স্বাধীনতাবিরোধী লেখকের বইও কিনছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প!

দৈনিকশিক্ষা প্রতিবেদক |

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অখণ্ড পাকিস্তান রাখার পক্ষে বিবৃতি দেন লেখক মোহাম্মদ নাসির আলী। ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দের ২২ জুন পাকিস্তান সরকার রেডিও-টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার বন্ধের যে সিদ্ধান্ত নেয় তাতেও সমর্থন জানান তিনি। এই লেখক সম্পর্কে বাংলা একাডেমির চরিতাভিধানে এমন সব তথা পাওয়া গেছে।

মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের জন্য সম্প্রতি স্বাধীনতাবিরোধী এ লেখকের ‘লেবু মামার সপ্তকাণ্ড’  এবং বীরবলের খোশগল্প’ নামে দুটি বই কেনা হচ্ছে সরকারি টাকায়। 

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পের আওতায়  এই বই ফেনা হচ্ছে। অথচ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বই সংগ্রহের নীতিমালার ১৭ নম্বর নির্দেশনায় স্পষ্ট উল্লেখ আছে, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাবিরোধী কোনো লেখকের বই নির্বাচন বা কেনা ঘাবে না।

মাধামিকে পাঁচ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্য বই পড়ার অভ্যাস বাড়াতে ২০১০ খিষ্টাব্দে “সেকেন্ডারি এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (এসইডিপি) হাতে নেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এই কর্মসূচির আওতায় ‘স্ট্রেংদেনিং রিডিং হ্যাবিট অ্যান্ড রিডিং স্কিলস অ্যামং সেকেন্ডারি স্টুডেন্টস’ শীর্ষক এই প্রকল্পে দেশের ১৫ হাজার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বই দেয়ার কথা রয়েছে। এর মধ্যে ১০০ কোটি টাকার বই কেনা হবে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের পুরস্কার দেওয়ার জন্য । বাকি ১০০ কোটি টাকার বই কিনে তা ছাত্রছাত্রীদের পাঠ অভ্যাস বাড়াতে বিতরণ করা হবে।

প্রকল্পে বই কিনতে ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ ডিসেম্বর ‘পুস্তক সংগ্রহের নীতিমালা’ ঠিক করে দেয় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) উন্নয়ন-১ অধিশাখা । ২০২১ খিষ্টাব্দের ২৭ মে বই কিনতে প্রকাশকদের থেকে নমুনা আহ্বান করা হয়। প্রকাশকদের নমুনার মধ্য থেকে বই বাছাই কমিটি ৯৬টি বইয়ের একটি তালিকা চুড়ান্ত করেছে। ওই তালিকায় লেখক মোহাম্মদ নাসির আলীর দুটি বই রয়েছে। দুটির মধ্যে একটি যষ্ঠ এবং অন্যটি অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য নির্বাচন করা হয়েছে।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে চূড়ান্ত হওয়া ৯৬টি বইয়ের মধ্যে ষষ্ঠ শ্রেণির জন্য ২০টি, সপ্তম শেণির জন্য ২০টি, অষ্টম শ্রেণির জন্য ২টি, নবম শ্রেনির জন্য ২০টি এবং দশম শ্রেণির জন্য ১৬টি বই রয়েছে। চূড়ান্ত তালিকায় থাকা বইগুলো আগামী প্রকাশনী থেকে চারটি, সময় প্রকাশনী থেকে চারটি, অধুনা থেকে একাটি, অনিন্দ্য থেকে দুটি, আদিত্য প্রকাশনী থেকে দুটি, কাকলি প্রকাশনী থেকে দুটি, প্রচালন থেকে একটি, আলোর ভুবন থেকে একটি, জীব্য প্রকাশনী ও তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠান থেকে তিনটি, তাম্রলিপি থেকে দুটি, সিদ্দিকীয়া প্রকাশনী থেকে দুটি, নওরোজ বিতাবিস্তান থেকে দুটি ও জাগৃতি প্রকাশনী থেকে দুটি বই কেনার কথা রয়েছে৷

প্রকাশকদের অভিযোগ, এ তালিকা তৈরিতে দুর্নীতি ও অনিয়ম করা হয়েছে। যার কারণেই বিতর্কিত এই লেখকের বই নির্বাচিত করা হয়েছে বলে মত তাদের। মানহীন বই সরবরাহ করে প্রকল্পের টাকা আত্মসাতের পরিকল্পনা করা হয়েছে মর্মে শতাধিক প্রকাশক স্বাক্ষরিত একটি চিঠিও দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে উচ্চ আদালতেও রিট করেছেন প্রকাশকরা।

অভিযোগ রয়েছে, প্রকল্পটির টাকা অত্মসাৎ করতে নামে-বেনামে কেনা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ও বিদেশি ভাষার বিভিন্ন বই। অথচ বইয়ের মানদণ্ড নিরুপণের শর্তে বলা হয়েছে, কোনো বিদেশি লেখকের বই বাছাই করতে পারবে না। যাদের অফিস নেই, শোরুম বা স্টল নেই-এমন ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠানের বই কেনা যাবে  না। বিদেশি ইংরেজি বই কেনা ঘাবে না। কিন্ত বাছাই কমিটি এসব নীতিমালার তোয়াক্কা না করেই বই চূড়ান্ত করেছে।

চূড়ান্ত করা হয়েছে, রিপ ভ্যান উইংকেল, অ্যলাইস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড, অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ড ইন এইটি ডের মতো বেশ কিছু বিদেশি বই। এসব বইয়ের বাংলা অনুবাদ নেই। সরাসরি ইংরেজি বই তালিকায় রাখা হয়েছে। আবার এসব বইয়ের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের নামও উল্লেখ করা হয়নি। নেই বইয়ের আকার, পৃষ্ঠা সংখ্যা, মুদ্রণ, বিষয়বস্তু, বিক্রয় মুল্যের তথ্যও।

নীতিমালার ভিত্তিতে জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলামকে চেয়ারম্যান করে ‘বই বাছাই কমিটি’ করা হয়। তবে তিনি মারা যাওয়ার পর বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মুহস্মদ নূরুল হুদাকে চেয়ারম্যান করা হয়। বাংলা একাডেমির সভাপতি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের চেয়ারম্যান আবু মো. দেলোয়ার হোসেন, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী, অধ্যাপক সৈয়দ আজিজুল হক, চারুকলা বিভাগের অধ্যাপক সুরমা জাকারিয়া চৌধুরীকে এ কমিটির সদস্য করা হয়।

এ বিষিয়ে জানতে চাইলে স্কিমের দায়িত্বে থাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক অধিদপ্তরের মাধ্যমিক উইংয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ বেলাল হোসাইন বলেন, 'বই বাছাই করতে একটি স্বনামধন্য প্যানেল তৈরি করে দেয়া হয়েছে। তারা বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে এই তালিকা তৈরি করেছেন বলে জানি। তালিকাটি মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন হয়ে আমাদের কাছে এসেছে। এই তালিকার সংযোজন বা বিয়োজনে আমাদের কোনো হাত নেই। আমরা শুধু স্কিমটি বাস্তবায়ন করছি।

বাছাই কমিটির বক্তব্য জানতে একাধিক সদেস্যের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও কেউই তাতে সাড়া দেননি। 

বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সৃজনশীল পুস্তক স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্যদের একাংশের বিরুদ্ধেও রয়েছে অভিযোগ। 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষার্থীদের দাবি নিয়মমাফিকভাবে জানানোর আহ্বান মাহফুজ আলমের - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের দাবি নিয়মমাফিকভাবে জানানোর আহ্বান মাহফুজ আলমের জামি’আ মাদরাসা দখলমুক্ত চেয়ে প্রধান উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ কামনা - dainik shiksha জামি’আ মাদরাসা দখলমুক্ত চেয়ে প্রধান উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ কামনা ৭ কলেজ নিয়ে পরিকল্পনা জানালেন শিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha ৭ কলেজ নিয়ে পরিকল্পনা জানালেন শিক্ষা উপদেষ্টা ই-রিকুইজিশনের সংশোধন অপশন চালু - dainik shiksha ই-রিকুইজিশনের সংশোধন অপশন চালু পদোন্নতি নিয়ে যে ব্যাখ্যা দিলো ইউজিসি - dainik shiksha পদোন্নতি নিয়ে যে ব্যাখ্যা দিলো ইউজিসি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা বোর্ডের নির্দেশনা - dainik shiksha শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা বোর্ডের নির্দেশনা ছাত্রাবাস খোলার দাবিতে পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ - dainik shiksha ছাত্রাবাস খোলার দাবিতে পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ট্রাম্প প্রশাসনে শিক্ষামন্ত্রী হচ্ছেন লিন্ডা ম্যাকমোহন - dainik shiksha ট্রাম্প প্রশাসনে শিক্ষামন্ত্রী হচ্ছেন লিন্ডা ম্যাকমোহন কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0032641887664795