অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির অন্বেষণে, একটি জাতির সবচেয়ে বড় সম্পদ তার মানব পুঁজি। একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস এবং একটি প্রতিশ্রুতিশীল ভবিষ্যতের দেশ হিসেবে বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। বর্তমানে বাংলাদেশ ডিজিটাল বাংলাদেশের সোপান পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে ধাবমান। আর স্মার্ট বাংলাদেশের অন্যতম ভিত্তি হলো স্মার্ট নাগরিক। স্মার্ট বাংলাদেশের প্রত্যাশিত নাগরিক গড়ে তুলতে হলে আমাদের শিক্ষার্থীদেরকে সার্বিকভাবে চৌকস হয়ে ওঠতে হবে। একটি উজ্জ্বল আগামীর পথ প্রশস্ত করতে স্মার্ট নাগরিক বিনির্মাণের লক্ষ্যে আজকের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা এবং বিকাশে বিনিয়োগ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যারা একটি স্মার্ট বাংলাদেশের স্থপতি হবে।
স্মার্ট শিক্ষার্থীরা কেবল একাডেমিকভাবে পারদর্শী নয়; তারা জ্ঞানের জন্য উন্মুখ, সৃজনশীল চিন্তন দক্ষতায় পারদর্শী এবং দ্রুত পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে অভিযোজনযোগ্যতা সম্পন্ন বৈশ্বিক নাগরিক। আজকের দ্রুত বিকাশমান বিশ্বে অগ্রগতির জন্য এই গুণগুলো অর্জন করা শিক্ষার্থীদের জন্য অপরিহার্য। স্মার্ট শিক্ষার্থীরা উদ্ভাবন, অর্থনৈতিক সম্মৃদ্ধি এবং সামাজিক উন্নয়নের অনুঘটক।
প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবন দ্বারা চালিত এ যুগে স্মার্ট ছাত্ররা পরিবর্তনের অগ্রভাগে রয়েছে। বাংলাদেশ যে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে তার অত্যাধুনিক সমাধান এবং বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় কৌতূহল এবং সৃজনশীলতা তাদের আছে। কৃষি কাজের উন্নতি থেকে টেকসই শক্তি সমাধান তৈরি করা পর্যন্ত স্মার্ট ছাত্ররা প্রযুক্তিগত অগ্রগতির পেছনে চালিকা শক্তি যা জাতিকে পরিবর্তন করতে পারে।
চৌকস কর্মীবাহিনী একটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। শিক্ষিত এবং দক্ষ ব্যক্তিদের ভালো বেতনের চাকরি সুরক্ষিত করার সম্ভাবনা বেশি, যার ফলে ভোক্তাদের ব্যয় এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়। এ দেশের সম্ভাবনাময় শিক্ষার্থীদের যথাযথ বিকশিত করার মাধ্যমে বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক সম্ভাবনা উন্মোচন করতে পারে এবং দারিদ্র্য হ্রাস করতে পারে, সবার জন্য আরো সমৃদ্ধ সমাজ তৈরি করতে পারে।
স্মার্ট শিক্ষার্থীরা হবে সমস্যা সমাধানকারী, আমাদের সবার ভরসা রাখার নির্ভরযোগ্য প্রজন্ম। তারা জটিল সমস্যাগুলো বিশ্লেষণ করার, তাদের পরিচালনাযোগ্য উপাদানগুলিতে বিভক্ত করার এবং কার্যকর সমাধান বের করে আনার ক্ষমতা সম্পন্ন। কৃষির উন্নয়ন, পরিবেশগত উদ্বেগ মোকাবিলা করা, প্রযুক্তি উদ্ভাবন, স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার উন্নতি, নতুন নতুন গবেষণা, অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস ইত্যাদি ক্ষেত্রে স্মার্ট শিক্ষার্থীরা জাতির উপকার করে এমন নীতি ও উদ্যোগ গঠনে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে।
বৈশ্বিক মঞ্চে প্রতিযোগিতার জন্য বাংলাদেশকে অবশ্যই এমন গ্র্যাজুয়েট তৈরি করতে হবে যারা আন্তর্জাতিক চাকরির বাজারে নিজ নিজ যোগ্যতায় স্থান করে নিতে পারবে। শক্তিশালী বিশ্লেষণাত্মক এবং যোগাযোগ দক্ষতার সঙ্গে স্মার্ট ছাত্ররা বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে পারবে। বিদেশি বিনিয়োগ, বাণিজ্যের সুযোগ এবং অংশীদারিত্ব আকর্ষণ করার জন্য আরো ভালভাবে নিজেদেরকে সজ্জিত করতে পারবে।
একটি স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে সরকার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং অভিভাবকসহ বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
প্রাথমিক থেকে টারশিয়ারি পর্যায় পর্যন্ত সব স্তরে শিক্ষার মান উন্নয়নে আরো অধিক বিনিয়োগ নিশ্চিত করা একান্তভাবে কাম্য। এর মধ্যে রয়েছে বর্তমান শিক্ষকদের অর্থ-সামাজিক মর্যাদা যথাযথ উন্নীতকরণ, পর্যাপ্ত মেধাবী দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ, বর্তমান চাহিদা পূরণের জন্য পাঠ্যক্রম আপডেট করা এবং আধুনিক শিক্ষার সংস্থান ও প্রযুক্তিতে অ্যাক্সেস প্রদান।
পাসমুখী শিক্ষাব্যবস্থার খোলনলচে পাল্টে বিশ্লেষণধর্মী চিন্তাভাবনাকে উন্নীতকরণ এবং সমস্যা সমাধানের দক্ষতার ওপর গুরুত্ব প্রদান করে এমন বিশ্বমানে নিয়ে যেতে হবে। শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করতে, বিশ্লেষণ করতে এবং ধারণাগুলো স্বাধীনভাবে অন্বেষণ করতে অনুধ্যানী করে এমন শিখন পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
আধুনিক কর্মশক্তির জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতায় শিক্ষার্থীদের সজ্জিত করার জন্য বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিত (এসটিইএম) শিক্ষার প্রচলন করা এখন যুগের দাবি। স্মার্ট শিক্ষার্থী হিসেবে বিকশিত করার জন্য ছোটবেলা থেকেই এ ক্ষেত্রগুলোতে আগ্রহ বাড়ানোর জন্য এসটিইএম কেন্দ্র এবং প্রোগ্রামগুলো সূচনা করা দরকার ।
বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা এবং দলগত দক্ষতা বাড়াতে রোবোটিক্স, বিতর্ক ক্লাব, ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাব এবং কোডিং প্রতিযোগিতার মতো পাঠক্রম বহির্ভূত কার্যকলাপে অংশগ্রহণের ক্ষেত্র সৃষ্টি করা প্রয়োজন।
বিশেষত গ্রাম অঞ্চলের পিতামাতাদের শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে প্রশিক্ষিত করে তোলা এবং তাদের সন্তানদের শেখার যাত্রায় করণীয় সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ বাড়ানো প্রয়োজন । বাড়িতে একটি অনুকূল শিক্ষার পরিবেশ তৈরিতে পিতামাতাকে সাহায্য করার ক্ষেত্রটি এখনো উপেক্ষিত । তারা হয়তো জানেন তাদের সন্তানদের লেখাপড়া করানো উচিত কিন্তু তারা জানেন না যে কীভাবে তা করাতে হবে অথবা বাড়িতে তাদের করণীয় কী।
স্মার্ট ছাত্রদের তাদের পছন্দসই ক্ষেত্রে সফল পেশাদারদের সঙ্গে সংযুক্ত করার জন্য মেন্টরশিপ প্রোগ্রাম চালু করা প্রয়োজন। মেন্টরশিপ উচ্চাকাঙ্ক্ষী শিক্ষার্থীদের জন্য নির্দেশনা এবং অনুপ্রেরণা প্রদান করতে পারে।
স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য শিক্ষার্থীদের সার্বিকভাবে সহায়তা প্রদান একটি বিকল্প নয়, বরং অতীব প্রয়োজনীয়তার মধ্যে অন্যতম । উন্নত প্রযুক্তি, শক্তিশালী অর্থনীতি এবং বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় স্মার্ট বাংলাদেশ হওয়ার দিকে জাতিকে নেতৃত্ব দেয়ার সম্ভাবনা আমাদের তরুণদের রয়েছে। মানসম্পন্ন শিক্ষাখাতে সম্মানজনক বিনিয়োগ করে এবং প্রয়োজনীয় সুযোগ প্রদান করে, বাংলাদেশ তার সব নাগরিকের জন্য একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যত গড়ে তুলতে এদেশের তরুণদের শক্তিকে কাজে লাগাতে পারে। আজকের স্মার্ট শিক্ষার্থীরাই আগামী দিনের স্বপ্নদর্শী নেতা এবং তাদের যথাযথ বিকাশেই বাংলাদেশ বিশ্ব মঞ্চে গৌরবের আসন অর্জন করতে পারে।
লেখক: প্রধান শিক্ষক, ঘোড়াশাল পাইলট হাই স্কুল, নরসিংদী