স্থাপত্যকলার পথিকৃৎ মাজহারুল ইসলাম

নূসরাত জাহান নিশা |

সরকারি চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়, ঢাকা গণগ্রন্থাগার, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় জনপ্রশাসন ইনস্টিটিউট, বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণাগার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি ভবন, পাকিস্তান আমলে ইসলামাবাদে মন্ত্রীদের বাসভবন—এসবের মধ্যে মিল আছে এক জায়গায় : সব কটির স্থপতি একজনই—মাজহারুল ইসলাম।

দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে পাকিস্তান স্থপতি ইনস্টিটিউটের সভাপতি হন তিনি। পাকিস্তানের স্থপতি নিবন্ধন আইনের খসড়ার মুখ্য রূপকার, ইসলামাবাদের বাদশাহ ফয়সাল মসজিদের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার বিচারক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

দেশে এমন এক সময়ে তাঁর আবির্ভাব, যখন আধুনিক স্থাপত্যকলা যে একটা পড়ার বিষয় হতে পারে সে ধারণাই ছিল না। ১৯৫৩ সালে সরকারি আর্ট কলেজ ও ঢাকার গণগ্রন্থাগার নির্মাণের মধ্য দিয়ে বলতে গেলে তাঁর হাত ধরেই বাংলাদেশের স্থাপত্যে সূচনা ঘটে আধুনিক যুগের। তখন তিনি সরকারি চাকরি করতেন। সরকারের অধীনেই ১৯৫৪ সালে ভবন দুটি নির্মিত হয়।

প্রচারবিমুখ এই স্থাপত্যশিল্পীর জন্ম ১৯২৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর। ১৯৪২ সালে বিএসসি পাস করার পর প্রথমে শিবপুরের রয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলে ভর্তি হন। সেখান থেকে পুরকৌশলে ১৯৪৬ সালে স্নাতক। এরপর কনস্ট্রাকশন, বিল্ডিং অ্যান্ড ইরিগেশন বিভাগের প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগন বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি বৃত্তি নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। ১৯৫৩ সালে স্থাপত্যে স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর ১৯৫৩ সালে দেশে ফিরে জুনিয়র সহস্থপতি হিসেবে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৫৭ সালে লন্ডনের এ অ্যান্ড এ স্কুলে ট্রপিক্যাল স্থাপত্য বিষয়ে ডিপ্লোমা করেন।

ওই সময় দেশে সরকার বড় বড় কাজে বিদেশি স্থপতিদেরই নিয়োগ দিত। কিন্তু তাঁদের কাজ ছিল সেকেলে ঘরানার। আধুনিক বা পরিবেশ-প্রতিবেশ মাথায় নিয়ে কাজ করতেন না তাঁরা। বাঙালি সংস্কৃতির ছাপ নিয়ে তো কোনো চিন্তাই ছিল না তাঁদের। ওই অবস্থায় পুরোপুরি ব্যতিক্রমী চিন্তা নিয়ে এগোতে হয়েছে মাজহারুল ইসলামকে। অচিরেই তিনি বিদেশি প্রভাব কাটিয়ে নিজস্ব ধারার প্রয়োগ ঘটান। এ দেশের কৃষ্টি, সভ্যতা, ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিক নান্দনিকতা ও উপকরণের সার্থক সমন্বয় ঘটান। তিনিই এ দেশে প্রথম লাল পোড়া ইটকে উন্মুক্ত পলেস্তারাহীন টাইলের মতো করে পুরনো রীতিকে নতুন রূপে উপস্থাপন করেন। বিশ্ববিদ্যালয় পাঠাগারের দেয়ালে দেয়ালচিত্র জুড়ে দেওয়ার প্রস্তাব তিনিই প্রথম বাস্তবায়নের পরামর্শ দেন। তাঁর উদ্যোগেই সেখানে নভেরা আহমেদ ও হামিদুর রহমানের দুটি কাজ স্থান পায়।

যুদ্ধের আগে দেশে কাজ করে গেছেন দুই হাতে। তবে শুধু ভবন নির্মাণ নয়, স্থাপত্যকলার শিক্ষার্থী নির্মাণ, স্থাপত্যশিক্ষার প্রসার এবং শিক্ষার্থীদের জন্য উপযুক্ত স্থাপত্য-পরিবেশ নির্মাণেও সচেষ্ট হন তিনি। তাঁর উদ্যোগে ১৯৫৯ সালে পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি দল ঢাকায় উচ্চমানের স্থাপত্যশিক্ষার সম্ভাব্যতা যাচাই করতে আসে। কিন্তু সেই চেষ্টা সফল হয়নি।

১৯৬৭ সালের দিকে সরকারি চাকরি ছেড়ে অন্য দুই প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ও প্রকৌশলী আজিম উদ্দিনের সঙ্গে ‘বাস্তুকলাবিদ’ নামে একটি স্থাপত্য উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান গঠন করে স্থাপত্যচর্চা শুরু করেন মাজহারুল ইসলাম। উদ্দেশ্য ছিল স্থাপত্যকলার বিদ্যার্থীদের সঙ্গে শিল্পকলার একটা মেলবন্ধনের প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা। কিছুদিনের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি তদানীন্তন সমগ্র পাকিস্তানে উন্নত স্থাপত্য-শিল্পকর্ম চর্চার প্রধান প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এরই মধ্যে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য অনুষদে প্রাতিষ্ঠানিক স্থাপত্যশিক্ষা শুরু হয় এবং স্নাতক ডিগ্রিপ্রাপ্ত অনেক নবীন স্থপতি কাজ শিখতে চলে আসতেন বাস্তুকলাবিদে। পটুয়া কামরুল হাসান গিয়ে ওই অফিসে ছবি আঁকতেন। সৈয়দ জাহাঙ্গীর ও মীর মোস্তাফাও নিয়মিত যেতেন সেখানে। ছায়ানটের ক্লাসও হতো বাস্তুকলাবিদে। পশ্চিমবঙ্গের সুচিত্রা মিত্র, সাগর সেন সেখানকার সবুজ লনে গান গেয়েছেন। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ও যেতেন। স্থপতিদের মধ্যে লুই কান, পল রুডলফ, টাইগারম্যান, চার্লস কোরিয়া, ভিমসেন যোশি, সোহা—সবাইকে দেখা গেছে। বিশেষ করে সংসদ ভবনের নকশা করার সময় প্রতি বিকেলেই লুই কান ও মাজহারুল ইসলামকে দেখা যেত গভীর আলাপে মগ্ন।

১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ সরকার স্থপতি মাজহারুল ইসলামকে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে। একই বছর আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস (এআইএ) ফেলো সদস্য (এফএআইএ) মনোনীত করে। পরে ভারতের জেজে সিমেন্ট কর্তৃপক্ষ গ্র্যান্ডমাস্টার পুরস্কার দেয় তাঁকে।

 

নূসরাত জাহান নিশা


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ঢাকার তাপমাত্রা দেখে স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত নয়: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha ঢাকার তাপমাত্রা দেখে স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত নয়: শিক্ষামন্ত্রী আরো ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha আরো ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা - dainik shiksha ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা এসএসসি পরীক্ষার ফল ১০ বা ১১ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল ১০ বা ১১ মে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কুমিল্লায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি ঘণ্টা চালুর নির্দেশ - dainik shiksha কুমিল্লায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি ঘণ্টা চালুর নির্দেশ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে - dainik shiksha প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0060391426086426