২ মাসেও জানা গেল না রিফাত হত্যার মূল কারণ

বরগুনা প্রতিনিধি |

বরগুনা সদরে রাস্তায় ফেলে রিফাত শরীফকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যার ৬০ দিন পূর্ণ হলো আজ। গত ২৬ জুন নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি হয়। প্রকাশ্যে একজনকে কুপিয়ে খুনিদের ‘বীরদর্পে’ ঘটনাস্থল ত্যাগ করার দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে নিন্দার ঝড় ওঠে। নাড়া দেয় বিবেক।

দুই মাস অতিবাহিত হলেও এই মামলার এজাহারভুক্ত ৪ আসামিকে এখনও গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। এখনও স্পষ্ট হয়নি হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য কারণ। এক ধরনের ধোঁয়াশা কেটে গেছে ৬০টি দিন। রিফাত হত্যা মামলার প্রধান আসামি সাব্বির আহমেদ ওরফে নয়ন বন্ড পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন। দ্বিতীয় আসামি রিফাত ফরাজী হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।

২৬ জুন বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয় রিফাত শরীফকে। ওই ঘটনার দুটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওতে দেখা যায়, নয়ন বন্ড ও রিফাত ফরাজী তাকে রামদা দিয়ে কোপাচ্ছে।

ঘটনার দিন থেকেই নিখোঁজ হয় এ দুই যুবক। এর ছয় দিন পর ২ জুলাই নয়ন বন্ড পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। ওই দিন রাতেই রিফাত ফরাজীকে গ্রেফতার দেখায় পুলিশ।

গ্রেফতার হওয়া রিফাত ফরাজী বরগুনা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেনের ভায়রার ছেলে। তার ছোট ভাই রিশান ফরাজীও এই মামলায় গ্রেফতার হয়ে রিমান্ডে আছেন।

এই মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে রিফাত হত্যার প্রধান সাক্ষী ও তার স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে। পুলিশের দাবি, মিন্নি হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তবে মিন্নির পরিবারের দাবি তাকে জোর করে জবানবন্দি নেয়া হয়েছে।

হত্যাকাণ্ডের পর দিন রিফাত শরীফের বাবা আবদুল হালিম শরীফ বরগুনা থানায় ১২ জনকে আসামি করে মামলা করেন। এ ছাড়া সন্দেহভাজন অজ্ঞাতনামা আরও চার-পাঁচজনকে আসামি করা হয়। মামলার এজাহারভুক্ত ছয় আসামিসহ এ পর্যন্ত ১৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৪ জনই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।

এ হত্যাকাণ্ডের ৬০ দিন কেটে গেলেও ধোঁয়াশা কাটেনি। হত্যার নেপথ্য কারণ এখনও উদ্ঘাটিত হয়নি। একেকবার একেক দিকে মোড় নিচ্ছে। মামলার বেশিরভাগ আসামি ধরা পড়লেও মামলার অগ্রগতি খুব একটা দৃশ্যমান হচ্ছে না।

রিফাত হত্যার প্রত্যক্ষদর্শী ও মামলার প্রধান সাক্ষী তার স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি। তাকেই এ মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। তাকে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। রিমান্ড চলাকালীন মিন্নি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। মিন্নির গ্রেফতারের পরেই মামলা ভিন্ন দিকে মোড় নেয়।

মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হক কিশোরের দাবি, মিন্নির কাছ থেকে জোর করে জবানবন্দি নেয়া হয়েছে। তিনি এ হত্যা মামলার এক নম্বর সাক্ষীকে (মিন্নি) আসামি করা ও রিমান্ডে নেয়ার জন্য স্থানীয় সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুকে দায়ী করে আসছেন।

তিনি বলেছিলেন, ‘সবকিছুই শম্ভু বাবুর খেলা। তার ছেলে সুনাম দেবনাথকে রক্ষা করার জন্য আমার মেয়েকে বলি দেয়া হচ্ছে।’ শম্ভুর ছেলে সুনামের বিরুদ্ধে কিশোরের অভিযোগ, তার জন্যই প্রথম দিকে মিন্নির পক্ষে আদালতে দাঁড়াননি আইনজীবীরা। এ নিয়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বহু সমালোচনার পর বরগুনা ও ঢাকার আইনজীবীদের একটি অংশ মিন্নির পক্ষে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন।

নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এতে দেখা গেছে, এই হত্যাকাণ্ডের মূল নায়ক সাব্বির আহমেদ নয়ন বন্ড। তাকে এ মামলার প্রধান আসামি করা হয়। নয়ন বন্ড ২ জুলাই পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। নয়নের মায়ের দাবি তাকে হত্যা করা হয়েছে।

এদিকে নয়ন বন্ড কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ায় ও রিফাতের স্ত্রীকে এ ঘটনায় গ্রেফতার করায় স্থানীয়দের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই মনে করছেন মিন্নিকে এ মামলায় ফাঁসানো হচ্ছে। আবার কেউ কেউ মনে করছেন মিন্নি এ ঘটনায় দায় এড়াতে পারেন না। কারণ রিফাতের সঙ্গে বিয়ের আগে নয়ন বন্ডের সঙ্গে মিন্নির যোগাযোগ ছিল। এ নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরেই প্রাণ হারাতে হয় রিফাতকে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বরগুনার এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, হত্যাকাণ্ডের পর এ মামলার তদন্ত কার্যক্রম প্রায় সম্পন্ন করেছে পুলিশ। এ মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সময় উদ্ধার করা বেশ কিছু আলামত পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে বিশেষজ্ঞদের মতামতের জন্য ঢাকায় পাঠিয়েছে পুলিশ। এসব আলামতের মধ্যে নয়ন বন্ডের বাসা থেকে জব্দ করা মেয়েদের একটি জামা, একটি চিরুনী খোদাই করে শামুকের গায়ে এন+এম লেখা একটি শামুক, নয়ন ও মিন্নির একসঙ্গে একটি ছবি রয়েছে।

ওই পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, নয়ন বন্ডের সঙ্গে মিন্নির ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের একটি ভিডিও পুলিশ মামলার আলামত হিসেবে জব্দ করেছে। আর মোবাইল ফোনসহ কয়েকটি ইলেকট্রনিক উপকরণ মামলার জব্দ তালিকায় রয়েছে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করা হবে বলেও জানান তিনি।

এদিকে মিন্নির বাবার অভিযোগ মিন্নিকে জোর জবরদস্তি করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেয়া হয়েছে। প্রভাবশালী মহলকে বাঁচাতে পুলিশ এ ঘটনায় মিন্নিকে ফাঁসাতে এমনটি করেছে। গ্রেফতারের পর মিন্নির ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে। তার সারা শরীরে ব্যথা। রাতে ঘুমাতে পারেন না তিনি। প্রসঙ্গত বরগুনা সরকারি কলেজের মূল ফটকের সামনের রাস্তায় ২৬ জুন সকাল ১০টার দিকে স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির সামনে কুপিয়ে জখম করা হয় রিফাত শরীফকে। বিকাল ৪টায় বরিশালের শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়।

এ হত্যার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশব্যাপী তোলপাড় শুরু হয়। রিফাত হত্যা মামলার প্রধান সাক্ষী ও রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে গ্রেফতার এবং রিমান্ডে গিয়ে তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়ার পর থেকে মামলা ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। ১৬ জুলাই সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বরগুনার মাইঠা এলাকার বাবার বাসা থেকে মিন্নিকে জিজ্ঞাসাবাদ ও তার বক্তব্য রেকর্ড করতে বরগুনা পুলিশলাইনসে নিয়ে যায় পুলিশ। এর পর দীর্ঘ ১০ ঘণ্টার জিজ্ঞাসাবাদ শেষে রাত ৯টায় মিন্নিকে রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের মানদণ্ড কী? - dainik shiksha শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের মানদণ্ড কী? অবসর-কল্যাণে শিক্ষার্থীদের দেয়া টাকা জমার কড়া তাগিদ - dainik shiksha অবসর-কল্যাণে শিক্ষার্থীদের দেয়া টাকা জমার কড়া তাগিদ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে সুপ্রিম কোর্টের ফতোয়ার রায় পাঠ্যপুস্তকে নিতে হবে - dainik shiksha সুপ্রিম কোর্টের ফতোয়ার রায় পাঠ্যপুস্তকে নিতে হবে সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি - dainik shiksha সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি - dainik shiksha বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0026261806488037