পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে আসেন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রথম ভাষণে আনন্দের অতিশয্যে কান্না জড়িত কণ্ঠে সেদিন বলেন- কবিগুরু, আজ তোমার বাণী মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে।
কবিগুরু একদা বলেছিলেন- ‘সাড়ে সাত কোটি বাঙালিরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করোনি।’ তারই জবাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশে ফিরে প্রথম ভাষণে এই কথাটি বলেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে না এলে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সেই হতাশার বাণী মিথ্যা প্রমাণ করার জন্য বাঙালি যে মানুষ হয়েছে এই কথাটি কে বলতে পারতেন? দেশে ফিরে না এলে হয়তোবা আফগানিস্তানের মতো বাংলাদেশকে সারাবিশ্ব থেকে একঘরে হয়ে থাকতে হতো। সেই দিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিমের দেশগুলো, আরবের দেশগুলো, চীনসহ প্রতিবেশী শ্রীলংকা, মিয়ানমার সব সরকারই পাকিস্তানের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলো। তাই তো মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের কর্মকর্তা বলেছিলেন, 'বাংলাদেশ বটমলেস বাস্কেট কেস'।
ওই ঘটনার আরও আগে যাওয়া যাক। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির চোখে ঘুম নেই তখন, সবার উদ্বেগ উৎকণ্ঠা- কি হয়, কি হয়। আর পূর্ব পাকিস্তানে মোতায়েন পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর অধিনায়কদের উত্তেজনা কখন তারা ঝাঁপিয়ে পড়বে বাঙালির উপর, তাদেরকে উপযুক্ত শিক্ষা দেবে। তাদের কাপুরুষ নেতা ইয়াহিয়া খান উপস্থিত থেকে এই অভিযান চালাতে সাহস করেনি। তাই ২৫ শে মার্চ দিবাগত রাতে সন্তর্পণে পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করেছে এই নির্দেশ দিয়ে যে- করাচি না পৌঁছানো পর্যন্ত কোনো অভিযান চালানো যাবে না।
তারই কসাই টিক্কা খান নির্দেশিত সময়ে ওয়ারলেসের নির্দেশ দেন, ব্রিগেডিয়ার জেহানজেব আরবাব ববি'র অধীনস্ত ৫৭ ব্রিগেডের ৩ কমান্ডো কোম্পানির স্পেশাল সার্ভিসেস গ্রুপ (এসএসজি) কোম্পানি কমান্ডার মেজর বিলাল রানা আহমেদ আর তার কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল জেড এ খান সাথে ৫০ জন কমান্ডো বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের অভিযান চালাবে। মেজর বিলালকে নির্দেশ দেওয়া ছিলো, শেখ মুজিবকে জীবিত গ্রেপ্তার করতে হবে।
ধানমন্ডি ৩২ নম্বারের রাস্তায় ব্যারিকেড মর্টার শেলে উড়িয়ে দিয়ে বাড়িতে ঢোকার পথে একজন প্রহরীকে গুলি করে ভেতরে প্রবেশ করে তারা। ৬৭৭ নম্বর বাড়ির দোতালায় উঠতেই দরজা খুলে বঙ্গবন্ধু বলেন, কেন তোমরা গুলি করছ? আমাকে যদি মারতে চাও আমি তো এখানেই রয়েছি, কেন তোমরা আমার লোকজনকে মারছো?
বঙ্গবন্ধু গ্রেফতারের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়েই ছিলেন। তা সত্ত্বেও মেজর বিলাল তাকে জানান যে, তিনি গ্রেপ্তার। আর ৫৭ ব্রিগেডের মেজর জাফর ওয়ারলেসে কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেয়, ‘বিগ বার্ড ইন দ্য কেজ …. আদার বার্ড নট ইন দ্য নেস্ট’।
প্রথমে নির্মাণাধীন সংসদ ভবন, তারপর ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুলের একটি অন্ধকার অপরিষ্কার কক্ষে রাখার পর ক্যান্টনমেন্ট ফ্লাগ স্টাফ হাউস বা জিওসি'র বাংলো বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে শেষ আশ্রয় স্থান। পঁচিশে মার্চ দিবাগত রাত্রি অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে গ্রেফতারের পর পয়লা এপ্রিল করাচিতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে একটি স্পেশাল বিমানে লায়ালপুর কারাগারে, তারপর উত্তর পাঞ্জাবের মিয়ানয়ালির মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের কারাগারে রাখা হয়। এখানেই কারাগারে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের সাব-ইন্সপেক্টর রাজা আনার খান কয়েদির বেশে বঙ্গবন্ধুর সাথে বন্ধুত্ব স্থাপনের চেষ্টা করে সময়ে সময়ে তার সম্পর্কে রিপোর্ট করেছেন। প্রথম দিকে বঙ্গবন্ধু তার সাথে ভাব বিনিময় না করলেও পরবর্তীকালে নিঃসঙ্গ জীবনে তার সাথে কথা বলেছেন। তার প্রমাণ পাওয়া যায় বঙ্গবন্ধু যখন ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে ওআইসির সম্মেলনে যান, তখন পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের কাছে রাজা আনার খানের সঙ্গে সাক্ষাতের অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু আনার খান পাকিস্তানের কর্তৃপক্ষের ভয়ে সাক্ষাত করেননি অথবা পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ তাকে সাক্ষাৎ করতে দেয়নি। পাকিস্তানের সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, রাজা আনার খান এর পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর কারা প্রকোষ্ঠের চেয়ারে বেতার যন্ত্রের আড়িপাতা হয়েছিল। এমনই অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ১০ আগস্ট ১৬টি অভিযোগ আনা হয়। আর এই অভিযোগের ছয়টির শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। স্বাধীনতার ঘোষণায় বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে গণ্য করার নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং প্রতিটি বাঙালিকে পাকিস্তানের শেষ সেনা না যাওয়া পর্যন্ত যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছিলেন। এই যুদ্ধ ঘোষণা তার অপরাধ। সেই অপরাধে সামরিক আদালতে বিচারে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তার পরবর্তী ঘটনার গতি প্রকৃতি নিম্নরূপ।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড ইয়াহিয়া খানের সাথে দেখা করেন ২০ আগস্ট এবং শেখ মুজিবকে মৃত্যুদণ্ড না দেয়ার জন্য মার্কিন সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন। ইয়াহিয়া খান নাকি তাকে শেখ মুজিবকে মৃত্যুদণ্ড দেবেন না বলে জানিয়েছিলেন। ইতোমধ্যে ১৬ই ডিসেম্বর এসে গেছে। ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য আত্মসমর্পণ করেছে। তাদেরকে দেশে ফিরিয়ে নিতে পশ্চিম পাকিস্তানে তাদের আত্মীয়-স্বজন ব্যাকুল। এতদিন পাকিস্তানের জনসাধারণকে জানানো হয়েছে, তারা যুদ্ধে জয়লাভ করছে, বাঙালিকে শায়েস্তা করছে, ভারতকে ছিড়ে টুকরো টুকরো করবে। ৩ ডিসেম্বর ভারত যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে তখন পাকিস্তানের প্রতিটি গাড়িতে স্টিকার লাগানো হয়- ভারতকে ছিন্নভিন্ন কর। পাকিস্তান জুড়ে ব্যাপক জাতীয়তাবাদী উত্তেজনা। ১৬ই ডিসেম্বরের পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের খবর যেন আগুনে পানি ঢেলে দেওয়া। পাকিস্তানের জনসাধারণ শোকে দুঃখে বিমূঢ়, বিহবল। তারা তাদের আপনজনকে ফিরে পাবে কি পাবে না সেই চিন্তায় বিনিদ্র রজনী অতিবাহিত করছে। দরকষাকষির একমাত্র পণ্য তাদের কাছে আটক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে ফেরত আনার স্বপক্ষে বিশ্বজনমত তৈরি করতে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড সফর করলেন। অপরদিকে পাকিস্তান সরকার আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা ঠুকলেন জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী যুদ্ধবন্দীদের পাকিস্তানে ফেরত দেওয়ার জন্য।
৩ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জুলফিকার আলী ভুট্টো করাচির ময়দানে ঘোষণা দিলেন, শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্ত করে দেয়া হবে। উপস্থিত লক্ষ লক্ষ পাকিস্তানি জনতা তা সমর্থন করলেন। ইতোমধ্যেই খবর ছড়িয়ে পড়েছে, এ এ কে নিয়াজি নিহত। মিয়ানওয়ালি এ এ কে নিয়াজির জন্ম জেলায়। তাই সেখানকার জেলের কয়েদিরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার চেষ্টা করেছিলো। নানা নাটকের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে জেলখানা থেকে সাব-জেইলর খাজার বাড়িতে স্থানান্তর করা হয়। সেখান থেকে রাওয়ালপিন্ডির সেহেলি রেস্ট হাউসে। এখানেই ২৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ও সামরিক আইন প্রশাসক জুলফিকার আলী ভুট্টো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সাথে দেখা করেন। তারপর তারই অনুরোধে ড. কামাল হোসেনকে সেখানে আনা হয়। পরপর দু'বার বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করার পর ৮ জানুয়ারি গভীর রাতে তাকে ব্রিটিশ এয়ারের একটি প্লেনে কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তার সাথে তুলে দেওয়া হয় লন্ডনের পথে। ৮ তারিখ সকাল ৮ টা ১০ মিনিটে পি আই এর বিমানটি হিথ্রো বিমানবন্দরের রানওয়ে ছুঁয়ে টার্মিনালে আসতেই আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন অপেক্ষমাণ কর্মকর্তারা। একসময়ের মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদি রাষ্ট্রীয় সম্মানে সাবেক আরেক কলোনির সরকারের কাছে আদৃত আর সম্মানিত হচ্ছে।
বিমানবন্দরে সংক্ষিপ্ত ভাষণের লন্ডনের ক্লারিজ হোটেলে ওঠেন বঙ্গবন্ধু। সেই হোটেলে সংবাদ সম্মেলন করলেন। ওই দিন সকালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ এর সঙ্গে দেখা করলেন। তারপর রাণীর বিমানে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা। মাঝপথে সাইপ্রাসে জ্বালানি সংগ্রহের পর ১১ ঘণ্টায় দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে। তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ, ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসিন্দা ফারুক চৌধুরী, ড. কামাল হোসেন ও তার স্ত্রী, মি. মাওলা ও অন্যরাসহ ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। তারপর কতো বছর গত হলো। বাঙালি আজ শুধু মানুষ হওয়ার কথা ভাবছে না, স্মার্ট হওয়ার কথা ভাবছে।
লেখক : মো. নজরুল ইসলাম খান, সাবেক শিক্ষাসচিব