শিক্ষক নিবন্ধনের আসন্ন প্রিলিমিনারি পরীক্ষার বৈতরণি পার হতে চলছে জোর প্রস্তুতি। আগামী ১৫ মার্চ ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এদিন সকালে স্কুল ও স্কুল পর্যায়-২ আর বিকেলে কলেজ পর্যায়ের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এমপিও নীতিমালা অনুসারে এখন থেকে বিষয়ের ভিত্তিতে চাকরিপ্রার্থীদের নিবন্ধিত নয়, পদের ভিত্তিতে চাকরিপ্রার্থীদের নিবন্ধিত করা হবে। সারা দেশে বেসরকারি স্কুল, মাদরাসা, কারিগরি বিদ্যালয় ও কলেজে শিক্ষকতাকে স্বপ্নের চাকরি হিসেবে গ্রহণ করতে হলে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) এর শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার সনদ থাকা আবশ্যক।
দেশের প্রায় ৩৫ হাজারের মতো এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্কুল, স্কুল-২ ও কলেজ পর্যায়ে শিক্ষক নিবন্ধনের মাধ্যমে শূন্য পদসমূহে শিক্ষক নিয়োগ দেয় এনটিআরসিএ। শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে কমপক্ষে স্নাতক পাস আবশ্যক। তিনটি ধাপে--প্রিলি, লিখিত, ভাইভা--পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এনটিআরসিএ সূত্রে জানা গেছে, ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার প্রিলিমিনারি পরীক্ষার্থী ১৮ লাখের বেশি। তাই এবার প্রতিযোগিতাও হবে চরম প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ! শুরুতে ১০০ নম্বরের প্রিলিমিনারি বা বাছাই পরীক্ষা নেয়া হবে। বাছাই পরীক্ষায় ৪০ ভাগ নম্বর পেলেই উত্তীর্ণ বলে ধরা হবে অর্থাৎ লিখিত পরীক্ষার টিকিট পাওয়া যাবে। লিখিত পরীক্ষার নম্বরের ভিত্তিতে উত্তীর্ণদের পরবর্তীকালে মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে।
স্বল্প সময়ে প্রিলিমিনারির পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি
প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় চারটি বিষয়ে--বাংলা, ইংরেজি, গণিত ও সাধারণ জ্ঞান--২৫টি করে মোট ১০০টি এমসিকিউ প্রশ্ন থাকবে। পরীক্ষার সময় এক ঘণ্টা। স্কুল ও স্কুল-২ পর্যায়ে একই দিনে একই সময় পরীক্ষা হয়। সাধারণত স্কুল পরীক্ষার পরের দিন কলেজ পর্যায়ে পরীক্ষা হয়। প্রতিটি শুদ্ধ উত্তরের জন্য নম্বর ১। তবে প্রতিটি ভুল উত্তরের জন্য শূন্য দশমিক ২৫ নম্বর কাটা যাবে। স্বল্প সময়ে শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় প্রিলিমিনারির পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি নিতে বিষয়ভিত্তিক (৪টি বিষয়) প্রস্তুতি নেয়া খুব বেশি জরুরি।
বাংলা (২৫ নম্বর)
স্কুল, স্কুল-২ ও কলেজ পর্যায়ে বাংলায় মোটামুটি একই টপিক। কারক ও বিভক্তি, সন্ধি বিচ্ছেদ, ভুল সংশোধন বা শুদ্ধকরণ, ভাষারীতি ও বিরাম চিহ্নের ব্যবহার, বাগধারা ও বাগবিধি, সমাস ও প্রত্যয়, যথার্থ অনুবাদ, লিঙ্গ পরিবর্তন, সমার্থক এবং বিপরীত শব্দ, বাক্য সংকোচনসমূহ মূলত স্কুল ও স্কুল-২ এর জন্য। কলেজ পর্যায়ে স্কুল ও স্কুল-২ এর বিষয়গুলোসহ প্রায়োগিক প্রয়োজনীয়তার (বিরামচিহ্ন, বাগধারা, সন্ধি, কারক, সমাস, কারক বিভক্তি, প্রত্যয়) অংশসমূহ অনুশীলন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, বাংলা সাহিত্য অংশ থেকে এখানে কোনো প্রশ্ন থাকবে না। সহায়ক বই হিসেবে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক র্বোডের ‘বাংলা ভাষার ব্যাকরণ’ পুরাতন বইটি (৯ম-১০ম) অনুশীলন করলে পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়া যাবে।
ইংরেজি (নম্বর ২৫)
প্রিলিমিনারিতে ইংরেজি বিষয়ে স্কুল, স্কুল-২ ও কলেজ পর্যায়ে সিলেবাস একই। ইংরেজির সিলেবাস মূলত গ্রামারভিত্তিক। এই অংশে Errors in composition, Change of parts of speech, Fill in the blanks with appropriate preposition, Uses of article, verbs, Identify appropriate translation from Bengali to English, Identify appropriate title from story, article, Transformation of sentences, synonyms and Antonyms, completing sentences, Idioms and phrases থেকে প্রশ্ন আসবে। সহায়ক বই হিসেবে ৬ষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির ইংরেজি ২য় পত্রের গ্রামার বই (আগের কারিকুলাম) থেকে টপিক ধরে ধরে অনুশীলন করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে।
গণিত (নম্বর ২৫)
স্কুল, স্কুল-২ ও কলেজ পর্যায়ে গণিতের সিলেবাস প্রায় একই। গণিতে তিনটি অংশ (পাটিগণিত, বীজগণিত ও জ্যামিতি) থেকে প্রশ্ন করা হয়। পাটি গণিতে গড়, লসাগু, গসাগু, ঐকিক নিয়ম, শতকরা, সুদকষা, লাভ-ক্ষতি অনুপাত-সমানুপাত থেকে প্রশ্ন করা হয়। বীজগণিতে উৎপাদক, বর্গ ও ঘন সংবলিত সূত্রাবলী ও প্রয়োগ, গসাগু, বাস্তব সমস্যা সমাধানে বীজগাণিতিক সূত্র গঠন ও প্রয়োগ, সূচক ও লগারিদমের সূত্র ও প্রয়োগ থেকে প্রশ্ন আসে।
জ্যামিতির মধ্যে রেখা, কোণ, ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ, ক্ষেত্রফল ও বৃত্ত সম্পর্কিত সাধারণ ধারণা, নিয়ম ও প্রয়োগ থেকে প্রশ্ন করা হয়। উক্ত বিষয় ছাড়া কলেজের জন্য আলাদাভাবে পরিমিতি ও ত্রিকোণমিতি সম্পর্কিত সাধারণ ধারণা থেকে প্রশ্ন আসে। অনুশীলনের জন্য জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক র্বোডের আগের ৬ষ্ঠ-৯ম শ্রেণির গণিত বই সবচেয়ে বেশি সহায়ক হবে।
সাধারণ জ্ঞান (নম্বর ২৫)
সাধারণ জ্ঞানে স্কুল, স্কুল-২ ও কলেজ পর্যায়ের সিলেবাস একই। সাধারণ জ্ঞানে তিনটি অংশ থেকে প্রশ্ন করা হয়। ১. বাংলাদেশ সম্পর্কিত বিষয় ২. আন্তর্জাতিক বিষয় ও চলতি ঘটনাবলী ৩. বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, পরিবেশ এবং রোগব্যাধি সম্পর্কিত মৌলিক জ্ঞান।
বাংলাদেশ সম্পর্কিত বিষয়ের মধ্যে ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, সভ্যতা, সংস্কৃতি, বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি, জলবায়ু, পরিবেশ, ইতিহাস, বাংলাদেশের অর্থনীতি, সম্পদ (বন, কৃষি, শিল্প, পানি), যোগাযোগ ব্যবস্থা, বাংলাদেশের সমাজ জীবন, সমস্যা, জনমিতিক পরিচয়, রাষ্ট্র, নাগরিকতা, সরকার ও রাজনীতি, সরকারি ও বেসরকারি লক্ষ্য, নীতি, পরিকল্পনা (অর্থনৈতিক, সামাজিক, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা), কর্মসূচি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, মানবসম্পদ উন্নয়ন, বিশ্ব ভৌগোলিক পরিচিতি, জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ, নবায়নযোগ্য শক্তি, জাতিসংঘ, আঞ্চলিক ও অর্থনৈতিক সংগঠন, পুরস্কার ও সম্মাননা অন্তর্ভুক্ত।
আন্তর্জাতিক বিষয়বলীর মধ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা সংক্রান্ত, আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও আনুষঙ্গিক বিষয়াবলী থেকে প্রশ্ন করা হয়। অপরদিকে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, পরিবেশ এবং রোগব্যাধি সম্পর্কিত মৌলিক জ্ঞান অংশ থেকে স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, তথ্য, যোগাযোগ ও প্রযুক্তি, প্রাত্যহিক জীবনে বিজ্ঞান (পদার্থ, রসায়ন ও জীব বিজ্ঞান সংশ্লিষ্ট) সাধারণ রোগ-ব্যাধি ও পরিবেশ বিজ্ঞান সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহ পড়তে হবে। সহায়ক বই হিসেবে পুরাতন কারিকুলামের ৬ষ্ঠ থেকে ৯ম শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়, বিজ্ঞান ও সংশ্লিষ্ট বইসমূহ অনুশীলন করা যেতে পারে।
শেষ কথা
প্রিলিমিনারি কিন্তু পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার জন্য পরীক্ষা নয়! এটি মূলত লিখিত পরীক্ষার জন্য বাছাই পরীক্ষা। প্রিলিমিনারির নম্বর অন্য কোথাও (লিখিত ও ভাইভা) যোগ হয় না। টপিক ধরে ধরে একটু সতর্কভাবে পড়লেই অনায়সেই পাস (৪০ শতাংশ নম্বর) করা সম্ভব।
অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি সব বিষয়ের সব টপিক না পড়লেও চলবে! যে টপিক খুব কঠিন মনে হবে সেটা বাদ দিলেও সমস্যা হবে না। কেনোনা পাস নম্বর ৪০ শতাংশ। যিনি যে বিষয়ে দক্ষ তিনি সেই বিষয়ে বেশি উত্তর করে অন্য বিষয় থেকে কম উত্তর করার চেষ্টা করাই বুদ্ধিমানের কাজ। যারা ১ম ও ২য় শ্রেণির সরকারি চাকরির প্রিলিমিনারি প্রস্তুতি নিচ্ছেন তাদের জন্য আলাদাভাবে শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার প্রস্তুতি না নিলেও চলবে।
কেনোনা আপনার চলতি প্রস্তুতিতে অনায়সেই প্রিলিমিনারি পাস হয়ে যাবে। তবে নিজে নিজে ঘরে বসে মডেল টেস্টের মাধ্যমে মাঝে মাঝে নিজেকে যাচাই করলে পরীক্ষায় সুফল পাওয়া যাবে। বিগত বছরের সব বিসিএস পরীক্ষার প্রিলিমিনারি প্রশ্ন, সব শিক্ষক নিবন্ধন (সব পর্যায়) পরীক্ষার প্রিলিমিনারি প্রশ্ন, বাজারে পাওয়া সহায়ক যেকোনো ‘জব সলিউশন’ থেকে বিগত ৫ থেকে ৭ বছরের চাকরির পরীক্ষার প্রশ্ন অনুশীলন করলে নিবন্ধন পরীক্ষায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৪০ ভাগের বেশি প্রশ্ন কমন পাওয়া যাবে বলে আশা রাখি। প্রতি মাসের কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স বা চলতি ঘটনাবলি ও দৈনিক পত্রিকায় নিয়মিত নজর রাখতে হবে। এ ছাড়া বাজারে পাওয়া চাকরির পরীক্ষার যেকোনো এক সেট (বাংলা, ইংরেজি, গণিত ও সাধারণ জ্ঞান) সহায়ক বই থেকে সুনির্দিষ্ট টপিক ধরে ধরে পড়লে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া সম্ভব বলে মনে করি।
লেখক: সহকারী শিক্ষক, লৌহজং বালিকা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়, মুন্সীগঞ্জ (এনটিআরসিএ’র সম্মিলিত মেধাতালিকায় ৩য়)