চোরেরভিটা, মহিষখোঁচা, ঋণকারী পাড়া...... শুনে হয়তো মনে হতে পারে রাগ করে কাউকে গালি দেয়া হচ্ছে। কিন্তু আদতে তা নয়, এগুলো দেশের বিভিন্ন এলাকার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম। সারা দেশে এমন উদ্ভট নামের প্রায় দুইশ’ প্রতিষ্ঠান আছে। যা নিয়ে বিব্রত শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও স্থানীয়রা। তাই উদ্ভট ও বিতর্কিত নাসের সরকারি শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো নাম পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে জারি করা হয়েছে নীতিমালা। তা অনুযায়ী স্কুলের শ্রুতিকটু নাম পরিবর্তনের আবেদন করতে হবে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেনের আশা ছয় মাসের মধ্যে স্কুলগুলোর উদ্ভট নাম পরিবর্তন হবে।
উদ্ভট নামে শিশু শিক্ষার্থীদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব :
সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব ফরিদ আহাম্মদ বলেন, বাংলাদেশে ৬৫ হাজার ৫৬৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। অনেক বিদ্যালয়ের নাম শ্রুতিকটু, যা শিশু শিক্ষার্থীদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আমরা এটার ওপর কাজ করে একটা নীতিমালা গত ১৯ জানুয়ারি জারি করেছি। এ বিষয়ে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে দুটি কমিটি করে দিয়েছি। কমিটির মাধ্যমে প্রস্তাবগুলো আসছে। অধিদপ্তরের মাধ্যমে আগামী ছয় মাসের মধ্যে নামগুলো পরিবর্তন করবো। একই সঙ্গে শ্রুতিমধুর, স্থানীয় ইতিহাস-সংস্কৃতির সঙ্গে মানানসই, মুক্তিযোদ্ধা বা বিশিষ্ট ব্যক্তির নামে স্কুলগুলোর নাম পরিবর্তন করা হবে।
যেসব কারণে বদলানো যাবে স্কুলের নাম :
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের নীতিমালায় স্কুলের নাম পরিবর্তনের বিস্তারিত জানানো হয়েছে। ওই নীতিমালায় মন্ত্রণালয় বলছে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম শ্রুতিকটু ও নেতিবাচক এবং শিশুমনে ও জনমনে বিরূপ প্রভাব ফেলছে এমন বিবেচিত হলে তা বদলানো যাবে। বিদ্যালয়ের নাম দেশের যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত ও সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তির নামে নামকরণ হয়ে থাকলে বা নাম পরিবর্তনে আদালতের বিশেষ কোনো নির্দেশনা থাকলে নাম বদলানো যাবে। আর ভূমিকম্প, নদীভাঙনসহ নানাবিধ কারণে বিদ্যালয়ের নামের দ্বৈততা বা জটিলতা দেখা দিলে নাম বদলানো যাবে।
নতুন নামকরণ যেভাবে :
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে শিক্ষাক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন এমন ব্যক্তির নামে বা বীর মুক্তিযোদ্ধার নামে নামকরণ করা যাবে। এক্ষেত্রে বীর মুক্তিযোদ্ধা বা শিক্ষাক্ষেত্রে অবদান রাখা ব্যক্তির স্থায়ী ঠিকানা ও সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়টি একই উপজেলায় বা থানায় হতে হবে। তবে এ ধরণের ব্যক্তি বা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে কেউ রাষ্ট্রবিরোধী, ফৌজদারী, দেওয়ানী ও দুর্নীতির অপরাধে অভিযুক্ত বা সাজাপ্রাপ্ত হলে তাদের নামে বিদ্যালয়ের নামকরণ করা যাবে না। এছাড়া ক্ষেত্র বিশেষে এলাকার নাম অনুসারেও নামকরণ করা যাবে।
কোনো বীর মুক্তিযোদ্ধা বা শিক্ষাক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন এমন ব্যক্তির নামে একটির বেশি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম থাকলে নতুন করে নামকরণ করা যাবে না। স্থানীয় ইতিহাস, সংস্কৃতি ও কৃষ্টির সাথে সামঞ্জস্যতা সাপেক্ষে নাম পরিবর্তন করা যাবে।
নাম পরিবর্তনের আবেদন যেভাবে :
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সাদা কাগজে যৌক্তিকতা উল্লেখপূর্বক আবেদন অথবা প্রস্তাব করতে হবে। আবেদনের সঙ্গে ম্যানেজিং কমিটির সুপারিশ, বর্তমান নামের প্রমাণক হিসেবে পিইএমআইএসে স্কুলের নামের তালিকার সত্যয়িত কপি আবেদনের জন্য জমা দিতে হবে।
যে বীর মুক্তিযোদ্ধার নামে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নতুন নামকরণের বা নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব করা হবে তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবন বৃত্তান্ত, মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান (প্রমাণ) উল্লেখ করে বিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের কারণ সুস্পষ্টভাবে আবেদনে উল্লেখ করতে হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন এমন ব্যক্তির নামে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নতুন নামকরণের বা নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব করা হলে তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবন বৃত্তান্ত, শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর অবদানের (প্রমাণ) উল্লেখপূর্বক বিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের কারণ, কেন নতুন নামকরণের জন্য প্রস্তাব দেয়া হচ্ছে তা সুষ্পষ্টভাবে আবেদনে বা প্রস্তাবে উল্লেখ থাকতে হবে। প্রস্তাবিত বীর মুক্তিযোদ্ধার নামে বা শিক্ষাক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন এমন ব্যক্তির নামে অন্য কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নামকরণের প্রস্তাব করা হয়ে থাকলে তাও আবেদনে উল্লেখ করতে হবে। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার বরাবর নাম বদলানোর আবেদন করা যাবে। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার প্রাপ্ত প্রস্তাব বা আবেদন যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের কাছে পাঠাবেন। প্রধান শিক্ষক স্কুল ম্যানিজিং কমিটির (এসএমসি) মতামত ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ আবেদনটি সংশ্লিষ্ট উপজেলা বা থানা শিক্ষা অফিসারের কাছে পাঠাবেন। উপজেলা-থানা শিক্ষা অফিসার আবেদন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে গঠিত উপজেলা কমিটির মতামতসহ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের কাছে পাঠাবেন। এরপর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার সংশ্লিষ্ট ডিসির নেতৃত্বে গঠিত জেলা কমিটি বা অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে গঠিত সিটি কর্পোরেশন কমিটির সুপারিশসহ আবেদনটি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে পাঠাবেন। মহাপরিচালক নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব যাচাই বাছাই করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠাবেন।
আবেদন অনুমোদন যেভাবে :
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিবের নেতৃত্বে প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির সভায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব চূড়ান্ত করা হবে। এক্ষেত্রে কমিটির সভায় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট পরিচালক প্রস্তাব উপস্থাপন করবেন। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ওই কমিটির উপদেষ্টা থাকবেন। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় বিদ্যালয়ের নামকরণ বা নাম পরিবর্তনের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের ব্যবস্থা করবে এবং অর্থ বিভাগে আইবাসে (আইবাস++) বিদ্যালয়ের নতুন নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য চিঠি পাঠাবে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর সংশ্লিষ্ট ডাটাবেইজসহ সকল প্রযোজ্য ক্ষেত্রে গেজেট বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী বিদ্যালয়ের সংশোধিত নাম অন্তর্ভুক্ত করবে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নতুন নাম সংশ্লিষ্ট উপজেলা বা থানা শিক্ষা অফিসার এবং জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার স্থানীয় সব সরকারি দপ্তর বা প্রতিষ্ঠানকে জানাবেন এবং নতুন নামকরণ সংশ্লিষ্ট সব অফিস আদেশ ও প্রয়োজনীয় তথ্য সব ডাটাবেইজে এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করবেন।