‘ভাষাহীন শেষের উৎসবে’ রবীন্দ্র যাত্রা

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

জীবনের শেষের দিনগুলোতে রবীন্দ্রমানস আশা-নিরাশার নানা চিত্রের ছবি এঁকে বলেছিলেন কিছুটা স্বগতোক্তির মতো। ‘পুনশ্চ’ রচনার পর সে ভাবনা প্রকাশ্যে রূপ পায়। জনান্তিকে বলে রাখা ভালো : পুনশ্চ নামকরণেই বোঝা যায়, তিনি তাঁর বক্তব্যের যা ছিল বলা শেষ করেছেন। যিকঞ্চিৎ যা বাকি ছিল, তা পত্রলেখা শেষ করে পুনশ্চের মতো বলে গেলেন। যদিও তিনি নিজেই বলেছেন, ‘শেষ নাহি যে, শেষ কথা কে বলবে’? তাই এসেছে ‘পরিশেষ’।

তিনি ভাবছেন, সেটাই বুঝি তাঁর শেষ বাণী। এ কারণে এ কাব্যের সংযোজনে সন্নিবেশিত হয়েছে ১৩৪১ বঙ্গাব্দের ভাদ্র মাসে লেখা অতুলপ্রসাদ সেন কবিতাটি। এখানে দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে প্রবল জীবনাগ্রাহী কবি বলে ফেলেছেন, ‘দীর্ঘ আয়ু দীর্ঘ অভিশাপ’... তাই ‘যত দিন ব্যথা রহে বাকি। তার বেশি যেন নাহি থাকি। মঙ্গলবার ৬ (আগস্ট) কালের কণ্ঠ প্রত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। নিবন্ধনটি লিখেছেন গোলাম কবির।

’ এরপর ‘শেষ লেখা’ পর্যন্ত তিনি লিখে গেছেন জীবনের দেনা-পাওনা শোধের অনুপম আলেখ্য। আমরা একটি শুনে সেই আলেখ্য প্রত্যক্ষ করব। ‘কী পাইনি তারি হিসাব মিলাতে/মন মোর নহে রাজি।’ গানটি কবি জীবনের প্রায় উপান্তে রচিত। কিছুটা বিষাদ ও বৈরাগ্যের সুর ধ্বনিত হলেও জীবনবাদিতার অনুরণন থেকে বঞ্চিতের কথা শোনা যায়নি। খ্যাতির আর ভালোবাসার কাঙাল কে নয়? তিনিও ছিলেন, তবে মানবমুক্তির পথের সন্ধানে আমৃত্যু তিনি ব্যাপৃত ছিলেন। তাই নিরাসক্ত নির্মোহ চিত্তে বলতে পেরেছেন : ‘কী পাইনি তার হিসাব মিলাতে/মন মোর নহে রাজি।’

মানবমুক্তির প্রতিষ্ঠান শান্তিনিকেতনের উন্নয়নের জন্য তিনি দেশে-পরদেশে বক্তৃতার বিনিময়ে অর্থ সাহায্য নিয়েছেন। নিজের কিংবা পরিবারের বিলাসিতায় তা স্পর্শ করেননি। নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হওয়ার প্রাপ্তি হিসেবে যে অর্থ পান, তাও পূর্ব বাংলার একসময়ের প্রাণ শক্তি—অথচ অবহেলিত কৃষকদের কল্যাণে উৎসর্গ করেন। পতিসর তথা বাংলার ইতিহাসে যা অবিস্মরণীয় হয়ে আছে।

কবিজীবনের কর্মপ্রবাহ সাক্ষ্য বহন করে মানবভাবনায় তাঁর আমৃত্যু ব্যাপৃত্তি। ১৯৩০ সালের প্রলয়ংকরী বিহারের ভূমিকম্প সম্পর্কে গান্ধীজি মন্তব্য করেছিলেন, মানুষের কৃত অপরাধের ফলে সেই মহাদুর্যোগে সম্পদ আর অসংখ্য প্রাণহানি। রবীন্দ্রনাথ সেই বিশ্বাসের পথে চলেননি। রাশিয়া ঘুরে আসা কবির মানসিক পরিবর্তন তখনকার কবিতা গদ্যে লক্ষ করা যায়। রবীন্দ্রনাথ মানুষের অপরাধকে দায়ী করতে চাননি। বিজ্ঞান বলে, ভূগর্ভের প্লেটের নৈমিত্তিক পরিবর্তনের ফলে ভূপৃষ্ঠের কোথাও ওলটপালট হয়। এখানে মানুষের করণীয় কী আছে। মানুষের হাত নেই। রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞানের প্রতি আস্থা ছিল। তিনি মনে করতেন, রাষ্ট্র সমাজ ও জীবনে অনাচার অনাসৃষ্টির মূলে ক্ষমতাধর মানবগোষ্ঠীই দায়ী। পহেলা বৈশাখ ১৩৪৮ (১৯৪১) জীবদ্দশায় শেষ জন্মোৎসব উদ্যাপনের দিনে ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধটি রচিত ও পঠিত হয়। এখানেই তিনি তা অকপটে ব্যক্ত করে গেছেন।

ইউরোপের জ্ঞানভাণ্ডারের প্রতি রবীন্দ্রনাথ নমনীয় থাকলেও তাদের মানবতাবিধ্বংসী আগ্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য তাঁর সমর্থন প্রত্যাহার করেছেন জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাযজ্ঞের নৃশংসতায়। এই রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া নিয়ে ব্যাপৃত থাকতে পারেন না।

‘কী পাইনি’ গানটির দ্বিতীয় স্তবকে কবির আকুতি, ‘ভালোবেসেছিনু এই ধরণীরে/সেই স্মৃতি মনে আসে ফিরে ফিরে,/কত বসন্তে দখিন সমীরে/ভরেছে আবার সাজি।’ ভালোবাসার এই অনন্তধারা কবির মনোগঙ্গায় যে অবিশ্রান্ত ছিল, তার অনেক প্রমাণের মধ্যে জীবনের শেষ প্রান্তে বসে ‘শেষের কবিতা’ রচনা।

কবির মহাপ্রয়াণ নিয়ে বিতর্কে পাণ্ডিত্যে শীর্ষে ওঠার কতই না প্রতিযোগিতা! মনে রাখা দরকার, জীবনকে অনন্তকাল ধরে রাখার কৌশল আবিষ্কৃত হলে প্রলয় আর ডাকতে হবে না। সব কিছুই নাস্তিতে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। মৃত্যু জীবনের স্বাভাবিক পরিণতি। এ নিয়ে রবীন্দ্র কবিমানসের অভিধা অপরিবর্তনীয়। তবে মৃত্যুর পরের জগৎ সম্পর্কে তিনি স্পষ্ট কিছু বলেননি। জীবন পরিক্রমায় এই যে পথচলা, তার একটা বাহ্যিক পরিসমাপ্তি আছে; কিন্তু তারপর? তিনি নিজেই প্রশ্ন করেছেন : ‘পথের শেষ কোথায়, শেষ কোথায়, কী আছে শেষে!’ না, তিনি জানেন না।

তবে ভাবেন : ‘হাল-ভাঙা পাল-ছেঁড়া ব্যথা চলেছে নিরুদ্দেশে!’ এই নিরুদ্দিষ্ট বিষয় তাঁকে আকুল না করলেও যদিও জীবনের অনুষঙ্গগুলো তৃপ্তিকর দেখে যাওয়ার বাসনা তাঁর তীব্র ছিল। কী পাইনি গানের শেষে রবীন্দ্র উচ্চারণ : ‘মাঝে মাঝে বটে ছিঁড়েছিলো তার,/তাই নিয়ে কেবা করে হাহাকার,/সুর তবু লেগেছিলো বার বার/মনে পড়ে তাই আজি’ মনে পড়ত বলে সত্যিকার শিক্ষালাভ, অর্থবহ স্বাধিকার অর্জন এবং স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য তিনি বাস্তবে কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। আমরা সে পথে অগ্রসর হলে আমাদের চিত্তের দীনতা ঘুচবে বলে বিশ্বাস রাখলে ঠকার আশঙ্কা নেই।

রক্তমাংসের শরীর নিষ্পন্দ হয়ে যাওয়ার কয়দিন আগে ১৯৪১ সালের মে মাসের ৬ তারিখে শান্তিনিকেতনের উদয়নে সকালবেলায় তাঁর বাসনা ছিল ‘মানুষের শেষ আশীর্বাদ’ সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার। তাই তিনি ব্যক্ত করলেন : ‘শূন্য ঝুলি আজিকে আমার/দিয়েছি উজাড় করি/যাহা কিছু আছিল দিবার, প্রতিদানে যদি কিছু পাই—/কিছু স্নেহ কিছু ক্ষমা/তবে তাহা সংগে নিয়ে যাই/পারের খেয়ায় যাব যবে/ভাষাহীন শেষের উৎসবে।—’ (শেষ লেখা, ১০ সংখ্যক কবিতা)

লেখক : সাবেক শিক্ষক, রাজশাহী কলেজ।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
কাল থেকে শিক্ষা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চলবে সব প্রাথমিক বিদ্যালয় - dainik shiksha কাল থেকে শিক্ষা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চলবে সব প্রাথমিক বিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান বাড়ানোর নির্দেশ রাষ্ট্রপতির - dainik shiksha বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান বাড়ানোর নির্দেশ রাষ্ট্রপতির ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দাবিতে দেশজুড়ে সংহতি সমাবেশ - dainik shiksha ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দাবিতে দেশজুড়ে সংহতি সমাবেশ সব মাদরাসার ওয়েবসাইট ও তথ্য হালনাগাদের নির্দেশ - dainik shiksha সব মাদরাসার ওয়েবসাইট ও তথ্য হালনাগাদের নির্দেশ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক : দুই মন্ত্রণালয় যা করবে - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক : দুই মন্ত্রণালয় যা করবে নার্সিং-মিডওয়াইফারি ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ - dainik shiksha নার্সিং-মিডওয়াইফারি ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় সিনিয়র আইনজীবীরা বিচার বিভাগের স্বার্থে কথা বলবেন, আশা প্রধান বিচারপতির - dainik shiksha সিনিয়র আইনজীবীরা বিচার বিভাগের স্বার্থে কথা বলবেন, আশা প্রধান বিচারপতির দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0025818347930908