স্কাউটের আড়ালে শিক্ষাঙ্গনে রাজনৈতিক কার্যক্রম চালাচ্ছে জামায়াত-শিবির

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

দেশে স্কাউটিংয়ের নামে জামায়াত- শিবির ঘরানার একদল শিক্ষক সক্রিয় আছেন। তারা স্কাউট লিডার হিসেবে প্রশিক্ষণ নেন। পরে রোভার লিডার বা স্কাউট লিডার হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিবির সমর্থিত শিক্ষার্থীদের সংগঠিত করেন। পাশাপাশি সাধারণ শিক্ষার্থীদেরও ওই  সংগঠনে টেনে নিজেদের আদর্শে দীক্ষিত করার চেষ্টা চালান। এভাবে নানা কৌশলে বাংলাদেশ স্কাউটস সমিতির সব শাখায় জামায়াত-শিবির ঢুকে পড়েছে। বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও মাদরাসা থেকে বিতাড়িত জামায়াত- শিবির এখন অরাজনৈতিক এই স্কাউট সংগঠনের আড়ালে শিক্ষাঙ্গনে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাচ্ছে। বৃহস্পতিবার (১ জুন) দৈনিক কালবেলা পত্রিকায় প্রকাশিত এক পতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন রশীদ মামুন।

প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, অভিযোগ রয়েছে, জামায়াত-শিবিরের সবে সঙ্গে সম্পৃক্ত একাধিক ব্যক্তি নানা কৌশলে চট্টগ্রাম জেলা রোভার ইস স্কাউটে শিকড় গেড়ে আছেন দীর্ঘদিন। ২০২০ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে এ বিষয়ে প্রি লিখিত অভিযোগ করেছিলেন চট্টগ্রাম জেলা স্কাউটস রোভার কমিটির কয়েকজন কর্মকর্তা। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ৪ নভেম্বর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। যথাসময়ে তদন্ত প্রতিবেদনও জমা পড়ে।

বলে বিষয়টি নিয়ে ২০২১ সালের ২৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্কাউটস রোভার অঞ্চলের কমিশনার এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের তৎকালীন মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক একটি চিঠি দেন।

পদাধিকারবলে চট্টগ্রাম জেলা রোভার সভাপতি ওই সময়ের জেলা প্রশাসককে। চিঠিতে বলা হয়, 'তদন্ত কমিটি সরেজমিন অভিযোগকারী ও সংশ্লিষ্টদের সাক্ষ্য গ্রহণ এবং

কাগজপত্রাদি পর্যালোচনা করে একটি প্রতিবেদন জমা দেয়। ওই প্রতিবেদনে নিষিদ্ধ ঘোষিত রাজনৈতিক দলের (জামায়াত-শিবির) সঙ্গে কমিটির দায়িত্বে থাকা কয়েকজনের সম্পৃক্ত থাকার প্রমাণ মিলেছে। ড. গোলাম ফারুক ওই চিঠিতে আরও লিখেছেন, 'বাংলাদেশ স্কাউটস একটি অরাজনৈতিক সেবামূলক সংস্থা। নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা ব্যক্তিদের জেলা রোভারের কমিটিতে অন্তর্ভুক্তি আইন ও গঠনতন্ত্রের পরিপন্থি। অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে জড়িতদের অপসারণসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ করা হলেও অজ্ঞাত কারণে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। যাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছিল, তাদের মধ্যে মো. ফজলু কাদের চৌধুরী, অধ্যাপক জসিম উদ্দিন খান, এস এম হাবিবুল্লাহ হিরু অন্যতম। ফজলুল কাদের বর্তমানে সাতকানিয়া সরকারি কলেজের অধ্যাপক। জসিম উদ্দিন বাকলিয়া সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ। আর রাউজান কলেজের আইসিটি বিভাগের সাবেক শিক্ষক এস এম হাবিবুল্লাহ হিরু ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে অশালীন আচরণ, পোশাক নিয়ে কটূক্তি এবং জামায়াত-শিবিরের এজেন্ডা বাস্তবায়নসহ নানা অভিযোগে চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন। তবু তিনি স্কাউটসের সঙ্গে আছেন কৌশলে। হিরু চট্টগ্রাম কলেজে ছাত্রশিবিরের সাথী ছিলেন। মাউশি অধিদপ্তর কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান এবং চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও সচিব অধ্যাপক আবদুল আলীম বলেন, 'তদন্তে একাধিকজনের বিরুদ্ধে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে। স্কাউটিং কার্যক্রমে তাদের নানা ছলচাতুরী ও দুর্নীতির অভিযোগ =প্রমাণিত। তাদের কমিটির বৈঠকে হাজির হয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য বলা হলেও কেউ সাড়া দেননি। উল্টো গঠনতন্ত্রপরিপন্থি কার্যকলাপের মাধ্যমে গ্রুপিং সৃষ্টি করে চলছেন। শোনা যাচ্ছে, তারা সংগঠনের একপক্ষীয় কাউন্সিল করার উদ্যোগ নিয়েছেন।

পদাধিকারবলে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বর্তমানে জেলা স্কাউটস রোভার অঞ্চলের সভাপতির দায়িত্বে আছেন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'মাউশি অধিদপ্তরের আগের চিঠির কার্যকারিতা এখন আর নেই। তৎকালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক বিষয়টি নিয়ে ওই সময় কেন ব্যবস্থা নেননি, তা জানি না। নতুন করে অভিযোগ পেলে যদি ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার আমার থাকে, তাহলে অবশ্যই বিধিমতে ব্যবস্থা নেব।' অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মো. আবদুল মালেক বলেন, 'এ বিষয়ে সম্প্রতি আমরা একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। যথাযথ প্রমাণ পেলে আইন ও বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রায় দুই যুগ ধরে স্কাউটসের সঙ্গে আছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ স্কাউটস চট্টগ্রাম জেলা রোভারের অধীন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রুপ সম্পাদক। জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'জামায়াত-শিবির এখন সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে অনেকটা কোণঠাসা। ওই দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত একাধিক ব্যক্তি চট্টগ্রামে স্কাউটসের নানা পর্যায়ে আছেন বহু দিন। তারা স্বেচ্ছাসেবী এই সংস্থাকে ব্যবহার করে নিষিদ্ধ ঘোষিত দলটির নেতাকর্মীদের কৌশলে সংগঠিত করছেন। তাদের খুঁজে বের করে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাকা (সালাউদ্দিন কাদের) চৌধুরীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান সাক্ষী এবং ভছে জামায়াত-শিবির! যুদ্ধকালীন গেরিলা কমান্ডার সিরু বাঙালি বলেন, শিক্ষাঙ্গনে এখন জামায়াত-শিবিরের তৎপরতা চলছে ভিন্নরূপে। স্কাউটস কার্যক্রমের আড়ালে তাদের সংগঠিত হওয়ার বিষয়টি সত্য। আমার পর্যবেক্ষণেও বিষয়টি ধরা পড়েছে। একাধিক তথ্য-প্রমাণও আছে। শুধু রোভার স্কাউট নয়, গার্লস গাইড ও রেড ক্রিসেন্টের মতো স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে তারা ঢুকে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করছে।' ২০১৮ সালে ফজলুল কাদের চৌধুরী রোভার স্কাউটসের দায়িত্ব পাওয়ার পর এর প্রতিবাদ জানিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন তৎকালীন চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আবু তৈয়ব। জানতে চাইলে বর্তমানে উত্তর জেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আৰু তৈয়ব বলেন, 'ফজলুল কাদের চৌধুরী জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। তিনি আমাদের একাধিক নেতাকর্মী হত্যা মামলার আসামি।” চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের এক জ্যেষ্ঠ নেতা জানান, ফজলুল কাদের চৌধুরী ছাত্রশিবিরের ক্যাডার ছিলেন। তার বাড়ি চট্টগ্রামের হাটহাজারীর ধলই ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডে। উচ্চ মাধ্যমিক পড়েছেন নাজিরহাট কলেজে। কলেজে পড়া অবস্থায় শিবিরের নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে তার সম্পৃক্ততা ছিল। ওই সময় তিনি চার থেকে পাঁচটি হত্যাসহ এক ডজন মামলার আসামি ছিলেন। তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা এখনো বিচারাধীন। নাজিরহাট কলেজে তার একাধিক সহপাঠী বলেন, ফজলুল কাদের ১৯৮৮ সালের ৬ এপ্রিল ক্যাম্পাসে নাজিরহাট কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি আমিনুল করিম জাহাঙ্গীর ও ক্রীড়া সম্পাদক রশিদুল আলম রুবেল হত্যা মামলার অন্যতম আসামি। এ ছাড়া নব্বইয়ের দশকে হাটহাজারীর ফরহাদাবাদে জব্বারহাটে সংঘটিত ট্রিপল মার্ডার মামলার আসামি ছিলেন। জব্বারহাটে সেদিন ধলই গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও উত্তর জেলা ছাত্রলীগ নেতা কাজী আহমদ নেওয়াজ শ্যামল, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ক্রীড়াবিদ দিদারুল আলম এবং ফটিকছড়ির বাবুনগরের বাসিন্দা জাফর আলম শিবির ক্যাডারদের হাতে নির্মমভাবে প্রাণ হারান।

জানা গেছে, জামায়াত-শিবির ক্যাডার ফজলুল কাদের প্রায় ২৫ বছর ধরে স্কাউটসের সঙ্গে জড়িত আছেন সুকৌশলে। ২০১৮ সালে তৎকালীন সিটি কলেজের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক ফজলুল কাদের চট্টগ্রাম রোভার স্কাউটসের দায়িত্ব পাওয়ায় এর তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়ে নানা কর্মসূচি পালন করে নগরের বিভিন্ন কলেজ শাখা ছাত্রলীগ। স্কাউটিংয়ের নামে জামায়াত-শিবির কর্মীদের সংগঠিত করছেন অভিযোগ করে একপর্যায়ে ফজলুলের শাস্তি দাবি করে কলেজে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়। এমন পরিস্থিতিতে সিটি কলেজ থেকে বদলি হয়ে সাতকানিয়া কলেজে চলে যান তিনি; কিন্তু বহাল তবিয়তে আছেন স্কাউট কার্যক্রমে। সাতকানিয়া সরকারি কলেজের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, 'এসব মিথ্যা ও অপপ্রচার। আমি একজন সরকারি কর্মকর্তা। কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার সুযোগ নেই। আমার বিরুদ্ধে মামলা থাকার বিষয়টিও ভিত্তিহীন।' স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে ১৯৭২ সালের ৮ এপ্রিল নবউদ্যমে কার্যক্রম শুরু করে 'বাংলাদেশ স্কাউটস'। আর বঙ্গবন্ধুর প্রচেষ্টায় ১৯৭৪ সালে বিশ্ব স্কাউটস সংস্থার ১০৫তম সদস্য হিসেবে স্বীকৃতি পায় ‘বাংলাদেশ স্কাউটস সমিতি'। তাই দেশে স্কাউটিংয়ের সূচনা দিবস হিসেবে ২০২২ সাল থেকে প্রতিবছর ৮ এপ্রিল বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস উদযাপন করা হয়। অভিযোগ অস্বীকার করে অধ্যাপক জসিম উদ্দিন খান বলেন, ‘এসব আমার বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র। আমি শিক্ষক মানুষ। রাজনীতি করি না।' রাউজান কলেজ থেকে চাকরিচ্যুতি প্রসঙ্গে এস এম হাবিবুল্লাহ হিরু বলেন, 'আমি ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলাম।'


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
হামলায় মোল্লা কলেজের ৩ শিক্ষার্থী নিহত, দাবি কর্তৃপক্ষের - dainik shiksha হামলায় মোল্লা কলেজের ৩ শিক্ষার্থী নিহত, দাবি কর্তৃপক্ষের সাত কলেজের অনার্স ৪র্থ বর্ষের পরীক্ষা স্থগিত - dainik shiksha সাত কলেজের অনার্স ৪র্থ বর্ষের পরীক্ষা স্থগিত নৈরাজ্যকারীদের প্রতিহত করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধান কাজ: সারজিস - dainik shiksha নৈরাজ্যকারীদের প্রতিহত করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধান কাজ: সারজিস মিনিস্ট্রি অডিটরদের গরুর দড়িতে বাঁধবেন শিক্ষকরা! - dainik shiksha মিনিস্ট্রি অডিটরদের গরুর দড়িতে বাঁধবেন শিক্ষকরা! সোহরাওয়ার্দী কলেজ বন্ধ ঘোষণা - dainik shiksha সোহরাওয়ার্দী কলেজ বন্ধ ঘোষণা সাত কলেজের অনার্স ৪র্থ বর্ষের পরীক্ষা স্থগিত - dainik shiksha সাত কলেজের অনার্স ৪র্থ বর্ষের পরীক্ষা স্থগিত কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে অনতিবিলম্বে প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় এমপিওভুক্ত করতে হবে: নুর - dainik shiksha অনতিবিলম্বে প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় এমপিওভুক্ত করতে হবে: নুর কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0033690929412842