বিনিয়োগ শিক্ষার অভাবই ছিল অতীতের পুঁজিবাজার ধসের মূল কারণ। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মৌলিক বিষয়গুলোকে বিবেচনায় না নিয়ে কোনো একটা বড় গ্রুপকে অনুসরণ করছি, বড় বিনিয়োগকারীদের অনুসরণ করছি। অনেকটা ভেড়ার পালের মতো করে ছুটছি। বিনিয়োগের সাথে যে ঝুঁকির বিষয় আছে সেটি ভুলে যাচ্ছি। আমরা আইটেম খুঁজছি বলে মন্তব্য করেছেন পুঁজিবাজার বিশ্লেষজ্ঞরা। আর বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কমিশনার ড. শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ বলছেন, বিনিয়োগ শিক্ষাকে অর্থায়ন শিক্ষা হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। এই শিক্ষার চাহিদা এবং ধরন বয়স ও সময়ের সাথে পরিবর্তিত হচ্ছে। সশরীরে উপস্থিত হয়ে এই শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ কমে আসছে। তাই এই শিক্ষাকে হাইব্রিড পদ্ধতিতে নিয়ে যাওয়া বেশ জরুরি। ফিজিক্যাল শিক্ষার পাশাপাশি অনলাইন ভিত্তিক শিক্ষাকে গুরুত্ব দিতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন।
গতকাল ‘বিনিয়োগ শিক্ষা ও পুঁজিবাজার’ বিষয়ক সেমিনারে বক্তারা এই অভিমত ব্যক্ত করেন। অর্থসূচক ক্যাপিটাল মার্কেট এক্সপো-২০২৩ আয়োজিত এই সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন বিএসইসি কমিশনার ড. শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ। সেমিনারে সেশন চেয়ারের দায়িত্ব পালন করেন বিএএসএমের মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী। অতিথি ছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. এম সাদেকুল ইসলাম। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন, বাংলাদেশ একাডেমি ফর সিকিউরিটিজ মার্কেট (বিএএসএম) এর ফ্যাকাল্টি রিজভী আহমেদ। আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন, বিএসইসি নির্বাহী পরিচালক মাহবুবুল আলম, গ্রিন ডেল্টা সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওয়াফী শফিক মিনহাজ খান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক আল-আমিন।
বিএসইসি কমিশনার বলেন, বিশ্লেষণ ও জেনে-বুঝে বিনিয়োগ করতে চাইলে আর্থিক তথ্য জানা বেশ জরুরি। তাই সাধারণ তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। এ বিষয়ে এখনও বেশ কিছু ঘাটতি আছে। এমনকি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ওয়েবসাইটেও প্রয়োজনীয় অনেক তথ্য পাওয়া যায় না। সেখানে তালিকাভুক্ত অনেক কোম্পানির সর্বশেষ নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য আপলোড করা নেই। তিনি বলেন, বিনিয়োগ শিক্ষা দেয়ার ক্ষেত্রে অনেক গ্যাপ রয়েছে। তবে আস্থার ক্ষেত্রে কোনো ঘাটতি নেই। অভাব ও আস্থার ঘাটতি থাকলে বর্তমানে অনেক বিনিয়োগ আসতো না। ব্যাংকগুলোতেও এখন নতুন নতুন প্রজেক্টের অফার আসে। সবাই এক সঙ্গে কাজ করলে দেশের পুঁজিবাজার ও অর্থনীতি এগিয়ে যাবে।
মূল প্রবন্ধে রিজভী আহমেদ বলেন, বিনিয়োগ শিক্ষা নিয়ে যারা চিন্তা করেছে তারাই লাভবান হয়েছে। অতীতের পুঁজিবাজার ধসের মূল কারণ ছিল বিনিয়োগ শিক্ষার অভাব। মূল্যস্ফীতিসহ অন্যান্য বিষয়ের প্রভাব পুঁজিবাজারে কিভাবে পড়ে সেটাও জানতে হবে। বিনিয়োগ শিক্ষার অনেক উপকারিতা রয়েছে। মূল্যস্ফীতি হলে পুঁজিবাজারে কী ধরনের প্রভাব পড়ে এ বিষয়ে জানতে হবে। তিনি বলেন, যেসব দেশের মানুষ গণিতে ভালো তারা বিনিয়োগ শিক্ষা বেশি বুঝে। জমানো সব টাকা দিয়ে শেয়ার কেনা উচিত না। প্রতি মাসে অল্প করে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা উচিত। এভাবে বিনিয়োগ করলে শিক্ষা পুঁজিবাজারে কাজে লাগানো যাবে।.
মাহবুবুল আলম বলেন, বিনিয়োগ শিক্ষার ধারণা থাকলে নিজেই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করা সম্ভব। আর যদি কেউ রিস্ক নিতে না চায় তাহলে মিউচুয়াল ফান্ড বন্ডে বিনিয়োগ করতে পারে। এ ছাড়া কিছু না বুঝলে তখন কোনো প্রতিষ্ঠানের সাহায্য নেয়া যায়। তিনি বলেন, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মৌলিক বিষয়গুলোকে বিবেচনায় না নিয়ে কোনো একটা বড় গ্রুপকে অনুসরণ করছি, বড় বিনিয়োগকারীদের অনুসরণ করছি। অনেকটা ভেড়ার পালের মতো করে ছুটছি। তিনি বলেন, বিনিয়োগের সাথে যে ঝুঁকির বিষয় আছে সেটি ভুলে যাচ্ছি। আমরা আইটেম খুঁজছি। বিভিন্ন জনের কাছে জানতে চাই- এখন আইটেম কী আছে। আমরা গুজবে বিশ্বাস করে বিনিয়োগ করছি। শোনা গেছে, ওমুক কোম্পানির শেয়ার ১০০ টাকা থেকে কয়েক দিনের মধ্যে ৫০০ টাকা হয়ে যাবে। কোনো কিছু চিন্তা না করেই ওই শেয়ার কিনে বিপদে পড়ছি।
ওয়াফী শফিক মিনহাজ খান বলেন, এই খাত স্রোতের সঙ্গে চলছে। অধিকাংশ মানুষের শিক্ষার প্রয়োজন হচ্ছে না। ব্রোকারেজ হাউজগুলো আইটেম দিতে না পারলে সে খারাপ হয়ে যায়। কারণ বিনিয়োগকারীরা আগেই এভাবে শিখে আসছে। তাই তারা এরকম আচরণ করছে। বিএসইসি, ডিএসই ও সিএসই একসঙ্গে কাজ করছে। এ ছাড়া বিএএসএম আমাদের অনেক কোর্সের অফার করছে। তিনি বলেন, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে মিউচুয়াল ফান্ডের অনেক জনপ্রিয়তা। সেই তুলনায় আমরা এগোতে পারিনি। আমরা সবাই এক সঙ্গে মিলে ইন্টারেস্টিং পদ্ধতিতে বিনিয়োগ শিক্ষা দিতে পারলে অনেক ভালো হবে। অন্য মানুষের কথা শুনেই বিনিয়োগ করা উচিত না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এম সাদিকুল ইসলাম বলেন, বিনিয়োগ শিক্ষার অভাব সবখানে আছে। আমাদের দেশের পুঁজিবাজারে সূচকের উত্থান অনেক বেশি হয়, একইভাবে আবার সূচকের পতন হয়। মার্জিন লোন নিয়ে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করলে ঝুঁকি আরো বেড়ে যায়। এ ছাড়া শেয়ার এর দাম ওঠা-নামা করার জন্য সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন দায়ী না। দেশের এসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিগুলো যেন টাকা নিয়ে পালাতে না পারে সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। পুঁজিবাজারের স্বল্প মূলধনী কোম্পানি কোম্পানিগুলো নিয়ে ভাবতে হবে। কারণ এসব কোম্পানিতে শেয়ার কারসাজির পরিমাণ বেশি হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক আল-আমিন বলেন, ফ্লোর প্রাইস দেয়ার পেছনে অনেকগুলো কারণ ছিল। শেয়ার কারসাজির সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারিরাও জড়িত থাকেন। তাই সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ শিক্ষা থাকাটা খুবই দরকার। এ ক্ষেত্রে বর্তমানে বিএসইসি বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। এর পরেও অনলাইন মিডিয়াগুলোতে সচেতনতা বাড়াতে প্রতি সপ্তাহে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যেতে পারে। এ ছাড়া নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা এক সঙ্গে মিলে কাজ করলে এসব সমস্যার সমাধান হবে।