স্কুল শপথবাক্য প্রত্যাখান করা জরুরি

নিজস্ব প্রতিবেদক |

'আমি শপথের টেক্সটটা পড়েছি। এ শপথটার যে বক্তব্য তা নানা দিক থেকে ত্রুটিপূর্ণ। এখানে যে ইতিহাসের স্টেটমেন্ট আছে তা ইতিহাস বিরোধী। যা স্কুলের বাচ্চাদের পড়ানো হচ্ছে তা স্বাধীনতার চেতনা পরিপন্থি এবং বাংলাদেশের গণতন্ত্র সংগ্রামের বিরুদ্ধে একটি শপথ। যারা আজকের ছাত্রছাত্রী ভবিষ্যতে তারা নানাভাবে দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, প্রশাসনিকসহ নানা জায়গায় নেতৃত্ব দেবে তাদের অন্যায়ভাবে গড়ে তুলবার অপপ্রয়াস ছাড়া কিছু নয়।' 

স্কুল শিক্ষার্থীদের জন্য নির্ধারিত শপথ নিয়ে এমন মতামত দিয়েছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক, লেখক, কলাম লেখক, ইংরেজি দৈনিক দ্য নিউ এজের সম্পাদক  নূরুল কবীর।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের যে স্বাধীনতা সংগ্রাম, স্বাধীনতা যুদ্ধ তা দীর্ঘ অনেকগুলো সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়েছে। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে যদি কমপক্ষে ধরে সেখান থেকে শুরু করে ভাষা আন্দোলন শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের ইউনাইটেড ফ্রন্টের যে নির্বাচন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন ও মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ধরে অসংখ্য মানুষের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে এ স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। কিন্তু আপনারা দেখবেন শপথের যে টেক্সট, এর মধ্যে প্রথম কথা হচ্ছে, 'এক রক্তক্ষয়ী মুক্তি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে'।

আসলে একাধিক রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ও যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আসলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। শপথে বলা হয়েছে, এ সংগ্রামগুলো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে হয়েছে। এটি ইতিহাসের ওপর অন্যায় দখলদারিত্ব কায়েম করে অন্যায়ভাবে অর্জিত ক্ষমতাকে ধরে রাখবার সামাজিক ও রাজনৈতিক ন্যায্যতা সৃষ্টির যে রাজনীতি, এটি তার বহিঃপ্রকাশ। কারণ এত দীর্ঘ সংগ্রাম দশক দশক ধরে যখন সংগ্রাম চলে তখন কারও একার পক্ষে সম্ভব হয় না এর সবকিছু নেতৃত্ব দেয়ার। কোনটার মধ্যে তিনি রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন যুবক হিসাবে কোন টার মধ্যে অত্যন্ত বড় সংগঠক ছিলেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের যে চূড়ান্ত পর্ব সেখানে শেখ মুজিবুর রহমান অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন। এটা তো অস্বীকার করার কোন সুযোগ নাই। এটাতো ঐতিহাসিক সত্য। আর স্বাধীনতার যুদ্ধ যখন হয় নয় মাস আওয়ামী লীগের অন্য যারা নেতা ছিলেন যেমন তাজউদ্দীন আহমদ বা প্রথম উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম তারা বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের বজ্রকন্ঠকে ব্যবহার করে তার নামে নিঃসন্দেহে এই স্বাধীনতা যুদ্ধ প্রত্যক্ষভাবে তার করেছেন। ফলে, বিভিন্ন সময়ে একটা সিরিজ অব সংগ্রামের মধ্যে সিরিজ অব নেতৃত্ব থাকে, এটা অনেকটা রিলেরেসের মত, মশাল একজন একজন করে সামনে এগিয়ে নেয়ার মত একটা চূড়ান্ত পর্যায়ে বাংলাদেশ জয়ী হয়েছে। প্রত্যেকটা সংগ্রামের নেতাদের যথাযথ সম্মান দেয়া হচ্ছে ইতিহাস সচেতন ব্যক্তিদের বা রাজনৈতিক দলগুলোর এবং ইতিহাসের ছাত্রদের কর্তব্য।। এটাতে সেটা অস্বীকার করা হয়েছে অর্থাৎ ছাত্র-ছাত্রীদের একটা বিভ্রান্তিমূলক তথ্য দিয়ে ইতিহাসকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে পুরো ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার উপর দলীয় রাজনৈতিক দল বজায় রাখার জন্য এটা অন্যায়।

তিনি বলেন, দ্বিতীয়তঃ ছাত্র-ছাত্রীদের যে শপথ নিতে হবে সেটা হচ্ছে এই জাতির পিতা শেখ মুজিবের আদর্শ উন্নত সমৃদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে এ কথাগুলো খুব সত্য শুনতে ভালো কথা। কিন্তু ইতিহাসের দিক থেকে যে স্বাধীনতার সংগ্রাম জাতীয় সংগ্রাম শুরু হলো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বিপন্ন করে দিয়ে একটি হত্যাযজ্ঞ শুরু করার কারণে, নির্বাচনের রায় প্রত্যাখ্যান করে এদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার কারণে, সেই গণতন্ত্র কথাটা এখানে নেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতিটি বাঁকে বাঁকে, গণতন্ত্রের জন্য এদেশের মানুষ লড়াই করেছেন, সেই গণতন্ত্রের কথা এখানে অনুপস্থিত। কারণ এই মুহূর্তে যারা এই বয়ান তৈরি করেছেন তাদের মাথার মধ্যে আর যা-ই থাকুক গণতন্ত্র নেই। অথচ বাংলাদেশের সৃষ্টির চেতনার একটি অন্যতম উৎস হলো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা।

নূরুল কবীর বলেন, আর এ শপথে আছে সমৃদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের কথাটা একমাত্র জিনিস যেটা এখানে ঠিকভাবে আছে, যেটা সংগ্রামের মধ্যে উপস্থিত ছিল। 

সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বলতে কী বোঝায় প্রশ্ন রেখে তিনি আরও বলেন, সরকার, সরকারি কর্মকর্তা এবং সরকারি বুদ্ধিজীবীরা প্রতিদিন বলছেন বাংলাদেশে নানাভাবে সমৃদ্ধ হয়েছে, সেই সমৃদ্ধি রূর কি? সেই সমৃদ্ধি বাড়ার সাথে সাথে বৈষম্য বেড়েছে ভয়াবহভাবে। আমর আনকোয়ালিফাইড সমৃদ্ধির জন্য আমাদের বাচ্চাদেরকে আমাদের শিশুদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে পারিনা। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চেতনা বৈষম্যহীনতা। আমাদের প্রক্লামেশন অব ইন্ডিপেন্ডেন্সের মধ্যে সামাজিক ন্যায় বিচারের কথা আছে, বৈষম্যহীন বাংলাদেশের কথা আছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, গণতন্ত্রের কথা বাচ্চাদের শিখতে হবে না? বৈষম্যহীনতার কথা বাচ্চাদের শিখতে হবে না? শুধু ও সমৃদ্ধির কথা তাদের শিখতে হবে। যে সমৃদ্ধি নবতর সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের একটা মডেল হিসেবে দাঁড়িয়েছে। এটাতো আইয়ুব খান ইয়াহিয়ার মডেল। আইয়ুব খান গণতন্ত্রহীন সমৃদ্ধ পাকিস্তানের কথা বলতো, ইয়াহিয়া খান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে উপেক্ষা করে আমাদের ওপর একটা সশস্ত্র যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল। তাহলে এই যে যারা এই শপথ ড্রাফট করেছেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যারা আছেন তারা আমাদের শিশুদের কি কি শেখাতে চান? আইয়ুব খান ইয়াহিয়া খানের রাষ্ট্রচিন্তা? আমি মনে করি, বাংলাদেশের ইতিহাসে দিক থেকে সংগ্রামের দিক থেকে এই শপথ বাংলাদেশেকে যেইখানে নিয়ে পৌঁছানোর কথা তার সঙ্গে অসঙ্গতি পরায়ণ, কোন কোন ক্ষেত্রে বিরুদ্ধবাদী। ছাত্রদের উচিত, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সম্পন্ন প্রত্যেকজন রাজনৈতিক এবং সামাজিক ব্যক্তিদের উচিত এই শপথকে প্রত্যাখ্যান করা এবং এটার বিরুদ্ধে সংগ্রাম তৈরি করা। 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
এবারও ভারতে ছাপা হবে ১ কোটি পাঠ্যবই - dainik shiksha এবারও ভারতে ছাপা হবে ১ কোটি পাঠ্যবই বদলি প্রত্যাশীদের সংবাদ সম্মেলন শুরু - dainik shiksha বদলি প্রত্যাশীদের সংবাদ সম্মেলন শুরু মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার সংস্কার পরিকল্পনা তৈরিতে গলদঘর্ম অধিদপ্তর - dainik shiksha মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার সংস্কার পরিকল্পনা তৈরিতে গলদঘর্ম অধিদপ্তর ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে যা যা করতে হবে - dainik shiksha ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে যা যা করতে হবে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের নতুন ডিজি আব্দুল হাকিম - dainik shiksha প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের নতুন ডিজি আব্দুল হাকিম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দখলদারিত্ব বন্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে - dainik shiksha শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দখলদারিত্ব বন্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0028300285339355