক্ষা-গবেষকেরাই এই সমস্যার সমাধান করতে পারেন। তাঁদের কথা শুনলেই কাজটা অনেক সহজ হয়ে যাবে।

সৃজনশীল মুখস্থ পদ্ধতির এইচএসসি অনুত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের আগামী দিনের সাফল্য কামনা করি। যারা উত্তীর্ণ হয়েছে, তাদের অভিনন্দন।

মুনির হাসান: বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সাধারণ সম্পাদক

সূত্র:প্রথম আলো


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান - dainik shiksha সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! - dainik shiksha শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! হিটস্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু লিখিততে প্রক্সি দিয়ে পার, মৌখিক পরীক্ষায় এসে ধরা - dainik shiksha লিখিততে প্রক্সি দিয়ে পার, মৌখিক পরীক্ষায় এসে ধরা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষক কেনো বদলি চান - dainik shiksha শিক্ষক কেনো বদলি চান ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে - dainik shiksha ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0044140815734863