আধুনিক ‘ই-লার্নিং’ এর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে সারাবিশ্বে পরিচিত ড. বদরুল হুদা খান উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন বাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ব্লেন্ডেড লার্নিং ন্যাশনাল টাস্কফোর্সে। চার দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত চট্টগ্রামের এই সন্তানের ই-লার্নিং বই আমেরিকা, ইউরোপসহ বিশ্বের ২৩টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। অধ্যাপনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব টেপাস ও জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতে।
প্রশ্ন: আপনার জন্ম, বেড়ে ওঠা এবং শিক্ষাজীবন নিয়ে কিছু বলুন।
বদরুল হুদা খান: আমার বাড়ি চট্টগ্রামের পাঠানটুলী খানবাড়িতে। আমার বাবার নাম লোকমান খান শেরওয়ানী এবং মায়ের নাম শবনম খান শেরওয়ানী। দু’জনই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের কর্মী ছিলেন। লোকমান খান শেরওয়ানী নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর অধীনে নিখিল ভারত ফরোয়ার্ড ব্লকের প্রাদেশিক সহসভাপতি হিসেবে দায়িত্ব
প্রশ্ন: আপনার কর্মজীবন সম্পর্কে জানতে চাই।
বদরুল হুদা খান: ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জনের পরপরই ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসের ব্রাউনসভিল ক্যাম্পাসে এডুকেশনাল টেকনোলজি প্রোগ্রামে আমি সহকারী অধ্যাপক ও প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হিসেবে যোগদান করি। ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দ আমার প্রথম বই ‘ওয়েব বেজড ইনস্ট্রাকশন’ প্রকাশিত হয়, যা তখনই ৩৫০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবহৃত হয়। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে নামকরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট স্কুলে বইটি রেফারেন্স ও পাঠ্যবই হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ১৯৯৬-এর আগস্টে আমি ওয়াশিংটনে জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির এডুকেশনাল টেকনোলজি লিডারশিপ প্রোগ্রামে সহযোগী অধ্যাপক ও প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পাই। ২০০৭খ্রিষ্টাব্দ ইউনিভার্সিটির কাজ শেষ করে অনেকটা কনসাল্টিং পেশায় চলে যাই। ইতোমধ্যে আমার অনেক বই বের হয়েছে। সেগুলোর কারণেই দেশ-বিদেশে বিভিন্ন ফোরামে বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ পাই।
প্রশ্ন: আপনার উদ্ভাবিত ই-লার্নিং ও ব্লেন্ডেড লার্নিং নিয়ে কিছু বলবেন?
বদরুল হুদা খান: যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইংল্যান্ড, নরওয়ের মতো ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর এক ই-লার্নিং কনফারেন্সে আমাকে আধুনিক ই-লার্নিংয়ের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এখন ই-লার্নিং কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অজানা কিছু নয়। এটা হচ্ছে ইলেকট্রনিক ডিভাইসের মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণের পদ্ধতি। আর ব্লেন্ডেড লার্নিং হচ্ছে দুটো শিক্ষা পদ্ধতির মিশ্রণ। অর্থাৎ অনলাইন ও ফিজিক্যাল লার্নিংয়ের অর্থপূর্ণ সংমিশ্রণ। কোনো কোনো বিষয় শিখতে হলে ক্লাসে যেতে হয়। আবার হাতেকলমে শিখতে হলে যেতে হবে ল্যাবে। কিছু অংশ অনলাইনে ই-লার্নিং পদ্ধতিতে শেখানো যাবে।
প্রশ্ন: এই শিক্ষা পদ্ধতি বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় কী পরিবর্তন আনবে বলে আপনি মনে করেন?
বদরুল হুদা খান: বিশেষত কভিড-১৯ এর সময় প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত অনলাইনে শিক্ষা গ্রহণ ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। এখন শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়েই অনলাইনে শিক্ষাদান ও শিক্ষা গ্রহণে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। তারা গুগল বা উইকিপিডিয়াতে গিয়ে অনেক কিছুই শিখে যাচ্ছেন। শিক্ষার্থীরা তাদের আইডিয়া ক্লাসে এনে শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করে অনেক কিছুই শিখছে। তবে আমাদের একটু সাবধান থাকতে হবে, তারা যা শিখছে তা সঠিক কিনা এবং সঠিকভাবে শিখছে কিনা। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের আমি আমার ব্লেন্ডেড লার্নিং মডেলের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। বাংলাদেশ সরকারের ন্যাশনাল ব্লেন্ডেড লার্নিং টাস্কফোর্সের একজন উপদেষ্টা হিসেবে আমি শিক্ষকদের বোঝাতে চেষ্টা করছি কোন বিষয় অনলাইনে আর কোন বিষয় অবশ্যই ক্লাসরুমে বা প্র্যাকটিক্যালি পড়াতে হবে।
প্রশ্ন: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে আপনার উদ্ভাবিত পদ্ধতি কীভাবে সহায়তা করতে পারে?
বদরুল হুদা খান: আমার বাংলা ই-লার্নিং বইয়ের মডেলকে স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বিবেচনা করেই তৈরি করা হয়েছে। যেমন– স্মার্টের ‘এস’ মানে সাসটেইনেবল বা টেকসই। অর্থাৎ যা পড়ছে তা সারাজীবন মনে রেখে কাজে লাগাতে পারবে কিনা। ‘এম’ মানে মোটিভেটিং– অনুপ্রেরণামূলক শিক্ষাব্যবস্থা। ‘এ’ মানে অ্যাডাপ্টেবল– নতুনত্বে মানিয়ে নেওয়া। ‘আর’ অর্থ রেজাল্ট ওরিয়েন্টেড বা ফলভিত্তিক। ‘টি’ মানে টেকনোলজি এনাবল্ড বা প্রযুক্তিসক্ষম। স্মার্ট বাংলাদেশ হবে সম্পূর্ণ প্রযুক্তিনির্ভর। তাই বাংলাদেশকে স্মার্ট করতে হলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে স্মার্ট করতে হবে। আর শিক্ষাব্যবস্থাকে স্মার্ট করতে হলে দেখতে হবে সেটা টেকসই কিনা, অনুপ্রেরণামূলক কিনা, গ্রহণযোগ্য কিনা, ফল সন্তোষজনক কিনা, এতে প্রযুক্তির ব্যবহার আছে কিনা। স্মার্ট লার্নিংয়ে যখন সবাই শিক্ষা গ্রহণ করবে তখন স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনও সহজতর হবে।
প্রশ্ন: এ বিষয়ে বাংলাদেশের শিক্ষকরা কীভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হচ্ছেন এবং প্রয়োগ করছেন?
বদরুল হুদা খান: গত ছয় মাস আগে আমি বাংলাদেশে ছিলাম! এটুআইর তত্ত্বাবধানে আমি এবার বাংলাদেশের খুলনা, রাজশাহী, বরিশালসহ বিভিন্ন ডিভিশনে গিয়ে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি। তাদের দেখিয়ে দিয়েছি কোন অংশগুলো অনলাইনে পড়লে সুবিধা পাবে, আর কোন অংশ ক্লাসরুমে পড়তে হবে। যেমন যিনি ডাক্তার হবেন তাঁকে তো সার্জারির বিষয়টি ফিজিক্যালি অপারেটিং টেবিলে হাতেকলমে দেখাতে হবে। আর অনলাইনে তাঁকে দেখতে হবে যে কীভাবে একজন এক্সপার্ট ডাক্তার ওটা করেছেন। এটাকে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে বলে ফ্লিপড ক্লাসরুম। অর্থাৎ ক্লাসে পড়ানোর আগে শিক্ষার্থীদের সবকিছু ভিডিওতে দেখে আসতে হবে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশ সরকার আপনার এই পদ্ধতির মূল্যায়ন গ্রহণ করেছে কি?
বদরুল হুদা খান: প্রথমত, বাংলাদেশ সরকার আমার বাংলা বই ই-লার্নিং বের করেছে। এখন বাংলাদেশ সরকারের ন্যাশনাল কারিকুলামের আওতায় নবম-দশম শ্রেণির ইংরেজি পাঠ্যপুস্তকে আমাকে নিয়ে ফিচার করেছে। শিক্ষামন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ব্লেন্ডেড প্ল্যানিং টাস্কফোর্সে আমিই একমাত্র প্রবাসী বাংলাদেশি।
প্রশ্ন: অন্যান্য দেশে আপনার পদ্ধতি কীভাবে গৃহীত হয়েছে?
বদরুল হুদা খান: আমার বই থাই, চায়নিজ, কোরিয়ান, ইতালিয়ান, আরবিসহ ২৩টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বইগুলো অনুবাদের ক্ষেত্রে আমরা গুগল ট্রান্সলেট করি না। আমার সঙ্গে ডাইরেক্ট করেসপন্ডিংয়ের মাধ্যমে ওই ভাষায় ট্রান্সলেট করতে বছর দুই-তিনেক লাগে। কারণ ওই দেশ বা অঞ্চলের শিক্ষা-সংস্কৃতি, ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় নিয়মকানুন, শিক্ষানীতি, কি সাইন-সিম্বল, সেনসিটিভিটি, ভাষার স্টাইল ও টেকনোলজির অবকাঠামোর সঙ্গে সংগতি রেখে বইগুলো অনূদিত, যাতে সেগুলো তাদের জন্য অর্থপূর্ণ ও যুগোপযোগী হয়। বিভিন্ন দেশের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা থেকে আমি যে অভিজ্ঞতা অর্জন করি, তা বাংলাদেশের প্রত্যন্ত স্কুল, মাদ্রাসা, ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকদের সঙ্গে শেয়ার করি। আবার বাংলাদেশের অবস্থান ও অবকাঠামো যেভাবে আছে সেভাবেই আমাদের কাজ করতে হবে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে আপনার পরিকল্পনা কী?
বদরুল হুদা খান: বাংলাদেশের এটুআই প্রকল্পের এক কর্মকর্তা আমাকে ঢাকার পাশে গাজীপুরে স্থাপিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটির ‘এডুকেশনাল টেকনোলজি’ প্রোগ্রামে কাজ করার প্রস্তাব দিয়েছেন। আমি ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস ও জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতে একই প্রোগ্রামের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও অধ্যাপক ছিলাম। বঙ্গবন্ধু ডিজিটাল ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি। তিনি সম্মানিত প্রফেসরশিপের (ডিস্টিঙ্গুইশড প্রফেসর) জন্য আমাকে বিবেচনা করেছেন। আমাকে যদি সুযোগটা দেওয়া হয় তাহলে আমি বাংলাদেশে এডুকেশনাল টেকনোলজিটা পড়াব। আমার ইচ্ছা রয়েছে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের বিশ্বমানের করে গড়ে তোলা। ব্যক্তিগত জীবনে আমি বিশ্বের বহু দেশ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের ট্রেনিং দিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরিতে সহায়তা করব।
প্রশ্ন: আপনাকে ধন্যবাদ।
বদরুল হুদা খান: আপনাকেও।
সূত্র : ৩১ আগস্ট ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ, দৈনিক সমকাল