স্কুলে অনুপস্থিত আট বছর, নিয়মিত বেতন তোলেন শিক্ষক কামরুন্নাহার

পাবনা প্রতিনিধি |

এক বছরের জন্য ডেপুটেশন নিয়ে প্রায় আট বছর কর্মস্থলে অনুপস্থিত পাবনা সদরের দড়িভাউডাঙা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক কামরুন্নাহার। অথচ প্রতি মাসেই সরকারি কোষাগার থেকে গ্রহণ করেছেন বেতনভাতাসহ যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা। পাবনা সদর উপজেলা শিক্ষা অফিস ও স্কুল কর্তৃপক্ষের কর্মস্থলে যোগদানের নির্দেশনার তোয়াক্কা না করে দিনের পর দিন অনুপস্থিত থেকেছেন কামরুন্নাহার।

অভিযোগ উঠেছে, বিভাগীয় প্রাথমিক শিক্ষা দপ্তরের প্রভাব বিস্তার করে, রাজশাহী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার প্রত্যয়নের মাধ্যমে প্রতি মাসে বেতন উত্তোলন করেছেন সহকারী শিক্ষক কামরুন্নাহার । সম্প্রতি, বিষয়টি নিয়ে  অনুসন্ধান শুরু করলে, গত ১৮ ডিসেম্বর কর্মস্থলে নামকাওয়াস্তে যোগ দিয়ে আবারও ছুটিতে চলে গেছেন তিনি।

উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা বরাবর দড়িভাউডাঙা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইব্রাহিম হোসেনের পাঠানো চিঠি থেকে জানা যায়, দড়িভাউডাঙা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক কামরুন্নাহারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালের ২৩ মার্চের ৮৬২ নম্বর স্মারকের একটি পত্রে নিজ কর্মস্থল থেকে বেতনভাতা উত্তোলনের শর্তে এক বছরের জন্য রাজশাহীর কাজলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংযুক্তির অফিস আদেশ দেন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের বিভাগীয় উপপরিচালক তৎকালীন আবুল কালাম আজাদ। আদেশে এ সংযুক্তি স্থায়ী নয় বলেও জানানো হয়। কিন্তু এ সংযুক্তির মেয়াদ শেষের প্রায় আট বছরেও নিজ কর্মস্থলে যোগ দেননি তিনি।

প্রধান শিক্ষক ইব্রাহিম হোসেন বলেন, ‘দড়িভাউডাঙা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রায় ৪৫০ জন শিক্ষার্থী। বিদ্যালয়টিতে এমনিতেই শিক্ষক স্বল্পতা রয়েছে। সংযুক্তি থাকলেও কামরুন্নাহার বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকায় শিক্ষা কার্যক্রমে প্রভাব পড়ছে। তাকে বারবার বিদ্যালয়ে যোগদানের অনুরোধ করলেও তিনি আসেননি। সম্প্রতি স্কুলে সংবাদকর্মীরা বিষয়টি জানতে আসার পর গত ১৮ ডিসেম্বর তিনি বিদ্যালয়ে যোগ দিয়ে ছুটিতে গেছেন। শুনেছি তিনি চাকরি ছেড়ে দেবেন।’

উপজেলা শিক্ষা অফিসের নথি ঘেঁটে জানা যায়, ২০১৫ সালে প্রাপ্ত সংযুক্তির এক বছর মেয়াদকাল শেষ হয় ২০১৬ সালের ২৪ আগস্ট। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সিনিয়র সহকারী সচিব মোহাম্মদ মাসুদ হাসান পাটোয়ারী  

স্বাক্ষরিত পত্রে কামরুন্নাহারকে রাজশাহী কাজলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শূন্যপদ থাকা সাপেক্ষে বদলির অনুরোধ করা হয়। কিন্তু শূন্যপদ না থাকায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাকে বদলি করতে পারেননি। নিয়ম অনুযায়ী তখনই তার আগের কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার কথা, কিন্তু তিনি তা না করে মেয়াদ শেষ হওয়া সংযুক্তির পত্রের অজুহাত দিয়ে আর কর্মস্থলে ফেরেননি। সংযুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির কোনো অনুমতিপত্রও পাবনা সদর উপজেলা শিক্ষা অফিসে জমা দেননি। এরপরও রাজশাহী বোয়ালিয়া উপজেলা শিক্ষা অফিসারের প্রত্যয়নপত্রের মাধ্যমে প্রতি মাসে পাবনা থেকে গ্রহণ করেছেন সব বেতনভাতা ও আনুষঙ্গিক সুবিধাদি।

পাবনা সদর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, দসংযুক্তির মেয়াদ শেষ হলে সহকারী শিক্ষক কামরুন্নাহারকে বারবার কর্মস্থলে যোগ দিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কাজলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শূন্যপদ থাকা সাপেক্ষে বদলির সুপারিশ হলেও শূন্যপদ না থাকায় বদলির আদেশ হয়নি। তিনি আগের কর্মস্থলেরও পদ ছাড়েননি। রাজশাহী উপজেলা শিক্ষা অফিস প্রত্যয়ন দেওয়ায় আমরা তার বেতনভাতা দিয়েছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে আমরা কামরুন্নাহারের প্রত্যয়নের মাধ্যমে বেতন গ্রহণের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হলে, তিনি ২০১৯ সালে হাইকোর্টে রিট পিটিশন করেন। সে রিটে ৩০ দিনের মধ্যে বদলির বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে বলা হয়। কিন্তু শূন্যপদ না থাকায় তার বদলি হয়নি। সম্প্রতি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ডেপুটেশনে থাকা সব সংযুক্তি বাতিল করলে তিনি গত ১৮ ডিসেম্বর দড়িভাউডাঙা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগ দিয়ে সেদিনই ছুটি নিয়ে চলে গেছেন।’

ভাঁড়ারা ইউপি চেয়ারম্যান সুলতান মাহমুদ খান বলেন, ‘কামরুন্নাহার প্রায় আট বছর ধরে ব্যক্তিগত কারণে দড়িভাউডাঙা স্কুলে নিজ পদ ধরে রেখেছেন। এতে ওই পদে অন্য শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া যাচ্ছে না। এতে শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছে এবং শিক্ষা কার্যক্রমেও ব্যাঘাত ঘটছে। বিষয়টি নিয়ে আমি নিজে উপজেলা শিক্ষা অফিসে কথা বলেছি। কিন্তু কামরুন্নাহারকে তারা কর্মস্থলে পাঠদানে ফেরাতে পারেননি।’

সুলতান মাহমুদ আরও বলেন, ‘শুনেছি কামরুন্নাহারের স্বামী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং সাবেক ছাত্রনেতা। তার প্রভাবেই রাজশাহী বোয়ালিয়া শিক্ষা অফিসের যোগসাজশে বছরের পর বছর তিনি দায়িত্ব পালন না করেই বেতনভাতা নিয়ে যাচ্ছেন। আমরা দ্রুত বিষয়টির নিষ্পত্তি চাই।’

তবে বদলির সুপারিশের পরও পদায়ন না হওয়ায় আগের কর্মস্থলে যোগ দেননি বলে দাবি করেছেন কামরুন্নাহার। তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আদালতে রিট পিটিশনে আমার বদলির বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে বলা হলেও কর্তৃপক্ষ তা করেনি।’ কর্মস্থলে পাঠদান না করে বেতনভাতা গ্রহণ নীতিমালা ভঙ্গ ও অনৈতিক কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নিয়মের মধ্যে থেকেই আমি সুযোগ-সুবিধা নিয়েছি। কিছু বলার থাকলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।’

এ বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের রাজশাহী বিভাগীয় উপপরিচালক শেখ মো. রায়হান উদ্দিন জানান, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর সম্প্রতি সারা দেশে ডেপুটেশনে থাকা সব শিক্ষকের সংযুক্তি বাতিলের আদেশ জারি করেছে। এরপর কামরুন্নাহার রিলিজ নিয়ে আগের কর্মস্থলে যোগদানপত্র জমা দিয়েছেন। সংযুক্তির মেয়াদ শেষের পর অনুমোদন ছাড়া বেতনভাতা নিয়ে থাকলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
চলতি মাসে টানা ৪ দিনের ছুটি মিলবে যেভাবে - dainik shiksha চলতি মাসে টানা ৪ দিনের ছুটি মিলবে যেভাবে সিইসিসহ পাঁচ কমিশনারের পদত্যাগ - dainik shiksha সিইসিসহ পাঁচ কমিশনারের পদত্যাগ রাষ্ট্রপতি যেকোনো সময় পদত্যাগ করতে পারেন - dainik shiksha রাষ্ট্রপতি যেকোনো সময় পদত্যাগ করতে পারেন বাতিল কারিকুলামে শিক্ষার্থীরা আরও একবছর ভুগবেন কেন? - dainik shiksha বাতিল কারিকুলামে শিক্ষার্থীরা আরও একবছর ভুগবেন কেন? ডিআইএতে টাকার খেলা, অভিযুক্তরাই স্কুল অডিটে - dainik shiksha ডিআইএতে টাকার খেলা, অভিযুক্তরাই স্কুল অডিটে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই নতুন অ্যাডহক কমিটি হবে - dainik shiksha সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই নতুন অ্যাডহক কমিটি হবে প্রাথমিকে স্বতন্ত্র ক্যাডার সার্ভিস চালুর দাবি - dainik shiksha প্রাথমিকে স্বতন্ত্র ক্যাডার সার্ভিস চালুর দাবি দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0055310726165771