স্বমহিমায় ভাস্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বাহালুল মজনুন চুন্নূ |

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আজ ৯৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ১৯২১ সালের পহেলা জুলাই যাত্রা শুরু করা এই বিশ্ববিদ্যালয় স্বমহিমায় জ্ঞানার্জনের তীর্থভূমি, মুক্তচিন্তার পাদপীঠ এবং গণতন্ত্রের সূতিকাগারে পরিণত হয়েছে। বাঙালি জাতির ইতিহাস আর এই বিশ্ববিদ্যালয় যেন একই সূত্রে গাঁথা। বাঙালির মুক্তির সংগ্রামের প্রতিটি অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র্র করে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং মহান একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে এ বিশ্ববিদ্যালয় ছিল নেতৃত্বের অগ্রভাগে। এখান থেকেই আন্দোলনের স্ফূলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়েছিল সারাদেশে। এই বিশ্ববিদ্যালয় ব্যতীত পৃথিবীতে আর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে বিশ্ববিদ্যালয় তার জাতিকে একটি পতাকা উপহার দিয়েছে।

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ হওয়ার পর থেকেই ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি উঠতে থাকে। ব্যারিস্টার খান সাহেবজাদা আফতাব আহমেদ, নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী, নবাব সলিমুল্লাহ, স্যার সৈয়দ শামসুল হোদাসহ আরো অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য ব্রিটিশ সরকারকে চাপ দিতে থাকে।  ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করা হলে ব্রিটিশ সরকার নেতাদের দাবির প্রেক্ষিতে নাথান কমিশন ও স্যাডলার কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে ১৯২১ সালের পহেলা জুলাই ঢাকার রমনা এলাকায় ছয়শ একর জমিতে তিনটি অনুষদ, ১২টি বিভাগ, ৬০ জন শিক্ষক, ৮৪৭ জন শিক্ষার্থী এবং তিনটি আবাসিক হল নিয়ে তার শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরুর পর থেকেই পূর্ব বাংলার আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে পরিবর্তন আসতে  থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ফিলিপ জে হার্টগ চেয়েছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়কে সমগ্র ভারতবর্ষের মধ্যে একটি মডেল বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করতে। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও বিদ্যাচর্চার খ্যাতিতে বিশ্ববিদ্যালয়টি উপমহাদেশের একটি শ্রেষ্ঠ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছিল। প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই এ বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য, শিল্পকলা এবং রাজনীতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা প্রদান ও চর্চার ক্ষেত্রে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করে আসছে।

দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রেই রয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মশালবাহী কেউ না কেউ। সর্বাগ্রে বলতে হয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা। তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র ছিলেন। জনমানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এজন্য তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। মুচলেকা দিলে তিনি বহিষ্কার হতেন না। ২০১০ সালের ১৪ আগস্ট দীর্ঘ প্রায় ৬১ বছর পর তার ছাত্রত্ব ফিরিয়ে দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

বঙ্গবন্ধু হত্যাপরবর্তীকালে দুই স্বৈরশাসক নিজেদের নোংরা রাজনীতির স্বার্থে ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতিকে কলুষিত করার খেলায় মেতে উঠেছিল। অনেকেই তাদের প্রলোভনের ফাঁদে ধরা দেয়। ফলে শিক্ষার মান ক্রমে পড়ে যেতে থাকে। তবে বিগত বছর দশেক ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। শিক্ষণ-শিখন কার্যক্রমে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে। আধুনিক পঠন-পাঠন অনুসৃত হচ্ছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষাক্রমেও নিয়ে আসা হয়েছে পরিবর্তন। খোলা হয়েছে নতুন নতুন বিভাগ। সেমিস্টার সিস্টেমে কমিয়ে আনা হয়েছে সেশনজট। আগে যেখানে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করতে ১০ থেকে ১২ বছর লেগে যেত সেখানে এখন মাত্র পাঁচ বছরেও শিক্ষার্থীরা পাস করে বেরিয়ে যাচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত ৩৯টি গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। পাটের জিনোম সিকোয়েন্স আবিষ্কারসহ নানা উল্লেখযোগ্য গবেষণা এখান থেকে করা হলেও তা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নয়। এর অন্যতম কারণ অর্থের সংকট। গবেষণা খুবই ব্যয়বহুল; বিশেষত বিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণা। বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার ব্যয় বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে প্রদান করা জাতীয় বাজেটের বরাদ্দের চেয়েও অনেক বেশি। সীমিত বাজেট গবেষণার উন্নয়নের ক্ষেত্রে অন্তরায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সমাজ ও সভ্যতা বিনির্মাণের পথ দেখাবে, সমাজের বিদ্যমান সমস্যা নিয়ে গবেষণা করবে, সমাধানের পথ বের করবে সেটাই সমগ্র জাতির কাম্য এবং সেজন্য প্রয়োজন বাজেটে গবেষণা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ গবেষণা খাতে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধিসহ ইনোভেশন অ্যান্ড ইনকিউবেশন ল্যাব প্রতিষ্ঠা করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসন অবকাঠামোগত উন্নয়নের জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

এদেশের মহান স্বাধীনতাকেই ধারণ করে আসছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং আজকের সরকার। সকল প্রগতিশীল আন্দোলন ও মহান স্বাধীনতা যুদ্ধকে হূদয়ে ধারণ করে আজকের প্রশাসন আগামী প্রজন্মের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। একাত্তরে আমরা লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতার লাল সূূর্যটাকে ছিনিয়ে এনেছিলাম। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই সিনেট ও সিন্ডিকেটে সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা ‘বিজয় একাত্তর’ হল নামকরণে সুরম্য একটি আবাসিক হল নির্মাণ করেছি। আবার স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য, যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য বঙ্গবন্ধুর সেই ৭ মার্চ এর নির্দেশনাকে স্মৃতিতে রাখার জন্যই রোকেয়া হলের অভ্যন্তরে এক হাজার শয্যা বিশিষ্ট ৭ মার্চ ভবন এবং প্রগতিশীল রাজনীতি ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার পথনির্দেশক কবি সুফিয়া কামালের নামে হল নির্মাণ করা হয়েছে। বিগত দুুটি সিনেট অধিবেশনে স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল স্লোগান ‘জয় বাংলা’ নামে আরেকটি ছাত্রাবাস করার প্রস্তাবও আমরা উত্থাপন করেছি। এর মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্বাধীনতার মহান স্থপতির প্রতিই শ্রদ্ধা প্রদর্শন করছে। কথায় বলে লেখাপড়া করা ব্যতীত কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দা দিয়ে হাঁটলেও অনেক জ্ঞান লাভ করা যায়। এটা কথার কথা। তবে এর মধ্যে দিয়ে জ্ঞান চর্চায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্ব কতখানি সেই বিষয়টিই প্রকাশ পায়। বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাত ধরে, এই দেশের চলমান অগ্রযাত্রার সারথিও এই বিশ্ববিদ্যালয়। আগামীতে এই দেশটির সার্বিক উন্নয়নে এই গৌরবময় বিশ্ববিদ্যালয় অতীতের মতো মহীরুহের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে এটাই প্রত্যাশা।

লেখক: সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা - dainik shiksha দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার চাকরির বয়স নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর চিঠির পর সমাবেশের ডাক দিলো ৩৫ প্রত্যাশীরা - dainik shiksha চাকরির বয়স নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর চিঠির পর সমাবেশের ডাক দিলো ৩৫ প্রত্যাশীরা স্কুলে গ্রীষ্মের ছুটি কি এপ্রিলে এগিয়ে আনা দরকার? - dainik shiksha স্কুলে গ্রীষ্মের ছুটি কি এপ্রিলে এগিয়ে আনা দরকার? কলেজের শিক্ষকদের ডিজিটাল বদলির আবেদন শুরু রোববার - dainik shiksha কলেজের শিক্ষকদের ডিজিটাল বদলির আবেদন শুরু রোববার বুটেক্সের প্রথম সমাবর্তন ৭ সেপ্টেম্বর - dainik shiksha বুটেক্সের প্রথম সমাবর্তন ৭ সেপ্টেম্বর শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি: শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি: শিক্ষা মন্ত্রণালয় দুর্যোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটিতে বিশেষ কমিটি গঠনে নীতিমালা হবে: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha দুর্যোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটিতে বিশেষ কমিটি গঠনে নীতিমালা হবে: শিক্ষামন্ত্রী দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.011246919631958