স্কুলকে বাড়ির মতো ব্যবহার করছেন প্রধান শিক্ষক

রংপুর প্রতিনিধি |

রংপুরের গঙ্গাচড়া উত্তর খলেয়া পন্ডিতপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পরিমল কুমার কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে স্কুলটিকে বাড়ির মতো ব্যবহার করা করে আসছেন। যখন ইচ্ছে তখন আসেন-যান। ক্লাসে বা অফিস কক্ষে বসে ঘুমান তিনি। কখনো কখনো স্যান্ডো গেঞ্জি পরেই আসেন স্কুলে। আবার কখনো শ্রেণিকক্ষে তার রাখা ধান-চালের বস্তার মধ্যেই চলে ক্লাস। এ ছাড়া অর্থ আত্মসাৎসহ বিস্তর অভিযোগ উঠেছে পরিমল কুমারের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন মনিরুল ইসলাম নামে এক অভিভাবক সদস্য।

লিখিত অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, বিদ্যালয়টি ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে স্থাপিত। ২০১২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত রেজি. প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে পরিচালিত হয়। ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে বিদ্যালয়টি জাতীয়করণ হয়। বর্তমানে স্কুলে প্রধান শিক্ষকসহ পাঁচজন শিক্ষক রয়েছেন। কাগজে-কলমে শিশু থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৭৬ জন। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা থেকেই পরিমল প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তখন থেকে প্রধান শিক্ষক পারিবারিকভাবে ম্যানেজিং কমিটি গঠন করে বিদ্যালয়ের সিøপ বিভিন্ন বরাদ্দের অর্থ আত্মসাৎ করে আসছেন। ভুয়া নাম দিয়ে উপবৃত্তির টাকা তুলেছেন। এ ছাড়াও প্রধান শিক্ষক স্কুলের ল্যাপটপ ও প্রজেক্টর বাড়িতে নিয়ে ভাড়া দেন। নিয়মিত স্কুলে আসেন না। কখনো কখনো শরীরে পোশাক ছাড়াই লুঙ্গি পরে স্কুলে আসেন। মাঝেমধ্যে মাঠে চড়ান গরু। স্কুলের কক্ষে রাখেন ধানের বস্তা।

এ ছাড়াও স্কুলে সিলিং ফ্যান ও টিন বাড়িতে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে। তার এমন কর্মকা-ের কিছু ছবি এ প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। সেই ছবিগুলোতে দেখা যায়, প্রধান শিক্ষক পরিমল স্কুলে লুঙ্গি পরে আছেন, অফিস কক্ষে সহকারী শিক্ষকদের সঙ্গে খালি গায়ে চেয়ারে বসে আছেন, টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেছেন, স্যান্ডো গেঞ্জি পরে সহকারী শিক্ষকদের সামনে বসে আছেন, স্কুলের শ্রেণিকক্ষে ধানের বস্তা ঢোকাচ্ছেন, স্কুল মাঠে গরু বাঁধছেন, শ্রেণিকক্ষের বেঞ্চের ওপর স্তূপ করা ধানের বস্তার পাশে বসা শিক্ষার্থীদের পাঠদান করাচ্ছেন।

গত রবিবার দুপুর ৩টার দিকে ওই বিদ্যালয়ে সরেজমিনে গিয়ে ওইসব অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। এ সময় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পরিমলকে স্কুলে পাওয়া যায়নি। সহকারী শিক্ষকরা জানান, প্রধান শিক্ষক অফিশিয়াল কাজের কথা বলে সকাল ১০টায় স্কুল ত্যাগ করেছেন। আর ফেরেননি। প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ ও গায়ে পোশাক ছাড়াই স্কুলে আসার বিষয়ে জানতে চাইলে দুজন সহকারী শিক্ষক বলেন, প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ সবই সত্য। তারা জানান, প্রধান শিক্ষকের বাড়ি স্কুলের সঙ্গে। তাই তিনি প্রায় সময় খালি গায়ে স্কুলে এসে সহকারী শিক্ষকদের তদারকি করেন। মাঝেমধ্যে চেয়ারেই ঘুমিয়ে যান। প্রায় সময় স্কুল সময়ে স্ত্রীকে নিয়ে শ্বশুরবাড়িসহ বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যান।

আরেক সহকারী শিক্ষক অভিযোগ করে বলেন, প্রত্যেক শিক্ষার্থীর উপবৃত্তির কার্ড করে দেওয়ার সময়ে প্রধান শিক্ষক ৫০ থেকে ১০০ টাকা করে নিয়েছেন। তিনি ২০১৫ ও ’১৬ খ্রিষ্টাব্দে তার চতুর্থ শ্রেণির ছেলে জ্যোতিময় সরকার জয়কে একই ক্লাসে রেখে উপবৃত্তির টাকা তুলে আত্মসাৎ করেন। এ টাকা তুলতে তিনি উপবৃত্তির কার্ডে জয়ের দুই নাম ব্যবহার করেন। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে জয়ের নাম জ্যোতিময় সরকার জয় এবং ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে জয় সরকার ব্যবহার করা হয় বলে শিক্ষকরা জানান।

ওই দুই শিক্ষক অভিযোগ করে বলেন, প্রধান শিক্ষক বিদ্যালয়ে কখনো জাতীয় দিবস পালন করেন না। এমনকি ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসও না। মা সমাবেশ হয়নি কখনো। এ ছাড়াও প্রধান শিক্ষক অফিসের সিলিং ফ্যান, স্কুলের অ্যাংগেল ও টিন বাড়িতে নিয়ে গেছেন। ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে ল্যাপটপ ও প্রজেক্টর বরাদ্দ পেলেও সেগুলো ওই সময়ে বাড়িতে নিয়ে যান। এরপর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রজেক্টর ও ল্যাপটপ ভাড়া দেন।

অভিভাবক সদস্য মনিরুল ইসলাম বলেন, প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ শুধু এখনই ওঠেনি। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এমন অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।

উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নাগমা সিলভিয়া বলেন, ওই প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি তদন্তের জন্য দুজন সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দিয়েছি। এখনো প্রতিবেদন হাতে পাইনি।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাহিদ তামান্না বলেন, ওই প্রধান শিক্ষকের স্কুলে ঘুমানোর ছবিসহ একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। তদন্ত করতে শিক্ষা কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দিয়েছি। প্রতিবেদন হাতে পেলে ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ঘুষকাণ্ড চাপা দিয়ে স্কুল অডিটে মনকিউল - dainik shiksha ঘুষকাণ্ড চাপা দিয়ে স্কুল অডিটে মনকিউল শিক্ষা একটি মৌলিক মানবাধিকার, জাতি গঠনের প্রধান হাতিয়ার - dainik shiksha শিক্ষা একটি মৌলিক মানবাধিকার, জাতি গঠনের প্রধান হাতিয়ার মাউশি কমকর্তা-কর্মচারী কল্যাণ পরিষদের নেতৃত্বে লিয়াকত-অহিদুর - dainik shiksha মাউশি কমকর্তা-কর্মচারী কল্যাণ পরিষদের নেতৃত্বে লিয়াকত-অহিদুর নবম-দশমের পাঠ্যবইয়ের চাহিদা আপলোডের নির্দেশ - dainik shiksha নবম-দশমের পাঠ্যবইয়ের চাহিদা আপলোডের নির্দেশ ক্ষমতায় গেলে ফরম থেকে কে কোন ধর্মের সেই প্রশ্ন তুলে দেয়া হবে - dainik shiksha ক্ষমতায় গেলে ফরম থেকে কে কোন ধর্মের সেই প্রশ্ন তুলে দেয়া হবে ডাকসুতে প্যানেল বাতিলসহ ৮দফা প্রস্তাবনা ইউআরআই‘র - dainik shiksha ডাকসুতে প্যানেল বাতিলসহ ৮দফা প্রস্তাবনা ইউআরআই‘র কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0055508613586426