৭ মার্চ ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত এক বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। ১৮ মিনিট স্থায়ী এই ভাষণে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের পরাধীন, শোষিত, বঞ্চিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত, বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধুর এই অলিখিত ভাষণ একটি নিরস্ত্র জাতিকে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিলো। পৃথিবীর ইতিহাসে তার এই ভাষণ এক অনন্য সাধারণ ভাষণ হিসেবে বিবেচিত। বঙ্গবন্ধু সারাজীবন যা বিশ্বাস করতেন, হৃদয় দিয়ে যা অনুভব করতেন, সেই বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করেই ভাষণটি দিয়েছিলেন। এজন্য নিউজউইক ম্যাগাজিন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাজনীতির কবি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ৭ মার্চের ভাষণটি বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যের দলিল হিসেবে ইউনেস্কো কর্তৃক ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ অক্টোবর ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল’ রেজিস্টার-এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ইউনেসকোর এ স্বীকৃতিকে ইতিহাসের প্রতিশোধ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। কারণ, স্বাধীন বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে এই ভাষণটির প্রচার নিষিদ্ধ ছিলো। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে অনেকে বিশ্বের মহান নেতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের ‘গেটিসবার্গ অ্যাড্রেস’, মার্টিন লুথার কিংয়ের ‘Have a dream’, প্যাট্রিক হেনরির ‘Give me liberty or give me death’, ইত্যাদি ভাষণের সঙ্গে তুলনা করেন। তবে তাদেরকে বঙ্গবন্ধুর মতো সাড়ে ৭ কোটি মানুষের আকাশছোঁয়া আশা-আকাঙ্ক্ষার চাপ ও সামরিক সরকারের অস্ত্রের মুখে সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায় দাঁড়িয়ে ভাষণ দিতে হয়নি। বঙ্গবন্ধু তার ভাষণের মাধ্যমে নিরস্ত্র বাঙালি জাতিকে সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তর করেছিলেন।
বর্ষিয়ান আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘এক দিনের ঘোষণায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা আসেনি। তিল তিল করে বঙ্গবন্ধু তার সারাটা জীবন দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ওই ভাষণ দিয়েছিলেন। একদিকে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, অন্যদিকে তাকে যেনো বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে অভিহিত করা না হয়, সেদিকেও তার সতর্ক দৃষ্টি ছিলো।’
অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘এই স্বীকৃতির মাধ্যমে বাংলাদেশ বহুদূর এগিয়ে গেলো। এটা শুধু বঙ্গবন্ধুর স্বীকৃতি নয়, দেশের জন্যও একটি বড় অর্জন।’ বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলাদেশের নেতা ছিলেন না, তিনি বিশ্বের নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের নেতা ছিলেন।
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশবিভাগের পর থেকেই বিভিন্ন দাবি আদায়ের লক্ষ্যে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গন ছিলো উত্তপ্ত। সেই সময় থেকেই গণমানুষের অধিকার আদায়ের জন্য তিনি জনসমক্ষে বহু ভাষণ দিয়েছেন। সেই ভাষণগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিলো ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ৭ মার্চের ভাষণ। এই ভাষণই ছিলো বাঙালি জাতির দীর্ঘদিনের শোষণ, বঞ্চনা আর অবহেলা থেকে মুক্তির ধারাবাহিক আন্দোলনের চূড়ান্ত নির্দেশনা। ইতোপূর্বে ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের ৭ ডিসেম্বর ও ১৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের উভয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১ জানুয়ারি পাকিস্তানি সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানকে অনতিবিলম্বে পার্লামেন্টের অধিবেশন ডাকার দাবি জানান। ৩ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্যদের শপথ গ্রহণ পরিচালনা করেন। সংসদ সদস্যগণ ৬-দফা ও ১১-দফার ভিত্তিতে দেশের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন ও জনগণের প্রতি অনুগত থাকার শপথ গ্রহণ করেন। তারপর ১৩ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও বঙ্গবন্ধুর মধ্যে দফায় দফায় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ইয়াহিয়া খান পশ্চিম পাকিস্তানে গমনের প্রাক্কালে ঢাকা বিমানবন্দরে সাংবাদিকদেরকে জানান যে, অধিবেশন আহ্বান করা হবে। প্রকৃত অর্থে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী এই দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে বিলম্ব করতে শুরু করে। সত্যিকার অর্থে তাদের উদ্দেশ্য ছিলো, যেকোনোভাবে ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনীতিবিদদের হাতে কুক্ষিগত করে রাখা।
১৬ জানুয়ারি ইয়াহিয়া খান তার সামরিক ও গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে করাচিতে এবং ১৭ জানুয়ারি জুলফিকার আলী ভূট্টোর লারকানার প্রাসাদে এক গোপন আলোচনায় মিলিত হন। এই আলোচনা ‘লারকানা ষড়যন্ত্র’ নামে পরিচিত। এই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের জন্যই সামনের দিনগুলোতে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী নিজেদেরকে নিয়োজিত রাখে। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো যে, তারা কখনোই বাঙালির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না এবং গোপনে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে লক্ষ লক্ষ সৈন্য ও অস্ত্র কয়েকটা বিশাল আকারের জাহাজ (যেমন-এমভি সোয়াত, এমভি এনডিওরেন্স) দ্বারা পূর্ব পাকিস্তানে দ্রুত পাঠাতে থাকে। এই সময়টায় তারা বঙ্গবন্ধু সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রাখে যেনো তাদের আসল পরিকল্পনা জনসমক্ষে প্রকাশ না পায়।
বাঙালি জাতিকে একত্রিত করে ভবিষ্যতের সংগ্রামের প্রস্তুতির জন্য ও দিক নির্দেশনার জন্য ৭ মার্চ রমনা রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দেবেন বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। গোটা জাতি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলো তার ভাষণ শোনার জন্য। লক্ষ লক্ষ মানুষের উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু তার দিক নির্দেশনামূলক ভাষণ দেন। পৃথিবীর ইতিহাসে তার এই ভাষণ এক অনন্য সাধারণ ভাষণ হিসেবে বিবেচিত। সেদিন ঢাকা ছিলো মিছিলের শহর। বিকেল ৩টা ২০ মিনিটে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি আর হাতাকাটা কালো কোট পরে বাঙালির প্রাণপুরুষ বঙ্গবন্ধু সেদিন দৃপ্তপায়ে উঠে আসেন রেসকোর্সের মঞ্চে। সমগ্র জাতির উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু তার ঐতিহাসিক ভাষণটি দেন।
৭ মার্চের ভাষণ ছিলো মুক্তিযুদ্ধের নির্দেশনা ও ডাক। জাতির অস্তিত্বের লড়াইয়ে জনগণের সঙ্গে একাত্ম হয়ে অসম যুদ্ধে তিনি সেদিন অবতীর্ণ হয়েছিলেন জনগণের একজন হিসেবে। এই ভাষণের দিক নির্দেশনায় জাতি সেদিন থেকেই যুদ্ধ পথে চলে গিয়েছিলো। তার ভাষণে তিনি বাংলার মানুষের সংগ্রাম ও বঞ্চনার কথা সহজ ও সাবলীল ভঙ্গিতে উচ্চারণ করেন। পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক শাসন থেকে বাঙালির মুক্তির একমাত্র পথ হলো স্বাধীনতা, আর এই কথাটি তিনি তার ভাষণের মাধ্যমে অত্যন্ত সুকৌশলে শ্রোতাদের মনে গেঁথে দিয়েছেন। এই একটি ভাষণে তখনকার পরিস্থিতিতে কী কী করণীয় তার সবই বলে দিলেন একজন গেরিলা কমান্ডারের মতো। কীভাবে সরকার গঠন করতে হবে, কীভাবে একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করতে হবে, তার রাজনৈতিক, সামাজিক, প্রশাসনিক ও সামরিক দিকগুলো বলে দিলেন।
ইতিহাসবিদরা বলেন, ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের ঐতিহাসিক জনসভায় বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরোক্ষ ঘোষণা দেন এবং বাঙালি জাতিকে বিশ্বের কাছে বীরের জাতি হিসেবে তুলে ধরেন। কবি নির্মলেন্দু গুণ ৭ মার্চ-ঐতিহাসিক ভাষণ-দিবস প্রবন্ধে লিখেছেন, ১৯৭১-এর ৭ মার্চ রবিবার ৩টা ১৫ মিনিটে বঙ্গবন্ধু সভাস্থলে আসেন এবং ৩-২০মিনিটে ‘ভায়েরা আমার’ বলে তার অলিখিত ভাষণ শুরু করেন। ওই অগ্নিগর্ভ, মহাকাব্যিক ভাষণের স্থায়িত্বকাল ছিলো প্রায় ১৮ মিনিট। স্বাধীনতা ও ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের বর্ণনা দিতে গিয়ে কবি নির্মলেন্দু গুণ তার অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন নিম্মক্তোভাবে-
‘শত বছরের সংগ্রাম শেষে,
রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাড়ালেন।
তখন পলকে দারুন ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার
সকল দুয়ার খোলা। কে রোধে তাঁহার বজ্রকন্ঠ বাণী?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে, কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি:
’এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।’
বঙ্গবন্ধুর ওই ভাষণের ১৮ দিন পর ২৫ মার্চ ১৯৭১ পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালি নিধনে নামলে বঙ্গবন্ধুর ডাকে শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ। নয় মাসের সেই সশস্ত্র সংগ্রামের পর আসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ৭ মার্চের ভাষণের যে কথাগুলো আমার মনে দাগ কেটেছে তা হলো, ‘যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজনও যদি হয় তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।’ ন্যায্য কথাটা মেনে নেয়ার মতো সৎসাহস পৃথিবীতে খুব কম মানুষেরই আছে। চিন্তা করে দেখেনতো একজন নেতা কতোটা সৎসাহসী, আত্মবিশ্বাসী ও উদার হলে এ কথা বলতে পারে। ন্যায্য কথা মেনে নেবার মতো বড় গণতন্ত্র আর হতে পারে না। আমি মনে করি গণতন্ত্রের এটাই সব থেকে আধুনিক এবং সঠিক সংজ্ঞা।
নূহ-উল-আলম লেনিন ৭ মার্চের ভাষণ এবং বাঙালির সশস্ত্র গণঅভ্যুত্থানের শিল্পরূপ’ প্রবন্ধে বলেছেন, সুনামি বা ভূমিকম্পের মতো মাত্র ২০ মিনিটের একটা বক্তৃতা একটি জাতির ইতিহাসের দৃশ্যপট বদলে দিতে পেরেছে এটা ভাবতেও বিস্ময় বোধ হয়। সেদিনের রেসকোর্স ময়দানের উত্তাল জনসমুদ্র। অপেক্ষমান জনতার কাছে প্রতিটি মিনিট যেন এক একটা শতাব্দী। সমুদ্রগর্জনে মুখর জনসমুদ্র ‘জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনিতে প্রকম্পিত করছে।
অভিনেতা রামেন্দু মজুমদার সম্পাদিত ‘বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ’ বইয়ে উল্লেখ রয়েছে, ‘৭ মার্চ, ১৯৭১ ঢাকার রেসকোর্সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়। কমপক্ষে ১০ লক্ষ লোক তাদের নেতার কাছ থেকে নির্দেশ গ্রহণ করার জন্যে এক জনসভায় সমবেত হয়। বেশির ভাগ লোকই বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাটি শুনতে চাইছিলেন। আব্দুল গাফফার চৌধুরী লিখেছেন, ‘আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য, আমি ইতিহাসের এই ক্ষণজন্মা নেতাকে দেখেছি। তার সান্নিধ্য পেয়েছি। তার ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ শুনেছি। আমেরিকায় গৃহযুদ্ধের পর গেটিসবার্গে প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের ঐতিহাসিক ভাষণটি শোনা এবং তা রিপোর্ট করার পর এক মার্কিন সাংবাদিক লিখেছিলেন, ‘লিঙ্কনের এই ভাষণ শোনা ও তা লেখার পর মনে হচ্ছে, আমার সাংবাদিকতা এখানেই শেষ হলে ভালো হয়।’
বঙ্গবন্ধু যে পটভূমিতে ভাষণটা দিয়েছেন, সেখানে আব্রাহাম লিংকনের পটভূমি সম্পূর্ণ ভিন্ন। আব্রাহাম লিংকন ছিলেন একটা স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপতি, গৃহযুদ্ধে তার দেশের যারা প্রাণ দিয়েছিলেন তাদের স্মৃতিতে, সম্মানে উনি বক্তব্যটা দিয়েছিলেন। পক্ষান্তরে বঙ্গবন্ধু একটা বর্বর, অমানবিক, স্বৈরাচারী, কুশিক্ষিত, হিংস্র পাশবিক সামরিক শক্তির কবল থেকে নিজের দেশকে মুক্ত করার জন্য বক্তৃতা করেছিলেন।
অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ‘ভাষার জাদু: বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ’ নিবন্ধে লিখেছেন, ‘এক বিদেশি সাংবাদিক ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ৭ মার্চ সকাল থেকেই একজন দোভাষী খুঁজছিলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ভাষণ দেবেন তা তাৎক্ষণিক ইংরেজি করে তাকে শোনাবার জন্যে। মাঠে সেদিন কতো মানুষ উপস্থিত হয়েছিলো, তা কেউ সঠিকভাবে বলতে পারবে না। হয়তো আট লাখ। হয়তো দশ লাখ। হয়তো তারও বেশি। তবে রেসকোর্স ময়দানে তিল ধারণের ঠাঁই ছিলো না, ভাষণ শুরুর আধঘণ্টা আগে বিদেশি সাংবাদিককে নিয়ে যাই, মনে হলো সারা দেশ ভেঙে পড়েছে রেসকোর্স মাঠে। এতো সামনে থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে পাবো, ভাবতেও পারিনি। আমি প্রথম তিন-চার লাইন দ্রুত অনুবাদ করলাম, কিন্তু বিদেশি সাংবাদিকটি বললেন আমি যেনো ভাষণটা শুনি এবং মনে রাখার চেষ্টা করি। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পুরোটা সময় সেই সাংবাদিকটি মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন, তার মুখ দেখে মনে হচ্ছিল তিনি প্রতিটি বাক্য বুঝছেন, যেনো বঙ্গবন্ধু বাংলাতে নয়, ইংরেজিতে ভাষণটা দিচ্ছেন। বিকেলে সাংবাদিককে যখন মূল বিষয়গুলো অনুবাদ করে দিচ্ছিলাম, সাংবাদিক বললেন, ইট ওয়াজ সিম্পলি ম্যাজিক্যাল’। একজন অন্য ভাষার মানুষ তিনিও বুঝেছেন, ওই ভাষণে জাদু ছিলো, যেখানে জাদু আছে, সেখানে সব কথা তো ভেঙে বলার দরকার নেই। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ৭ মার্চের সেই দূরদর্শি বক্তৃতা বাংলাদেশের স্বাধীনতার দ্বার উন্মোচিত করেছিলো। প্রকৃতপক্ষে এই ভাষণের মাধ্যমেই আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণা হয়ে গেছে। তর্ক না করে হৃদয় দিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। একটা নবজাত শিশু কিন্তু তার মাকে বলে না, আমাকে খাবার দাও আমার ক্ষুধা পেয়েছে। পেটে ব্যথা করছে ওষুধ দাও। শিশুর কান্না শুনে মা বোঝে কোনটা ক্ষুধার আর কোনটা ব্যথার।
ভাষণের এক জায়গায় বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘সরকারি কর্মচারীদের বলি, আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হবে, খাজনা ট্যাক্স বন্ধ করে দেয়া হলো-কেউ দেবে না।’ এর অর্থ কী, এটা কি স্বাধীনতার ঘোষণার চেয়েও বেশি না? এখানেই শেষ না এরপরও উনি বলেছেন, ‘তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো। এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ওই পরিস্থিতিতে এটা বলা জরুরি ছিলো না যে, ‘আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি।’
৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু যা বলেছেন তা স্বাধীনতার চেয়ে বেশি অর্থ বহন করে। বামপন্থিরা চেয়েছিলো বঙ্গবন্ধু সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা করুক। এতে করে তিনি বিশ্বের কাছে হটকারী নেতা হিসেবে চিহ্নিত হবেন, আর সেই সুযোগটাই পাকিস্তানিরা পেয়ে যাবে। বঙ্গবন্ধু ভুট্টোর মতো ছিলেন না। তিনি গণতান্ত্রিক, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন এবং সে শিক্ষার আলোকেই সেদিন দিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন। যাতে সাপ মরেছে, কিন্তু লাঠি ভাঙেনি। তা না হলে কামানের গুলি ও বোমার আঘাতে উপস্থিত দশ লাখ মানুষের মধ্যে ক’জন বেঁচে থাকতো সেটা ভাববার বিষয়। মনে রাখতে হবে সেদিন বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় সব মানুষ রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত ছিলেন। সেদিন বঙ্গবন্ধুসহ সবাই মারা গেলে আজও বাংলাদেশ পরাধীন থাকতো। বঙ্গবন্ধু কৌশলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলেই ৭ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত সমগ্র জাতি প্রস্তুতি নিতে পেরেছিলো। দেশের শীর্ষস্থানীয় নেতারা ঢাকা ছাড়তে পেরেছিলো এবং ১৭ এপ্রিল মুজিব নগর সরকার গঠন করা সম্ভব হয়েছিলো।
বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণ যতোবার শোনা যায়, তৃষ্ণা মেটে না। মনে হয় আরো শুনি। এই ভাষণ শুনে ভবিষৎ প্রজন্ম দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হবে এবং জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরার মানসিকতা নিয়ে নিজদেরকে তৈরি করবে। শেখ মুজিবুর রহমান ভারতীয় উপমহাদেশের একজন অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, যিনি বাঙালির অধিকার রক্ষায় ব্রিটিশ ভারত থেকে ভারত বিভাজন আন্দোলন এবং পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন। তাই তাকে বাংলাদেশের জাতির পিতা বলা হয়ে থাকে।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ মূল্যায়ন করতে গিয়ে ইতিহাসবিদ ও গবেষকরা ভিন্ন ভিন্ন মতামত দেবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু একটি বিষয়ে দ্বিধাহীন চিত্তে সবাই স্বীকার করবেন যে, এটাই ছিল স্বাধীনতার ডাক এবং এই ভাষণই প্রমাণ করেছিল বঙ্গবন্ধু একজন কুশলী রাষ্ট্রনায়ক। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গড়ে তুলতে হবে আমাদের সোনার বাংলা, তাই বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে সার্বিক সহযোগিতা প্রদানের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণ করাই হোক অঙ্গীকার।
লেখক : সাবেক ডিজি, নায়েম