হৃদয়বিদারক, অনভিপ্রেত, চিন্তার উদ্রেককারী

কাজী ফারুক আহমেদ |

নিজের চোখের সামনে বাবা-মায়ের অপমান সইতে না পেরে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের ছাত্রী ১৫ বছরের অরিত্রী অধিকারীর আত্মহত্যার ঘটনা হাইকোর্টের নজরে আসার পর আদালত পর্যবেক্ষণে বলেছেন, বিষয়টি হৃদয়বিদারক ও অনভিপ্রেত দৃষ্টান্ত।

আমার দৃষ্টিতে মর্মান্তিক ঘটনাটি প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার দীর্ঘদিন ধরে বিরাজিত অন্তর্নিহিত জটিল ব্যাধির বহিঃপ্রকাশ।

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ বলা হয়েছে : ‘শিশুদের সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করা হবে যেন তারা কোনোভাবেই কোনোরকম শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের শিকার না হয়।

শিশুদের স্বাভাবিক অনুসন্ধিৎসা ও কৌতূহলের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে তাদের স্বাভাবিক প্রাণশক্তি ও উচ্ছ্বাসকে ব্যবহার করে আনন্দময় পরিবেশে মমতা ও ভালোবাসার সঙ্গে শিক্ষা প্রদান করা হবে।’


কিন্তু কাজটি অসম্ভব না হলেও খুব যে সহজ নয়, অরিত্রীর ঘটনা তারই সাক্ষ্য দিচ্ছে।

এখন জানা যাচ্ছে, স্কুলটিতে এর আগেও শিক্ষার্থীর অপমানে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। বিজ্ঞান বিভাগে পড়তে না পেরে ২০১২ খ্রিস্টাব্দে নবম শ্রেণীর ছাত্রী চৈতী রায় আত্মহত্যা করে।

‘তোর কী মেধা আছে?... তুই বিজ্ঞানে কীভাবে পড়বি?’ শিক্ষকদের এমন রূঢ় মন্তব্যে আহত হয়ে সে আত্মহননের পথ বেছে নেয় বলে একটি জাতীয় দৈনিকে সংবাদ ছাপা হয়েছিল।

ভিকারুননিসা নূন স্কুল নিয়ে বর্তমানে বহুল আলোচিত ঘটনার তিনটি বিষয় বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য।

এক. শিক্ষার্থীর সঙ্গে শিক্ষকের আচরণ কেমন হওয়া উচিত।

দুই. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অভিভাবকের কাঙ্ক্ষিত অবস্থান কেমন হওয়া আবশ্যক।

তিন. শিক্ষার্থী ও তার বাবা-মা/অভিভাবকের উপস্থিতিতে শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানের (অধ্যক্ষ অথবা প্রধান শিক্ষক) আচরণ কেমন হওয়া দরকার।

যে তিনটি বিষয়ের উল্লেখ ওপরে করলাম, তা নিয়ে শুধু আমাদের দেশে নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নানা বিতর্ক আছে।

অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষার্থীদের সামাল দিতে না পেরে বের করে দেয়ার বা পাঠদান বন্ধের প্রবণতা রয়েছে। কয়েকটি ধাপে তা অনুসরণ করা হয়।

প্রথমে সতর্কতা নোটিশ, এরপর শ্রেণিকক্ষে অন্য শিক্ষার্থীদের থেকে আলাদা করে রাখা ও সব শেষে ক্লাস থেকে বের করে দেয়া হয়।

এক জরিপে জানা যায়, অস্ট্রেলিয়ার ৮৫ শতাংশ শিক্ষক এই পন্থার অনুসারী। কিন্তু অতি সম্প্রতি এর বিপক্ষে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভেতরে ও বাইরে জনমত গড়ে উঠছে।

কথা উঠেছে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা এর শিকার হচ্ছে। সেজন্য শিক্ষার্থীদের দূরে ঠেলে দেয়ার পরিবর্তে কাছে টানার, অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে ব্যস্ত ও নিয়োজিত রাখার বিষয় সক্রিয়ভাবে বিবেচনায় এসেছে।

গবেষণায় উঠে এসেছে, শিক্ষার্থীদের বিচ্ছিন্ন করে রাখার পরিণাম শুভ হয় না। শিক্ষার্থীর প্রতি অমনোযোগ ও যত্নের অভাব তাদের আবেগতাড়িত করে ভুল পথে ঠেলে দেয়।

প্রসঙ্গক্রমে শিক্ষকের মর্যাদা সংক্রান্ত ইউনেস্কোর বিশেষ আন্তঃসরকার সম্মেলনের ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের সুপারিশটি উল্লেখ যোগ্য।

এর শিক্ষার উদ্দেশ্য ও নীতিমালার ১০ ধারার ঙ-তে বলা হয়েছে, ‘যেহেতু শিক্ষা একটি অব্যাহত প্রক্রিয়া, সুতরাং শিক্ষাসেবার বিভিন্ন শাখাকে এমনভাবে সমন্বিত করতে হবে, যাতে সব ছাত্র-ছাত্রীর শিক্ষার মান উন্নয়ন করা যায় এবং শিক্ষকদের অবস্থানও উন্নীত হয়।’

একই ধারার চ-তে বলা হয়েছে, ‘সঠিকভাবে আন্তঃসম্পর্কিত নমনীয় স্কুলব্যবস্থার অবাধ সুযোগ থাকতে হবে, যাতে প্রত্যেক শিশুর যে কোনো প্রকার ও পর্যায়ের শিক্ষার সুযোগলাভের ক্ষেত্রে কোনো কিছুই বাধা সৃষ্টি না করে।’ 
ইউনেস্কোর ওই সুপারিশের ৬৭ ধারায় বলা হয়েছে, ‘শিক্ষার্থীদের স্বার্থে শিক্ষক ও মা-বাবা মধ্যকার পারস্পরিক সহযোগিতার জন্য সম্ভাব্য সব রকম প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে;...।’

৭০ ধারায় শিক্ষকের দায়িত্ব প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘মনে রাখতে হবে যে, পেশার মর্যাদা অনেকাংশে নির্ভর করে শিক্ষকদের নিজেদের ওপর। তাই নিজেদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে সর্বোচ্চ মান বজায় রাখতে শিক্ষকদের সচেষ্ট থাকতে হবে।’

প্রকৃতপক্ষে শিক্ষা নিয়ে আমাদের সবার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের সময় এসেছে। শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণ, পাঠক্রমের বিষয় নির্বাচন, পাঠদান পদ্ধতি যুগোপযোগীকরণ, শিক্ষার্থীর অর্জিত জ্ঞানের বিজ্ঞানসম্মত মূল্যায়ন থেকে শুরু করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনায় শিক্ষার্থীর উন্নয়ন ভাবনাকে অগ্রাধিকার দিয়ে পাঠদানকারী শিক্ষক ও পাঠ গ্রহণকারী শিক্ষার্থীর অভিভাবকের কার্যকর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা, সর্বোপরি দলীয় রাজনীতির কবলমুক্ত আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনা এখন সময়ের দাবি।

অরিত্রীর আত্মহনন ও সংশ্লিষ্টদের আত্মজিজ্ঞাসা এ কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।

লেখক: জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ প্রণয়ন কমিটির সদস্য; শিক্ষা ও শিক্ষক আন্দোলনের নেতা

সৌজন্যে: যুগান্তর


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান - dainik shiksha সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! - dainik shiksha শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! হিটস্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু লিখিততে প্রক্সি দিয়ে পার, মৌখিক পরীক্ষায় এসে ধরা - dainik shiksha লিখিততে প্রক্সি দিয়ে পার, মৌখিক পরীক্ষায় এসে ধরা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষক কেনো বদলি চান - dainik shiksha শিক্ষক কেনো বদলি চান ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে - dainik shiksha ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.005357027053833