হাত-পা অকার্যকর, মুখে লিখেই গ্র্যাজুয়েট হাফিজ

জবি প্রতিনিধি |

হাত, পা অকার্যকর! মুখ দিয়ে লেখেই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করেছেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তনে অন্যদের মত হাফিজ ভাইও গাউন পড়েছেন। হার না মানা অদম্য জবিয়ান!— এ কথাগুলো লিখে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের টাইমলাইনে শেয়ার করছেন অনেকে।

প্রতিষ্ঠার ১৪ বছর পর শনিবার প্রথমবারের মতো সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। এতে প্রায় ১৯ হাজার গ্র্যাজুয়েট অংশ নিয়েছেন। সমাবর্তন ঘিরে উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে পুরো ক্যাম্পাসে, যার প্রভাব দেখা গেছে পুরান ঢাকায়ও। এই সমাবর্তনে গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি নিয়েছেন হাফিজও। কিন্তু অন্য দশজনের চেয়ে ভিন্ন তিনি। কেননা হাত দিয়ে নয় তাকে লিখতে হয়েছে মুখের সাহায্যে। আর চলাফেরা করতে প্রয়োজন হুইল চেয়ার। তাই তাঁর গল্পটাও বেশ সংগ্রামী।

হাফিজ ভাই ক্যাম্পাসের পরিচিত একটি মুখ। বিশ্ববিদ্যালেয় আঙিনায় তার সরব উপস্থিতি। স্নাতকের পাঠ চুকিয়েছেন বছর দুয়েক আগে। তারপরও ক্যাম্পাস ছাড়তে পারেননি। কারণ পেটের দায়। ক্যাম্পাসে ভাসমান স্টলে বিক্রি করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের লগো সম্বলিত বিভিন্ন ব্যাগ, টি-শার্ট এবং সোয়েটারসহ মৌসুমভিত্তিক পোশাকও। সেই সুবাদে শিক্ষার্থীদের ‘প্রিয় হাফিজ ভাই’ বনে যান।

জন্মগতভাবেই বিকল দুই হাত ও দুই পা। অন্যের সাহায্য ছাড়া যে ছেলেটি এক স্থান থেকে অন্য স্থানেই যেতে পারে না, সেই কিনা মুখে কলম ধরেই সম্মানের সহিত অতিক্রম করেছে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। বিকল দুই হাত ও দুই পা নিয়ে ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দে বগুড়ার ধুনট উপজেলার বেলকুচি গ্রামের এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম নেন হাফিজুর রহমান। বাবা পক্ষাঘাতের রোগী মো. মফিজ উদ্দিন পেশায় সাধারণ কৃষক, মা ফিরোজা বেগম গৃহিণী।

ছোটবেলায় বাবার কাছেই ‘বর্ণ পরিচয়’ শেখা হাফিজুরের। মূলত সুশিক্ষিত হবার প্রয়াস সেখান থেকেই। বাড়ি থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে ব্র্যাক স্কুলে শুরু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন। সে সময় বেয়ারিংয়ের গাড়িতে করে সহপাঠীরা স্কুলে নিয়ে যেত তাকে। এভাবেই স্কুলে যাওয়া-আসার মধ্যে ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে মানবিক বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৪ দশমিক ১৯ পেয়ে উত্তীর্ণ হন জ্ঞানপিপাসু হাফিজুর। তারপর অত্র উপজেলার ধুনট ডিগ্রি কলেজ থেকে ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে এইচএসসিতে জিপিএ ৩ দশমিক ৬০ পেয়ে উত্তীর্ণ হন তিনি।

২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে কোনও ভর্তি কোচিং না করেই জবির ভর্তি পরীক্ষায় মেধাতালিকায় স্থান করে নেন হাফিজুর। ভর্তি হন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে। তখন থেকেই অচেনা এই নগরীতে একাকী সংগ্রাম করে যাচ্ছেন তিনি। পরীক্ষার হলে মেঝেতে পাটিতে বসে ছোট টুলে খাতা রেখে মুখ দিয়ে লিখে পরীক্ষা দিয়ে গেছেন এই শিক্ষার্থী।

ছোটবেলা থেকেই নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেয়া হাফিজুরের পড়ালেখা ও যাবতীয় ভরণপোষণ হয়েছে পরনির্ভশীলতায়। মাঝে সরকারের দেয়া প্রতিবন্ধী ভাতা, গ্রামের লোকজনের সাহায্য সহযোগিতা ও ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের টিউশনি করিয়ে নামমাত্র অর্থ উপার্জন করেছেন। চার ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট তিনি। বিয়ে করে সংসার নিয়ে ব্যস্ত হাফিজের তিন ভাই। তারাও কৃষি কাজ করেই নিজ নিজ সংসার চালাচ্ছেন।

বর্তমান চাকরির বাজারে একটি কর্মসংস্থান জোটানো চারটি খানি কথা নয়। এর মধ্যে শারীরিক চ্যালেঞ্জও রয়েছে। কিন্তু পেট তা বুঝে না। তাই অন্য কিছু জোটার আগে প্রিয় ক্যাম্পাসে বসে কিছু উপার্জনের চেষ্টা করছেন হাফিজ। এদিকে সমাবর্তন উপলক্ষ্যে ক্যাম্পাসে ঢল নেমেছে সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের। কিন্তু তাদের প্রিয় হাফিজ ভাইয়ের স্টলটি নেই। অনেকে শীতের সোয়েটার বা প্রিয় ক্যাম্পাসের লোগো সম্বলিত টি-শার্ট কিনতে চাইলেও সম্ভব হয়নি। কারণ সমাবর্তন উপলক্ষে হাফিজের স্টলটি বসতে দেইনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডি।

সমাবর্তনে অংশ নিতে সূদুর কক্সবাজার থেকে এসেছেন সাবেক শিক্ষার্থী সুহাইল মাহফুজ। তার একান্ত ইচ্ছা ছিল— প্রিয় হাফিজ ভাইয়ের কাছ থেকে জবির লোগো সম্বলিত একটি টি-শার্ট সংগ্রহ করবেন। কিন্তু তা আর হলো না বলে জানান তিনি। এদিকে সমাবর্তনের পর ফের ভাসমান স্টলটি বসাতে হাফিজকে নিষেধ করেছে জবি প্রশাসন। এই নিয়ে তার মাঝে বিরাজ করছে আরেক অজানা ভয়।

তিনি গণমাধ্যকে আরও বলেন, বন্ধুরা যখন লাইব্রেরিতে বসে চাকরির পড়ালেখায় মনোনিবেশ করছে, আমি তখন দুটো টি-শার্ট বিক্রির জন্য ব্যস্ত। আমি জানি না আমার এই দুঃসহ জীবনের শেষ কোথায়! তিনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, যদি আমাকে নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনও চাকরি দেওয়া হয় তবে আমার ও আমার পরিবারের জন্য বড় উপকার হয়।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
স্কুল-মাদরাসা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্ধ রাখার নির্দেশ হাইকোর্টের - dainik shiksha স্কুল-মাদরাসা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্ধ রাখার নির্দেশ হাইকোর্টের ঢাকাসহ ১৩ জেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কাল বন্ধ - dainik shiksha ঢাকাসহ ১৩ জেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কাল বন্ধ প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ৯ মে - dainik shiksha প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ৯ মে বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশ হাইকোর্টের - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশ হাইকোর্টের প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নতুন নির্দেশনা টেম্পু চাপায় কলেজছাত্রী নিহত - dainik shiksha টেম্পু চাপায় কলেজছাত্রী নিহত কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0025110244750977