হার বেড়েছে, মান বাড়ুক

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

মানব সভ্যতার উন্নতির সঙ্গে শিক্ষা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শিক্ষার উন্নতির কথা মানুষ অতীতে যেমন ভেবেছে, এখনও ভাবছে, ভবিষ্যতেও ভাববে। বাংলাদেশে এখন শিক্ষার হার ৭৩ শতাংশ। তবে একটি প্রশ্ন আমাদের অনেকেরই মধ্যে দেখা দিয়েছে। সেটি হলো, আমাদের শিক্ষার হার বেড়েছে; কিন্তু মান বেড়েছে কিনা! এ প্রশ্নটি শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এমপির মধ্যেও দেখা দিয়েছে। তাই দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই তিনি বলেছিলেন, 'আমাদের শিক্ষার হার বেড়েছে, এখন মান বাড়ানো প্রয়োজন।' শিক্ষার গুণগত মান যে বাড়েনি তার প্রমাণ এশিয়ার ৪১৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে স্থান পায়নি প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশে ৪৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১০৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। তার মধ্যে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও টাইমস হায়ার এডুকেশন র‌্যাঙ্কিংয়ে স্থান পেল না, এটা খুবই দুঃখজনক। অথচ নেপাল ও শ্রীলংকার মতো দেশের বিশ্ববিদ্যালয় এই র‌্যাঙ্কিংয়ে জায়গা করে নিয়েছে। বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক সম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়। 

সম্পাদকীয়তে আরও জানা যায়, টাকার অভাবে গবেষণা হয় না- এ কথা সর্বত্র সঠিক নয়। প্রয়োজন মেধা, মননশীলতা ও গবেষণার প্রতি অনুরাগ। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাঁরা উপাচার্য হন, তাঁদের অধিকাংশের সময় কেটে যায় প্রশাসনিক কাজকর্ম এবং লবিং-গ্রুপিং নিয়ে। রাষ্ট্রপতি এ কথাটি প্রায়শ বিভিন্ন সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বলে থাকেন। একজন উপাচার্যের মূল দায়িত্ব প্রশাসনিক কাজকর্মের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক মানোন্নয়নের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া। এ জন্য প্রয়োজন একজন দক্ষ, সৎ এবং শিক্ষা ও গবেষণার প্রতি যার অদম্য আগ্রহ ও অনুরাগ আছে, এমন শিক্ষকের। তার সামনে থাকবে একটি ভিশন ও মিশন।

শিক্ষার মানোন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো ভালো শিক্ষক। এ ধরনের শিক্ষক এখন সমাজে অপ্রতুল। একসময় সমাজে মানমর্যাদার ক্ষেত্রে শিক্ষকরা ছিলেন অগ্রগামী। কিন্তু এখন তা চলে গেছে ক্ষমতাবানদের কাছে। সে কারণে মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা এখন আর শিক্ষকতা পেশায় আসতে চান না। তাদের প্রধান লক্ষ্য থাকে প্রশাসনিক ক্যাডারে যাওয়ার। এ দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ। এখানে কোনো লিখিত পরীক্ষা দিতে হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শর্তানুসারে প্রয়োজনীয় যোগ্যতা থাকলে কর্তৃপক্ষ তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী যে কাউকে নির্বাচন করতে পারে। এ ক্ষেত্রে ইউজিসি একটি সমন্বিত যোগ্যতা নির্ধারণ করে দিতে পারে। কেবল সনদগত ভালো রেজাল্ট থাকলেই ভালো শিক্ষক হওয়া যায় না। মুক্তচিন্তা, মুক্তবুদ্ধি, দেশ ও জাতির প্রতি দায়বদ্ধতা, সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের প্রতি অনুরাগী ব্যক্তি ভালো শিক্ষক হিসেবে জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারেন। এ ধরনের শিক্ষক দ্বারাই দেশ ও জাতি উপকৃত হতে পারে। সুতরাং উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে একজন ভালো শিক্ষক নিয়োগের বিকল্প নেই। বর্তমান সরকার নিবন্ধন পরীক্ষার মাধ্যমে মেধা তালিকা থেকে স্কুল-কলেজে শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা করেছে। এখন মেধাবীরাই শিক্ষক হয়ে আসার সুযোগ পাবেন। শিক্ষার মানোন্নয়নের ক্ষেত্রে এটি সরকারের একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

স্কুল ও কলেজ শিক্ষকদের পেশাগত মানোন্নয়নের জন্য তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পেশাগত মান বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণের তেমন ব্যবস্থা নেই। তারা বিভিন্ন সেমিনার-সিম্পোজিয়াম এবং গবেষণাকর্মের দ্বারা তাদের পেশাগত মান বৃদ্ধি করে থাকেন। কিন্তু এ ধরনের কাজে মুষ্টিমেয় শিক্ষক যুক্ত থাকেন। আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি অনুসারে যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, সেই দলের প্রতি বিশ্বস্ত শিক্ষককে উপাচার্য এবং উপ-উপাচার্য করা হয়। কিন্তু দলে অনেক জ্ঞানী, গুণী ও শিক্ষার প্রতি অকুণ্ঠ অনুরাগী শিক্ষক থাকেন। তাঁদের মধ্য থেকে যদি উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়, তাহলে এ দেশে শিক্ষার মান বাড়ানো সম্ভব। কারণ যারা শিক্ষানুরাগী তাদের প্রধান লক্ষ্য থাকে কীভাবে শিক্ষাকে উন্নত করা যায়। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, শিক্ষার মানোন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো ভালো শিক্ষক। কিন্তু ভালো শিক্ষক পাওয়া এত সহজ নয়। এর জন্য আমাদের টাকা খরচ করতে হবে। শিক্ষকদের জন্য একটা আলাদা বেতন স্কেল হওয়া প্রয়োজন। সেটি এমন আকর্ষণীয় হবে এবং তার সঙ্গে অন্যদের মতো শিক্ষকদেরও সুযোগ-সুবিধা ও সামাজিক মানমর্যাদা দিতে হবে, যাতে করে একজন তরুণ শিক্ষার্থী পাস করে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তা হওয়ার মতোই শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখে। প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একজন অভিভাবক থাকেন। তাঁদের যদি সদিচ্ছা ও সততা থাকে, তাহলে প্রতিষ্ঠানের উন্নতি সহজেই করা সম্ভব। কিন্তু তাঁরা যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হন, শিক্ষার প্রতি যদি তাঁদের অনুরাগ না থাকে, তাহলে সে প্রতিষ্ঠানের উন্নতি হওয়া সম্ভব নয়। প্রতিষ্ঠানের উন্নতি না হলে শিক্ষারও উন্নতি হয় না।

শিক্ষার মানোন্নয়নের আরেকটি পূর্বশর্ত যুগোপযোগী, সৃজনশীল ও মুক্তচিন্তার পাঠক্রম। বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান চারটি মূলনীতির ভিত্তিতে দেশ পরিচালনা করতে চেয়েছিলেন। তাই সংবিধানে যুক্ত হলো চারটি স্তম্ভ- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এই চারটি নীতির ভিত্তিতে যদি দেশ পরিচালিত হতো, তা হলে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠিত হতো আরও বহু আগে।

এ দেশে গ্রামাঞ্চলে শিক্ষার পরিবেশ অনেকটা ভিন্ন। সেখানে অনেক গরিব কৃষক পরিবারের ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজে যায়। তারা নানা কারণে নিয়মিতভাবে ক্লাসে উপস্থিত থাকে না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাত্রছাত্রীদের কলেজমুখী করার জন্য ক্লাসে উপস্থিতির জন্য একটা নম্বর রেখেছে। কিন্তু শোনা যায়, ছাত্রছাত্রীরা ক্লাসে উপস্থিত না থাকলেও এবং ইনকোর্স পরীক্ষা না দিয়েও ২০ নম্বরের মধ্যে ১৮-১৯ করে পেয়ে থাকে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যেভাবে এ নিয়মকে ধরে রাখা যায়, কলেজগুলোতে সেভাবে ধরে রাখতে পারছে না। ছেলেমেয়েদের শিক্ষানুরাগী করার ক্ষেত্রে অভিভাবকদেরও ভূমিকা রয়েছে। তাদের ছেলেমেয়েরা যাতে কলেজমুখী হয়, সে ব্যাপারে তাদের সচেষ্ট হতে হবে। শহরের অভিভাবকরা এ ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন। তবে গ্রামাঞ্চলেও অনেক কলেজ আছে, যেখানে মানসম্পন্ন পড়ালেখা হয়ে থাকে।

সরকার স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচনের রীতি চালু করেছে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও এটি প্রয়োগ করা যায় কিনা ভেবে দেখতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যদি এটি চালু করা হয়, তাহলে উপাচার্যদের মধ্যেও শ্রেষ্ঠ উপাচার্য হওয়ার একটি প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র সৃষ্টি হবে। শ্রেষ্ঠ উপাচার্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে অবশ্যই তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা, গবেষণাকর্ম, শিক্ষা ও গবেষণার প্রতি অনুরাগ ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে। এ ধরনের উপাচার্যের দ্বারাই দেশে উচ্চশিক্ষার সত্যিকার মানোন্নয়ন সম্ভব।

লেখক : ড. নিখিল রঞ্জন বিশ্বাস,  অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
নতুন শিক্ষাক্রমের ৩১ পাঠ্যবইয়ে ১৪৭ ভুল - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রমের ৩১ পাঠ্যবইয়ে ১৪৭ ভুল বজ্রপাতে মাদরাসার ২১ ছাত্র আহত, হাসপাতালে ১১ - dainik shiksha বজ্রপাতে মাদরাসার ২১ ছাত্র আহত, হাসপাতালে ১১ যতো লিখেছি, ছিঁড়েছি তার বেশি - dainik shiksha যতো লিখেছি, ছিঁড়েছি তার বেশি তত্ত্বাবধায়ককে বাধ্য করে ঢাবি শিক্ষকের পিএইচডি - dainik shiksha তত্ত্বাবধায়ককে বাধ্য করে ঢাবি শিক্ষকের পিএইচডি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই কবির জন্মবার্ষিকী পালনের নির্দেশ - dainik shiksha সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই কবির জন্মবার্ষিকী পালনের নির্দেশ শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই - dainik shiksha শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই বিদ্যালয়ের ক্লাস থামিয়ে ভোট চাইলেন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী - dainik shiksha বিদ্যালয়ের ক্লাস থামিয়ে ভোট চাইলেন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.013628005981445