৮০ ভাগ রোগীর ডেঙ্গুর লক্ষণ প্রকাশ পায় না

নিজস্ব প্রতিবেদক |

প্রথমবারের মতো ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন, এমন ৮০ ভাগ মানুষের মধ্যে এ রোগের কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় না। ফলে তারা ডেঙ্গু পরীক্ষাও করান না, এমনকি যে ধরনের সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত সেটিও করেন না।

এই বিপুলসংখ্যক ডেঙ্গু আক্রান্ত থেকে যান সব ধরনের হিসাবের বাইরে। কিন্তু তারা তাদের রক্তে ডেঙ্গুর জীবাণু বহন করেন। ফলে সহজেই তাদের মাধ্যমে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়তে পারে। এমন তথ্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের। সংস্থাটি জানায়, এসব ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী স্বাভাবিক জ্বর মনে করে এটাকে গুরুত্বও দেন না। কিন্তু এই ৮০ ভাগ মানুষও ৫-৭ দিন ডেঙ্গুর জীবাণু বহন করেন এবং তাদের মাধ্যমে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ে। অথচ এ বিষয়টিকে রাষ্ট্রীয়ভাবেও যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হয় না। এ কারণে ডেঙ্গুর স্থায়িত্বকাল ও আক্রান্তের সংখ্যা দুই-ই বাড়তে থাকে।

এদিকে চলতি আগস্টের ৩০ দিনে দেশে ৫০ হাজার ৯৭৪ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন। এই এক মাসে আক্রান্তের সংখ্যা এ বছরের জুলাই মাসের তিন গুণ এবং বিগত ১৮ বছরের আক্রান্তের সংখ্যার চেয়ে বেশি। ২০০০ থেকে ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মোট ৫০ হাজার ১৪৮ জনের ডেঙ্গু চিকিৎসা নেয়ার তথ্য নথিভুক্ত রয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে। এ ছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় (বৃহস্পতিবার সকাল ৮ থেকে শুক্রবার সকাল ৮টা পর্যন্ত) নতুন করে আরও এক হাজার ২৫ জন আক্রান্ত হয়েছেন। যার মধ্যে ঢাকায় ৪৬৫ জন, ঢাকার বাইরে ৫৬০ জন। এ সময়ে আরও একজনের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে।

সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে, লক্ষণ প্রকাশ না পাওয়ায় ৮০ ভাগ ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী চিহ্নিত হচ্ছে না। সেই হিসাব করলে চলতি বছরে এ পর্যন্ত হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন প্রায় ৭০ হাজার ডেঙ্গু রোগী। এটি যদি মোট আক্রান্তের ২০ ভাগ হয় তাহলে আক্রান্তের সংখ্যা ২ লাখ ৮০ হাজার ছাড়িয়েছে। যাদের মাধ্যমে সারা দেশে ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটছে।

এ প্রসঙ্গে মুগদা মেডিকেল কলেজের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. একেএম শামছুজ্জামান বলেন, আমাদের দেশে এ পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে যারা চিকিৎসা নিয়েছেন, প্রকৃত রোগীর সংখ্যা তাদের তুলনায় চার গুণ বেশি। অর্থাৎ মাত্র ২০ ভাগ রোগীর বিভিন্ন লক্ষণ প্রকাশ পায় এবং তারা চিকিৎসকের পরামর্শ বা সেবা নিতে আসেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ ধরনের তথ্য প্রকাশ করেছে। অর্থাৎ হিসাবের বাইরে যে রোগী থেকে যাচ্ছে তাদেরও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।

অধ্যাপক শামছুজ্জামান বলেন, ডেঙ্গুর প্রধান বাহক এডিস ইজিপ্টি। কিন্তু চলতি মৌসুমে জেলা, উপজেলা এমনকি গ্রাম পর্যায়ের মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। সম্প্রতি কুষ্টিয়ার একটি গ্রামে প্রায় অর্ধশত মানুষের আক্রান্তের ঘটনা ঘটেছে। এ থেকে সহজেই অনুমেয়, সেকেন্ডারি ভেক্টর হিসেবে এডিস এলবোপিক্টাস সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। অর্থাৎ ডেঙ্গু ব্যাপক হারে শহর এবং গ্রামে বিস্তারের জন্য শুধু ইজিপ্টিই দায়ী নয় এর পেছনে এলবোপিক্টাসের বিশেষ অবদান রয়েছে। এটা নিয়েই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে আরও বেশি সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালাতে হবে।

সেকেন্ডারি ভেক্টর বা দ্বিতীয় পর্যায়ের বাহক হিসেবে যে এডিস এলবোপিক্টাস ভূমিকা রাখছে সেটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যানেই বোঝা যায়। সেখানে গত ৭ দিনই ঢাকার তুলনায় ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি। গত ২৪ আগস্ট ঢাকায় আক্রান্ত ছিল ৫৭০ জন ঢাকার বাইরে ৬০৯ জন। একইভাবে ২৫ আগস্ট ঢাকা ও ঢাকার বাইরে যথাক্রমে ৬০৭ ও ৬৯২ জন, ২৬ আগস্ট ৫৭৭ ও ৬৭৪, ২৭ আগস্ট ৬০৮ ও ৬৯১, ২৮ আগস্ট ৫৫১ ও ৬০৬, ২৯ আগস্ট ৫২৪ ও ৬৬৫ এবং ৩০ আগস্ট ৪৬৫ ও ৫৬০ জন আক্রান্ত ছিল।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকার বাইরে আক্রান্ত এই বিপুলসংখ্যক রোগীর সবাই ঢাকা থেকে আক্রান্ত হয়ে সেখানে গিয়েছে এটি ধারণা করলে ভুল হবে। এটা নিশ্চিত করেই বলা যায় যে, এদের একটি বড় অংশ স্থানীয়ভাবে আক্রান্ত হয়েছে। যেখানে বাহক হিসেবে কাজ করেছে এডিস এলবোপিক্টাস।

কীটতত্ত্ববিদ ড. মঞ্জুর চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, চলতি বছর জেলা-উপজেলা পর্যায়ে আক্রান্তের হার বেশি দেখা যাচ্ছে। যেহেতু গ্রামীণ এডিস এলবোপিক্টাস দ্বিতীয় পর্যায়ের বাহক হিসেবে কাজ করে তাই বিষয়টি উদ্বেগের। তাছাড়া প্রান্তিক পর্যায়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মশা মারা হয় না। এমনকি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীও এ বিষয়ে তেমন সচেতন নন। তাই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় পর্যায়ে মশক নিধনসহ সচেতনতা কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. সানিয়া তাহমিনা বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্তদের একটি বড় অংশের কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় না, এটা ঠিক। তবে এটি আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে কত ভাগ, সেটি নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, আক্রান্তদের এই অংশটি স্বাভাবিক জীবনযাপন করে। কিন্তু তাদের মাধ্যমেও ডেঙ্গু ট্রান্সমিশন হতে পারে এবং সেটিও স্বাভাবিক। অধ্যাপক সানিয়া বলেন, এ ক্ষেত্রে সবাইকে সচেতন হতে হবে। তাছাড়া সমন্বিতভাবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে সরকার। আশা করছি, ডেঙ্গু আক্রান্তের ক্রম হ্রাসমান হার অব্যাহত থাকবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক ডা. আয়শা আক্তার জানান, গত এক জানুয়ারি থেকে ৩০ আগস্ট পর্যন্ত ৬৯ হাজার ৪৩৫ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে ৬৪ হাজার ৫৫৮ জন সুস্থ হয়ে ছাড়প্রাপ্ত নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৪ হাজার ৬৯৭ জন। যার মধ্যে ঢাকায় ২ হাজার ৬১০ এবং ঢাকার বাইরে ২ হাজার ৮৭ জন। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটে ডেঙ্গু সন্দেহে এ পর্যন্ত ১৮০ জন মৃত রোগীর তথ্য এসেছে। যার মধ্যে ৮৮ জনের তথ্য পর্যালোচনা করে ৫২ জনের ডেঙ্গুজনিত মৃত্যু নিশ্চিত করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

একজনের মৃত্যু : ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। মুন্নি বেগম নামের ৫২ বছর বয়সী ওই নারী কেরানীগঞ্জের খোলামুড়া এলাকার আলী আশরাফ বেপারির স্ত্রী। শুক্রবার সকাল পৌনে ৮টার দিকে আট তলার ডেঙ্গু ওয়ার্ডে তার মৃত্যু হয় বলে মেডিকেল পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া জানান। মুন্নি বেগমের ছেলে ইমরান হোসেন হাসপাতালে সাংবাদিকদের বলেন, বেশ কয়েকদিন জ্বরে ভোগার পর গত বুধবার তার মাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। রক্ত পরীক্ষায় তার ডেঙ্গু ধরা পড়ে।

কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে গ্রামে গ্রামে ডেঙ্গু : দৌলতপুর প্রতিনিধি জানান, উপজেলার আড়িয়া ইউনিয়নের ছাড়ারপাড়ায় প্রায় ৪০ জন নারী-পুরুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন। এ ঘটনায় জেলা ও উপজেলা প্রশাসন থেকে বিশেষ নজরদারি নেয়া হয়েছে। শুক্রবারও সেখানে দু’জন ডেঙ্গু রোগীকে শনাক্ত করা হয়েছে। এদিকে ছাতারপাড়া গ্রামকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও বৃহস্পতি ও শুক্রবার নতুন করে উপজেলার ইউসুফপুর গ্রামে ৭ জন, কমালপুর গ্রামে ২, খলিষাকুণ্ডি গ্রামে ৬ ও মহিষকুণ্ডি গ্রামে ২ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন বলে স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীরা জানিয়েছেন। এ নিয়ে দৌলতপুরে ৫৭ জন ডেঙ্গু রোগীকে শনাক্ত করা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার বিকালে কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক আসলাম হোসেন কর্মকর্তাদের নিয়ে ছাড়ারপাড়া গ্রামে ডেঙ্গু মশা ও লার্ভা ধ্বংসে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম তদারকি ও স্থানীয় মানুষের সঙ্গে মত বিনিময় করেন।

দৌলতপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. অরবিন্দ পাল বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ওই গ্রামে স্বাস্থ্য বিভাগের একটি টিম কাজ শুরু করেছে। বিষয়টি সরকারের উচ্চপর্যায়ে জানানো হয়েছে। ঢাকা থেকে উচ্চ পর্যায়ের মেডিকেল টিম এখানে আসার কথা রয়েছে।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা - dainik shiksha মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা - dainik shiksha দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0029878616333008