শোনা যাচ্ছে, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার আগামী জাতীয় নির্বাচনে তাদের ইশতেহারে 'স্মার্ট বাংলাদেশ' গড়ার প্রতিশ্রুতি দেবে। একটি ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় এ সরকার অনেকটা সফল বলা চলে। তারা স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখাতেই পারেন।
আরেকটি নতুন বছর শুরু হতে আর মাত্র কয়দিন বাকি। শতাব্দীর ভয়াবহ আতংক করোনা মহামারি একদম শেষ না হলেও এখন পৃথিবীর মানুষ করোনার শংকা থেকে অনেকটাই মুক্ত। এ নিয়ে এখন আর কারো তেমন টেনশন নেই। ভ্যাকসিন আবিস্কৃত হবার পর থেকে আস্তে আস্তে করোনা ভীতি মানুষের মন থেকে দূর হতে শুরু করে। করোনা এখন কোনো মহামারি নয়, জ্বর-সর্দির মতো এক সাধারণ রোগে পরিণত হতে চলেছে। যদিও এটি থাক বা না থাক, এই গ্রহের মানুষকে এর খেসারত আরো বহুদিন দিয়ে যেতে হবে। এর আলামত আমরা ইতোমধ্যে দেখতে শুরু করেছি।
এক ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয় গোটা পৃথিবীকে গ্রাস করতে এগিয়ে আসছে। ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে পর্যন্ত মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা বেশ কঠিন হয়ে উঠেছে। খোদ ব্রিটেনে জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। খাদ্য, পানীয়, জ্বালানি ও বিদ্যুতের সংকট দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করছে। জিনিসপত্রের দাম লাগামহীন। এ পরিস্থিতিতে অনেকে বৈশ্বিক দুর্ভিক্ষের আশংকা করতে শুরু করেছেন। অর্থনৈতিক দুরবস্থার জন্য ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধকে একটি কারণ হিসেবে দাঁড় করানো যায় বটে, কিন্তু আপাতত বৈশ্বিক যে কোনো বিপর্যয়ের জন্য করোনা মহামারিকে সবচেয়ে বেশি দায়ী করতে হয়।
করোনাকালীন বিভিন্ন সময় লকডাউনের কারণে সারা পৃথিবীতে উৎপাদন ও বিপণন মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়েছে। দীর্ঘ সময় কলকারখানা বন্ধ থাকায় কর্মক্ষম মানুষ ঘরে বসে বেকার সময় কাটিয়েছেন। এভাবে দেশে দেশে অর্থনীতির চাকা দীর্ঘদিন অচল থেকেছে। আস্তে আস্তে এর বিরূপ প্রভাব সামষ্টিক ও ব্যক্তিক জীবনে প্রতিফলিত হতে শুরু করেছে। শিক্ষায় এ ধকল আরো বেশি। বিশেষ করে আমাদের দেশে শিক্ষা ক্ষেত্রে করোনা যে কী পরিমাণ ক্ষতি সাধন করেছে, তা অনুমান করাও এক কঠিন কাজ। শিক্ষার এই ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে আরো কতদিন সময় লাগে, তা কেউ জানে না। এর আগে শিক্ষায় এ রকম দুর্দিন গেছে বলে আমাদের জানা নেই।
উন্নত বিশ্বের দেশগুলো সময়োপযোগি কর্ম পরিকল্পনা নিয়ে শিক্ষায় করোনার ঘাটতি অনেকটা পুষিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। করোনার সামগ্রিক ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে সকলেই প্রাণান্ত প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। অতীতের সব বিপর্যয়ের ন্যায় পৃথিবীর মানুষ সম্মিলিতভাবে এই দুঃসময় নিশ্চয়ই একদিন কেটে উঠতে সক্ষম হবে।
আমাদের মতো দেশে করোনা উত্তর সময়ে এর ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে তাৎক্ষণিক আরো বেশি উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন ছিলো। বিশেষ করে শিক্ষা ক্ষেত্রে সরকারের একটি মেগা পরিকল্পনা হাতে নেয়া দরকার ছিলো। কিন্তু, এরকম কোনো উদ্যোগ আজ পর্যন্ত দৃশ্যমান হয়নি। অধিকন্তু, শিক্ষায় কখনো কখনো কিছু হঠকারি সিদ্ধান্ত আমাদের বিস্মিত করে তোলে।
প্রসঙ্গত, প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার কথাই বলা যাক। সম্প্রতি এই পরীক্ষার বিষয়ে সরকারি সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট সবাইকে অবাক করেছে। বিষয়টি আরো দু'চার মাস আগে জানালে কী হতো? ডিসেম্বর মাসের ২৯ তারিখে বৃত্তি পরীক্ষা। মাত্র বিশ-পঁচিশ দিন হাতে রেখে সিদ্ধান্ত নেবার কারণটি খুঁজে পাইনা। শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবক সবাই শেষ মুহূর্তের এমন সিদ্ধান্তে বিস্মিত হয়েছেন। আমি ভেবে পাইনা, মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের লোকজন এ রকম গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে এতো দেরিতে সিদ্ধান্তে গেলো কেনো? অন্তত ২/৪ মাস আগে সিদ্ধান্ত নিয়ে সবাইকে জানিয়ে দেয়া উচিত ছিলো। সারা বছর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর কী কাজ করেছে? বসে বসে ঘোড়ার ঘাস কেটেছে মনে হয়।
সম্প্রতি আরেকটি বিষয় অনেকের মনে বিস্ময় জাগিয়েছে। গত দুই-তিন বছর করোনার কারণে সরকারি-বেসরকারি কোথাও কোনো নিয়োগ হয়নি। প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের ভাইভা শেষ হবার প্রায় ছয় মাস হতে চলেছে। আজ রেজাল্ট, কাল রেজাল্ট করে করে দিনের পথে দিন চলে যাচ্ছে। এই নিয়োগটা দ্রুত দিয়ে দিতে পারলে একদিকে অনেক শিক্ষিত বেকার মেধাবীর কর্মসংস্থান হতো, অন্যদিকে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক স্বল্পতা কিছুটা হলেও কমে যেতো। এটি ঝুলিয়ে রেখে কেউ কোনো রকম বাণিজ্য শুরু করে দিয়েছে কিনা, কে জানে? কোনো কোনো সময় একেকটা নিয়োগে হাজার কোটি টাকা বাণিজ্য হয়। এসব বাণিজ্যের কারণে মেধাবীরা ছিঁটকে পড়ে। কম মেধাবীরা নিয়োগ পেয়ে বসে। এভাবে শিক্ষকতার মতো মহান পেশাটি অযোগ্যদের দখলে চলে যায়। এরা ঠিক মতো ছাত্রছাত্রীদের পড়াতে পারেন না। সঠিকভাবে পরীক্ষায় প্রশ্ন করতে পারেন না। খাতা মূল্যায়ন করতে জানেন না। এরা দক্ষ ও যোগ্য নাগরিক কীভাবে তৈরি করবেন?
আরেকটি বিষয় আমার বোধগম্য হয় না। বর্তমানে যে নিয়োগটি হবে সেটির সার্কুলার অনেকদিন আগের। তখন শূন্য পদের সংখ্যা অনেক কম ছিলো। এখন আরো অনেক নতুন পদ শূন্য হয়েছে। একেকটা নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করতে বহুদিন লাগে। তাই বর্তমানে বিদ্যমান সব শূন্যপদ নিয়োগ প্রত্যাশীদের মধ্য থেকে পূরণ করতে সমস্যা কোথায়? সিনিয়র সচিব মো. আমিনুল ইসলাম খান অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ভালো পরীক্ষা নিয়েছেন। যারা লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মৌখিক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েছেন, প্রয়োজনে তাদের সবাইকে নিয়োগ দিয়ে সব শূন্য পদ পূরণ করে দেয়া যায় না?
আইনের ফাঁক ফোঁকর খুঁজে লাভ নেই। সরকারি লোকেরা আইনের ফাঁক ফোঁকর খোঁজে। রাজনীতিবিদরাও কম যান না। এতে তাদের লাভ রয়েছে। সব পদ পূরণ করে লোক থাকলে অপেক্ষমান তালিকা করে রাখা হোক। যখন কোথাও কোনো পদ খালি হবে, তখন তাদের থেকে নিয়োগ দিয়ে দেবার ব্যবস্থা থাকলে ভালো হয়। তা না হলে সারা জীবন কেবল নিয়োগ দিয়েই যেতে হবে। নিয়োগ বাণিজ্য কোনোদিন বন্ধ করা যাবে না। একটা পরিপত্র দিয়ে সম্ভব হলে নিয়োগ প্রত্যাশী যারা ভাইভা পর্যন্ত দিয়েছেন, তাদের দিয়ে বর্তমানে বিদ্যমান শূন্য পদগুলো পূরণ করে দিলে ভালো হবে।
এদিকে এনটিআরসিএ বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে কী একটা অযথা ঝামেলা সৃষ্টি করে চলেছে। জন্ম থেকে তাদের সব কাজে হ-য-ব-র-ল অবস্থা। নিবন্ধিত বেকার তৈরির কারখানায় পরিণত হয়েছে রাষ্ট্রীয় এই প্রতিষ্ঠান। সব নিবন্ধনধারীর নিয়োগের ব্যবস্থা করা তাদের নৈতিক দায়িত্ব হলেও তারা তা করে না। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা সত্ত্বেও ১৩তম নিবন্ধনধারীদের নিয়োগ না দিয়ে এর বিরুদ্ধে আপীল করছে। অথচ নিয়োগ পাওয়ার আশায় অনেক নিবন্ধনধারী পরিবার পরিজন নিয়ে হতাশার মধ্যে বেঁচে আছেন। গতবার ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের শূন্য পদের বিপরীতে আবেদনের সুযোগ দিয়ে এবার তা বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়ায় ইনডেক্সধারী শিক্ষকরা আন্দোলনে নামার কথা ভাবছেন। শিক্ষকদের ক্ষেপিয়ে লাভ কী? আমরা বহুদিন ধরে শিক্ষকদের বদলি চালু করার কথা বলে আসছি। কিন্তু, কে শোনে কার কথা? বদলি চালু করা এ সময়ের একটি বড়ো দাবি। চতুর্থ গণবিজ্ঞতি দেবার কথা বেশ কিছুদিন থেকে শোনা যাচ্ছে। কিন্তু, দেয়া হচ্ছে না কেনো ? এনটিআরসিএ কোথাও আটকা পড়ে গেছে বলে মনে হয়।
নতুন বছরে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হতে যাচ্ছে। শিক্ষায় যখন নতুন কিছু আসে, তখন আশায় সবার বুক ভরে ওঠে। কিন্তু, শেষ পর্যায়ে দেখা যায়, সব আশায় গুঁড়ে বালি। সুফল পাওয়ার আগেই সেটি বাদ দিয়ে আরেকটা পদ্ধতি চালু করার দৌঁড়ঝাপ শুরু হয়ে যায়। সৃজনশীল পদ্ধতির বেলায় তাই তো হয়েছে। নতুন শিক্ষাক্রমে জাতীয় শিক্ষানীতি কতটুকু প্রতিফলিত হয়েছে জানি না। জাতীয় শিক্ষানীতি নিয়ে এখন আর কেউ কথা বলেন না। আমাদের দেশে কতবার কতো শিক্ষানীতি হয়েছে। কিন্তু, বাস্তবায়নের বেলায় আমরা একেবারে নিশ্চুপ। শিক্ষায় কতো পরিকল্পনা আর প্রজেক্টের কথা শুনতে পাই। একেকটা প্রজেক্টে কোটি কোটি টাকা থাকে। এক সময় সব টাকা পানিতে খেয়ে যায়।
বলছিলাম, নতুন শিক্ষাক্রমের কথা। এটি বাস্তবায়নে শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। অনলাইনের প্রশিক্ষণ কয়জনে নিজে নিজে করেন? কেউ কেউ বন্ধুবান্ধব, ছেলেমেয়ে অথবা সহকর্মীদের দিয়ে করিয়ে নেন। তাই অনলাইন নয়, সরাসরি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষকদের নতুন শিক্ষাক্রমের ওপর পারদর্শী ও আধুনিক করে তুলতে হবে। স্মার্ট শিক্ষক ছাড়া নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন একদম সম্ভব নয়।
শিক্ষকদের প্রতি আগে মনোযোগ দিতে হবে। তাদের জীবনমান উন্নত করতে হবে। শিক্ষকদের উন্নত চিন্তা চেতনায় জাগ্রত করতে পারলে শিক্ষাক্রম সফল করা কঠিন কোনো কাজ নয়। এক হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া আর পাঁচশত টাকা চিকিৎসা খরচ দিয়ে আর যাই হোক স্মার্ট শিক্ষক তৈরি করা অসম্ভব। শিক্ষকদের প্রতি সুনজর না দেবার কারণে অতীতের সিলেবাস ও কারিকুলামের মতো নতুন শিক্ষাক্রম ব্যর্থতায় পর্যবসিত হোক, তা আমরা চাই না।
আরেকটি বিষয়ে সামান্য আলোকপাত করে লেখাটি শেষ করতে চাই। সেটি হলো পাঠ্যপুস্তক প্রসঙ্গ। অতীতে দেখেছি, নতুন সিলেবাস ও কারিকুলামের আলোকে এনসিটিবি যে সব পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করে থাকে, তাতে অনেক অসঙ্গতি ও ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে যায়। এ বিষয়ে এনটিসিবিকে আরো যত্নবান ও দায়িত্বশীল ভুমিকা পালন করতে হবে। একটু ভালো মানের কাগজে পাঠ্যপুস্তক ছাপানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। আর হ্যাঁ, পাঠ্যপুস্তকে যেনো বিতর্কিত কোনো বিষয় ঢুকিয়ে দেয়া না হয়। অতীতে এরকম অনেক খামখেয়ালি কাজ হয়েছে। যারা এসব করেছে, জানি না তাদের কোনদিন কোনো শাস্তি হয়েছে কীনা? পাঠ্যপুস্তকে আর যেনো কোনো বিতর্কিত বিষয় সংযোজনের অবকাশ তৈরি না হয়। কেউ করে থাকলে তার কঠিন শাস্তির বিধান থাকা চাই। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলতে আমরা অধীর আগ্রহে শিক্ষায় একটি নতুন সূর্যোদয়ের অপেক্ষায় আছি।
লেখক : আবাসিক সম্পাদক (লন্ডন), দৈনিক শিক্ষাডটকম