জেলা প্রশাসনের শীর্ষ পদে দায়িত্ব পেয়ে জেলা প্রশাসক হিসেবে দেশের ৯টি জেলা সামলাচ্ছেন ৯ জন নারী কর্মকর্তা। শুধু ডিসি পদে নয়, মাঠ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে দিন দিন নারী কর্মকর্তাদের সংখ্যা বাড়ছে। বিসিএস উইমেন নেটওয়ার্ক বলছে, নারীরা সফলভাবে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারছেন বলেই মাঠ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। শুধু প্রশাসন ক্যাডারে নয়, অন্যান্য ক্যাডারেও নারীদের সংখ্যা বাড়ছে। অতিরিক্ত সচিব, ১৬৪ জন যুগ্ম-সচিব, ৩৭০ জন উপসচিব, ৯ জন ডিসি, ৬৩ জন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, ১৬৪ জন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং এসি ল্যান্ড পদে ১৩৩ জন নারী কর্মরত আছেন। অন্য যেকোনো সময়ের থেকে মাঠ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে নারী কর্মকর্তাদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ২২তম বিসিএস ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে নেত্রকোণায় অঞ্জনা খান মজলিশ, বান্দরবানে ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি, মাদারীপুরে ড. রহিমা খাতুন এবং হবিগঞ্জে ইশরাত জাহান ডিসির দায়িত্বে আছেন। আর ২৪তম বিসিএস ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে মুন্সীগঞ্জে কাজী নাহিদ রসুল, ঝিনাইদহে মনিরা বেগম, শেরপুরে সাহেলা আক্তার, রংপুরে ড. এ চিত্রলেখা নাজনীন এবং ঝালকাঠিতে ফারাহ্ গুল নিঝুম ডিসির দায়িত্ব সামলাচ্ছেন।
বান্দরবান জেলায় প্রথমবারের মতো নারী কর্মকর্তা হিসেবে ডিসির দায়িত্ব পেয়েছেন ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি। ডিসির কাজে চ্যালেঞ্জটা নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই সমান বলে মনে করেন তিনি। ইয়াছমিন পারভীন বলেন, 'নারী আর পুরুষদের মানুষ এখন আর আলাদা করে দেখে না। দীর্ঘদিন ধরেই মানুষের মধ্যে এই পরিবর্তন হয়েছে। যখন হাতে গোনা দু-একজন ডিসি নারী ছিলেন তখন মানুষের মধ্যে অন্য রকম ধারণা ছিল। এখন অনেক নারী ইউএনও হিসেবে কাজ করছেন। ডিসির কাজে চ্যালেঞ্জটা নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই সমান।
বান্দরবানসহ পার্বত্য এলাকায় অনেক উন্নয়ন হয়েছে জানিয়ে ইয়াছমিন পারভীন বলেন, 'নারী- পুরুষ আলাদা কোনো বিষয় নয়। নারী ও পুরুষ টিম রয়েছে, সবার সঙ্গেই আমি কাজ করছি। জেলায় একজন নারী ইউএনও আছে। একসময় তিনজন নারী ইউএনও ছিল। আমার দুজন এডিসি নারী।'
নারী ডিসিদের কাছে নারীরা তাদের সমস্যাগুলো খুব সাচ্ছন্দ্যে বলতে পারেন বলে মনে করেন বান্দরবানের ডিসি ইয়াছমিন পারভীন। তিনি বলেন, 'মানুষ অনেক ক্ষেত্রে বিষয়টি (নারী (ডিসি) পজিটিভ দৃষ্টিতে নিয়েছে। অনেকেই মনে করেন একজন নারীর কাছে সমস্যটা খুব সহজেই বলা যাবে। আগে নারীরা ডিসি অফিস পর্যন্ত আসতে সংকোচবোধ করতেন। এখন অনেক নারী আমার কাছে এসে খোলামেলাভাবে যেকোনো সমস্যার কথা, নির্যাতনের কথা বলতে পারছেন। প্রতি বুধবার গণশুনানি করি, সেখানে অনেক নারী এসে সমস্যার কথা বলেন। তারা মনে করেন, একজন পুরুষকে বললে সেটা যতটা না অ্যাড্রেস হতো, একজন নারী ডিসির কাছে অভিযোগ সম্পর্কে বলাটা বেশ সহজ। বান্দরবান পর্যটনসমৃদ্ধ জেলা, এখানে অনেক পর্যটক আসেন, ভিআইপিরা আসেন, সেক্ষেত্রেও কোনো সমস্যা হয় না।” চাঁদপুরে এক বছর পাঁচ মাস ডিসির দায়িত্ব সামলে গত ৯ মাস ধরে নেত্রকোণার ডিসির দায়িত্বে আছেন অঞ্জনা খান মজলিশ। তিনি বলেন, 'নারী হিসেবে কাজ করেতে গিয়ে কোনো বাধার মুখে পড়িনি। সাচ্ছন্দ্যেই কাজ করছি। একজন ডিসি হিসেবে জনপ্রতিনিধি,সুধী সমাজ, বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাধারণ নাগরিক, সরকারি কর্মকর্তাসহ অন্যদের সঙ্গে যে কাজগুলো করা উচিত সবার সঙ্গে সমন্বয় করেই তা করছি। এসব কাজ করতে গিয়ে নারী বা পুরুষের কোনো পার্থক্য মনে হয়নি। মানুষ নারীদের এখন আর নেতিবাচকভাবে দেখে না।
বিসিএস উইমেন নেটওয়ার্কের মহাসচিব ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব সায়লা ফারজানা বলেন, “নারীরা জেলা প্রশাসক হিসেবে অনেক বছর ধরেই কাজ করছেন। মাঠ প্রশাসনে কাজ করতে নারীদের জন্য চ্যালেঞ্জ তো আছেই। কক্সবাজারে যিনি কাজ করছেন তার জন্য চ্যালেঞ্জ এক ধরনের, আর বরগুনার ডিসির চ্যালেঞ্জটা অন্য ধরনের। কারণ অবস্থানগত, রাজনৈতিক, সামাজিক আচারের সঙ্গে মানিয়ে নেয়াটাও এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। এখন নারীরা এসব চ্যালেঞ্জ ঠিকমতো উত্তরে উঠছেন। চ্যালেঞ্জ আছে, তবে সেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার সমক্ষতাও নারীদের রয়েছে। নারীরা সফলভাবে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে কাজ করছেন বলেই নারী জেলা প্রশাসকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। মাঠ প্রশাসনের অন্য গুরুত্বপূর্ণ পদেও নারীদের সংখ্যা বাড়ছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, 'প্রধানমন্ত্রী চান গুরুত্বপূর্ণ আরও বেশি সংখ্যক পদে নারীদের পদায়ন করা হোক। ফলে প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে দিন দিন নারী কর্মকর্তাদের সংখ্যা বাড়ছে। সেসব দায়িত্বে নারীরা সফলতারও প্রমাণ রাখছেন।”
সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদপ্তর, দপ্তর ও সরকারি অফিসে এখন ১১ লাখ ৫০ হাজার ৩৩৬ জন পুরুষ এবং ৪ লাখ ৪ হাজার ৫৯১ জন নারী কাজ করছেন। সরকারি চাকরিতে নারীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগের মাধ্যমে বিভিন্ন দপ্তরে পদায়ন করা হয়। এই অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. আব্দুস সবুর মণ্ডল মনে করেন, কোনোক্ষেত্রেই নারীরা এখন আর পিছিয়ে নেই। বরং অনেক ক্ষেত্রে তারা পুরুষদের চেয়ে এগিয়ে।
তিনি বলেন, 'নারী আর পুরুষদের এখন আর আলাদা করে দেখা হয়। না। সবাই মানুষের জন্য কাজ করছেন। সচিব, ডিসি, ইউএনও থেকে শুরু করে জনপ্রশাসনের অন্যান্য পদে এখন অনেক নারী কাজ করছেন। শুধু প্রশাসন ক্যাডারে নয়, অন্যান্য ক্যাডারের গুরুত্বপূর্ণ পদেও অনেক নারী কাজ করছেন। নারীরা পুরুষদের চেয়ে এখন আর পিছিয়ে নয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা এগিয়ে।'