স্কুল শিক্ষক থেকে হেজবুল্লাহর প্রধান কে এই নাইম কাসেম

দৈনিক শিক্ষাডটকম ডেস্ক |

লেবাননের সশস্ত্র সংগঠন হেজবুল্লাহ তাদের উপ মহাসচিব (ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল) নাইম কাসেমকে এই সামরিক সংস্থাটির নতুন প্রধান হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে।

গত মাসে (সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে) দক্ষিণ বৈরুতে ইসরায়েলি হামলায় সংগঠনটির অন্যান্য সিনিয়র সদস্যদের সাথে হেজবুল্লাহর সাবেক প্রধান হাসান নাসরাল্লাহ নিহত হন।

নাইম কাসেম হেজবুল্লাহর কয়েকজন সিনিয়র নেতাদের একজন যারা ইসরায়েলি হামলা থেকে বেঁচে ফিরতে পেরেছিলেন।

২৭শে সেপ্টেম্বর হাসান নাসরাল্লাহর মৃত্যুর তিন দিন পর নাইম কাসেম একটি ভিডিও বিবৃতিতে বলেছিলেন, তার সংগঠন শিগগিরই একজন নতুন নেতা নির্বাচন করবে। ফিলিস্তিনিদের সাথে সংহতি জানিয়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাবেন তারা।

হেজবুল্লাহর নিজস্ব নিয়ম ও প্রবিধান অনুযায়ী, উপ মহাসচিব (ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল) যেকোনো রাজনৈতিক বা নিরাপত্তা সংক্রান্ত জরুরি পরিস্থিতিতে সংগঠনের মহাসচিবের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে।

সংগঠনের মহাসচিবের মৃত্যুর ঘটনায়, হেজবুল্লাহর শুরা একটি সভা করে এবং সংগঠনের নতুন প্রধান নির্বাচন করে।

নতুন প্রধান নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত উপ-মহাসচিব, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করে থাকে।

না‌ইম কাসেম কে?

হেজবুল্লাহর নতুন প্রধানের পুরো নাম নাইম বিন মুহাম্মদ নাইম কাসেম এবং তিনি লেবাননের রাজধানী বৈরুতের বাস্তা আল-তাহতা এলাকায় ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি চার ছেলে ও দুই মেয়ের বাবা।

নাইম কাসেমের বাবা দক্ষিণ লেবাননের ইকলিম আল-তুফাহ অঞ্চলের কাফার ফিলা শহরের বাসিন্দা ছিলেন। এজন্য তাকে কাফার ফিলার ছেলেও (পুত্র) বলা হতো।

তিনি লেবাননের জিদ শিয়া উলামা থেকে তার ধর্মীয় শিক্ষা লাভ করেন এবং বিশিষ্ট শিয়া পণ্ডিতদের অধীনে ধর্মীয় অধ্যয়নের সর্বোচ্চ স্তরে পার করেন।

ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দে লেবাননের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে মাস্টার্স (স্নাতকোত্তর) ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি।

এরপর, তিনি প্রায় ছয় বছর একটি মাধ্যমিক শ্রেণির শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন এবং লেবাননের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধিভুক্ত টিচার্স কলেজ থেকে শিক্ষাদানের প্রশিক্ষণও পান।

তিনি অনেক ইসলামিক বই পড়তেন, যার কারণে তিনি অল্প বয়সে জনসমক্ষে ধর্ম বিষয়ে কথা বলার এবং জ্ঞান বিতরণের দক্ষতা অর্জন করেন।

বিবিসি অ্যারাবিক সার্ভিস জানতে পেরেছে, নাইম কাসেম ছোটবেলা থেকেই প্রতি সপ্তাহে শিশুদের মসজিদে পড়াতেন। তখন তার বয়স ছিল ১৮ বছরেরও কম।

সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে যখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন তখন তার সহপাঠীদের সাথে ‘মুসলিম ছাত্রদের ইউনিয়ন’ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি।

তাদের উদ্দেশ্য ছিল স্কুলে ও স্কুলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধর্মীয় ধারণার প্রচার করা।

আমাল- এ সম্পৃক্ততা

ইমাম মুসা আল সদর ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে রাজনৈতিক ও সামরিক সংগঠন লেবানিজ রেজিস্ট্যান্স ব্রিগেড (আমাল) প্রতিষ্ঠা করেন এবং নাইম কাসেম এতে যোগ দেন।

নাইম কাসেম সেই ব্যক্তিদের মধ্যে একজন যারা লেবাননের বিভিন্ন অঞ্চলে আন্দোলন শুরু করার বিষয়ে সংগঠনের প্রথম বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন এবং তারা এই লেবাননের অন্যান্য এলাকায় আমালের বিষয়ে প্রচারণা চালাতে থাকেন।

নাইম কাসেম আমালের উপ-সংস্কৃতি কর্মকর্তার পদে অধিষ্ঠিত হন। তার দায়িত্ব ছিল সংগঠনের সংস্কৃতি ও ধারণা প্রচার করা।

এটা এমন এক সময় ছিল যখন আমালের প্রধান, ইমাম মুসা আল-সদর, লিবিয়ায় নিখোঁজ হন এবং হুসেইন আল-হুসাইনি ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে সংগঠনের নতুন প্রধান হন। সেসময় নাইম কাসেম আমাল নেতৃত্ব পরিষদের একজন সচিব ছিলেন।

যাই হোক, ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই ফেব্রুয়ারি আয়াতুল্লাহ খোমেনি পরিচালিত ইরানের ইসলামী বিপ্লবের পর, নাইম কাসেম ‘আমাল’ থেকে পদত্যাগ করেন।

তখন তিনি বৈরুতের মসজিদে ধর্মীয় শিক্ষাগ্রহণ অব্যাহত রাখেন এবং দক্ষিণ শহরতলির বেশ কয়েকটি মসজিদ এবং হুসাইনিয়ায় বক্তৃতা দিতেন। মূলত এসব কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি আমাল আন্দোলন থেকে সরে এসেছিলেন।

প্রায় দুই দশক ধরে, নাইম কাসেম লেবানন জুড়ে 'তাবলিগি' বা ‘বক্তৃতা’ কার্যক্রমে সক্রিয় ছিলেন এবং বৈরুতের বিভিন্ন ধর্মীয় স্থানে তিনি ধর্মীয় বক্তৃতা দিতেন।

তিনি মূলত বৈরুতের বিভিন্ন স্থানে সাপ্তাহিক ধর্মীয় পাঠ এবং ধর্মীয় দিক নির্দেশনা দিতেন।

তিনি ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দে "শিয়া" ইসলামিক রিলিজিয়াস এডুকেশন সোসাইটি প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখেন।

এই প্রতিষ্ঠানটি প্রতিটি সরকারি ও বেসরকারি স্কুলে ইসলাম বিষয়ক শিক্ষা বিস্তারে কাজ করতো। এজন্য তারা সকল স্তরের স্কুলগুলোয় নারী ও পুরুষ শিক্ষকদের পাঠিয়ে ধর্মীয় পাঠ দিতো।

নাইম কাসেম বৈরুতের দক্ষিণ শহরতলির আল মুস্তফা স্কুলের ছয়টি শাখার মহাপরিচালকের পদেও ছিলেন। এই স্কুলগুলোয় ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সরকারি লেবানিজ পাঠ্যক্রম শেখানোর পাশাপাশি ইসলামিক পাঠ্যক্রম পড়ানো হতো।

ইরানে বিপ্লবের পর যেসব ইসলামি কমিটি গঠন করা হয়েছিল যারা কি না আয়াতোল্লাহ খোমেনিকে সমর্থন দিয়েছিল সেসব কমিটিতেও হেজবুল্লাহর নতুন প্রধান অতীতে বেশ সক্রিয় ছিলেন।

এই কমিটিগুলো শুধু মিছিলই করেনি বরং ইরানি বিপ্লবকে সমর্থন করে বক্তৃতাও দিয়েছে।

হেজবুল্লাহ প্রতিষ্ঠা

১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে, ইসলামী কমিটি, ইসলামিক দাওয়া অ্যাসোসিয়েশন লেবানিজ শাখা, বেকা এবং ইসলামিক মুভমেন্ট অফ আমালের আলেমদের মধ্যে বৈঠকের পর, হেজবুল্লাহ প্রতিষ্ঠিত হয়।

যে সমস্ত বৈঠকে এই সংগঠন প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল নাইম কাসেম সেই সভাগুলোর প্রতিষ্ঠাতা অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে একজন ছিলেন এবং হেজবুল্লাহ প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখেছেন।

তিনি প্রায় তিন মেয়াদে হেজবুল্লাহর শুরা কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন এবং প্রাথমিকভাবে তাকে বৈরুতে শিক্ষাগত ও স্কাউটিং কার্যক্রমের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।

পরবর্তীতে তিনি কার্যনির্বাহী কমিটির ডেপুটি চেয়ারম্যান এবং শেষ পর্যন্ত শুরার চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে, আব্বাস আল-মুসাভি হেজবুল্লাহর মহাসচিব ছিলেন এবং একই সময়ে, নাইম কাসেম সংগঠনটির উপ মহাসচিব পদে নিযুক্ত হন।

১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে, আব্বাস আল-মুসাভি নিহত হন এবং হাসান নাসরাল্লাহ হেজবুল্লাহর নতুন প্রধান হন।

কিন্তু নাইম কাসেমকে কখনোই ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেলের পদ থেকে সরানো হয়নি।

নাইম কাসেম হেজবুল্লাহর রাজনৈতিক শাখার এবং পার্লামেন্টারি অ্যাকশন কাউন্সিলের প্রধান ছিলেন। অর্থাৎ সশস্ত্র সংগঠনটির পার্লামেন্টারি বিষয়গুলো তার সিদ্ধান্তে পরিচালিত হতো।

হেজবুল্লাহর এই পার্লামেন্টারি অ্যাকশন কাউন্সিল, বিরোধীদের প্রতি কারা আনুগত্য প্রকাশ করছে, অধস্তনরা ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করছে কি না এবং তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করতো।

নাইম কাসিম সবসময় হেজবুল্লাহ সেই নেতাদের মধ্যে একজন ছিলেন যিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের নেতৃত্ব দিতেন, গণমাধ্যমের সাথে কথা বলতেন, সাংবাদিকদের সাক্ষাৎকার দিতেন। একইসাথে ধর্মীয় বক্তৃতায় অংশ নিয়ে থাকেন তিনি।

হেজবুল্লাহর নতুন প্রধান বেশ কয়েকটি বইও লিখেছেন এবং তার মধ্যে একটির শিরোনাম 'হেজবুল্লাহ'। বলা হয় ওই বইতে হেজবুল্লাহর উদ্দেশ্য, ইতিহাস এবং রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা সম্পর্কে লেখা হয়।

গত ৩৫ বছর ধরে হাসান নাসরাল্লাহর সঙ্গে নাইম কাসেমের সরাসরি সম্পর্ক ছিল। সংগঠনের শুরা কাউন্সিলের যৌথ কার্যনির্বাহী অবস্থান, স্থায়ী বৈঠক এবং পরামর্শের মাধ্যমে তারা একে অপরের যোগাযোগে থাকতেন।

হেজবুল্লাহ এবং ইসরায়েলের মধ্যে লড়াইয়ের সময় নাইম কাসেম সংগঠনে অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকায় ছিলেন।

হেজবুল্লাহকে বারবার ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বোমা হামলার জন্য দায়ী করা হয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশগুলো একে "সন্ত্রাসী" সংগঠন হিসাবে আখ্যা দিয়ে থাকে।

সূত্র: বিবিসি বাংলা


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
মিনিস্ট্রি অডিটরদের গরুর দড়িতে বাঁধবেন শিক্ষকরা! - dainik shiksha মিনিস্ট্রি অডিটরদের গরুর দড়িতে বাঁধবেন শিক্ষকরা! অ্যাডহক কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha অ্যাডহক কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নতুন নির্দেশনা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে সোহরাওয়ার্দী কলেজ যেনো ধ্বং*সস্তূপ - dainik shiksha সোহরাওয়ার্দী কলেজ যেনো ধ্বং*সস্তূপ জোরপূর্বক পদত্যাগে করানো সেই শিক্ষকের জানাজায় মানুষের ঢল - dainik shiksha জোরপূর্বক পদত্যাগে করানো সেই শিক্ষকের জানাজায় মানুষের ঢল শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি সারানোর এখনই সময় - dainik shiksha শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি সারানোর এখনই সময় কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0030300617218018