‘মাথা নিচু কর ক্ষমা চা’

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

পোশাকের কারণে নরসিংদীর রেলস্টেশনে মারধর ও লাঞ্ছনার শিকার ওই তরুণী মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। এখন তিনি এক ধরনের ট্রমার মধ্যে আছেন। এই ঘটনার বিচার চাইতেও ভয় পাচ্ছেন। হেনস্তার শিকার হয়ে উল্টো সোশ্যাল মিডিয়ায় সাম্প্রদায়িক মানসিকতায় বিশ্বাস করেন এমন গোষ্ঠীর বুলিং ও ট্রলের শিকার হন কিনা, আছেন সেই আতঙ্কেও। রোববার (২২ মে) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জামালের মাখানো মুড়ি খেতে নরসিংদী যান ওই তরুণী। তিনি পড়াশোনা করছেন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে। নরসিংদীতে বেড়ানোর সময় তাঁরা মোট চার বন্ধু ছিলেন। এর মধ্যে দু'জনের গ্রামের বাড়ি নরসিংদী। গতকাল দু'জনের সঙ্গে কথা হয়।

তাঁরা জানান, এমন ঘটনা ঘটতে পারে এটা কল্পনারও বাইরে ছিল তাঁদের। বিশেষ করে দুই নারী যখন ঘটনার সূত্রপাত করেন, এটা তাঁদের বিস্মিত করে। ওই দুই নারী প্রথমে তাঁদের বান্ধবীর পোশাক নিয়ে বাজে মন্তব্য করতে থাকেন। এরপর কয়েকজন পুরুষসহ নারীরা তাঁদের মারধর করেন। শুধু তাই নয়, উল্টো তাঁদের দিয়ে হেনস্তাকারী ওই নারীদের কাছে জোরপূর্বক ক্ষমা চাওয়ানো হয়। মারধার করে ওই দুই নারীর পায়ের কাছে মাথা নিচু করে বসিয়ে রাখা হয়।

ওই ঘটনার চারটি সিসিটিভির ফুটেজ ও ভিডিও চিত্র গণমাধ্যামের হাতে এসেছে। সেখানে দেখা যায়, জিন্স প্যান্ট ও টপস পরার কারণে নরসিংদী রেলস্টেশনে ভয়াবহ হেনস্তা, লাঞ্ছনা এবং মারধরের শিকার হয়েছেন এক তরুণী।

এতে দেখা যায়, পোশাকের কারণে ওই তরুণীকে স্টেশনে অপেক্ষমাণ দুই নারী প্রথমে অশ্রাব্য ভাষায় গালমন্দ করেন। মধ্যবয়সী ওই দুই নারীর পরনে ছিল সালোয়ার-কামিজ। এরপর তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হন আরও কয়েক ব্যক্তি। লাঞ্ছনার শিকার ওই তরুণী বারবার বলতে থাকেন- 'এটা তো স্বাধীন দেশ। আমার পোশাক নিয়ে কেন আপনারা এভাবে কথা বলছেন। দেখতে তো আপনাদের ভদ্র মনে হয়।'

এরপর ওই নারীসহ আরও কয়েকজন চড়াও হন তাঁর ওপর। ওই তরুণীর সঙ্গে বন্ধুদের মারধর শুরু করেন মধ্যবয়সী এক লোক। লাল টি-শার্ট পরা এক ব্যক্তি পেছনে গিয়ে ওই তরুণীকে আঘাত করতে থাকেন। পরিস্থিতি খারাপ দেখে তাঁরা দৌড়ে রেলের স্টেশন অফিসারের কক্ষের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তখন পেছনে পেছনে দৌড়ে ওই তরুণীকে ধরার চেষ্টা করেন কয়েকজন। তবে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ লাঞ্ছনাকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ওই ঘটনার পরই স্টেশন মাস্টার আতঙ্কে এলাকা ত্যাগ করেন। গতকাল পর্যন্ত তিনি কাজেও যোগ দেননি।

নর্থ সাউথের ওই ছাত্রীর এক বন্ধু আরেকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে তিনি জানান, অনেক দিন ধরেই প্ল্যান ছিল ঢাকা থেকে আমাদের ওই বন্ধু জামালের ঝালমুড়ি খেতে নরসিংদীতে আসবেন। ঘটনার আগের দিন মঙ্গলবার আরেক বন্ধুকে নিয়ে বিআরটিসির বাসে নরসিংদীতে আসেন তাঁরা। এরপর নরসিংদী সদরের হাজীপুরে ঝালমুড়ি খেতে যাই। তবে রাত হয়ে যাওয়ায় ওই দিন এক বন্ধুর বাসায় থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। পরদিন ট্রেনে তাঁরা ঢাকায় ফেরার কথা ছিল। বুধবার চট্টগ্রাম মেইলে ঢাকায় ফেরার জন্য স্টেশনে তাঁরা অপেক্ষা করেন। এ সময় হঠাৎ দুই নারী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীর পোশাক নিয়ে অশ্নীল কথা বলতে থাকেন। বন্ধুরা প্রতিবাদ করলে আশপাশের লোকজন মিলে মারধর শুরু করেন। এরপর কোনোমতে প্রাণে বেঁচে স্টেশন অফিসারের কক্ষে আশ্রয় নেওয়ার পর নিজেই '৯৯৯'-এ কল করেন ওই তরুণী। ৭-৮ মিনিটের মধ্যে পুলিশ সেখানে পৌঁছে।

ঘটনাস্থল রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ও রেলওয়ে পুলিশের আওতাধীন। তবে বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনায় শুরু থেকেই এর ছায়া তদন্ত শুরু করে নরসিংদী জেলা পুলিশের গোয়েন্দা ইউনিট। এরই মধ্যে তরুণী ও তাঁর বন্ধুদের মারধরকারী মূল ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁর নাম মো. ইছমাইল। তিনি পেশায় রাজমিস্ত্রি। ঢাকায় যেতে তিনি স্টেশনে অপেক্ষমাণ ছিলেন। সিসিটিভির ফুটেজ ছাড়াও ঘটনার শিকার ভুক্তভোগীরা ইছমাইলকে শনাক্ত করেছেন।প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ইছমাইল স্বীকার করেন, জোশে পড়ে তিনি তরুণী ও তাঁর বন্ধুদের ওপর চড়াও হন। ওই দুই নারীর কাছে উল্টো তাঁদের ক্ষমা চাওয়াতে বাধ্য করেন বলেও স্বীকার করেন।

নরসিংদী জেলার পুলিশ সুপার কাজী আশরাফুল আজীম বলেন, এভাবে লাঞ্ছনার ঘটনা কল্পনাতীত। এটা চরম প্রতিক্রিয়াশীল মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। আলামত বিশ্নেষণ করে সবাইকে শনাক্ত করা হয়েছে। একজনকে ধরাও হয়েছে। বাকিরাও দ্রুত ধরা পড়বে।
লাঞ্ছনার শিকার আরেক তরুণ বলেন, এই ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে তাঁদের পরিবারও জেনে যায়। পরিবারের লোকজন এক ধরনের ভয়ের মধ্যে আছেন। এ ব্যাপারে কারও সঙ্গে কথা বলতে নিষেধ করেছেন তাঁরা।

রেলওয়ে পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি দিদার আহমেদ বলেন, তরুণী ও তাঁর বন্ধুরা মামলা না করলে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করবে। এ ধরনের সাম্প্রদায়িক ঘটনা মেনে নেওয়া যায় না।

মাঝে মধ্যেই পোশাকের কারণে নারীদের বিব্রত হওয়ার ঘটনার খবর গণমাধ্যমে আসে। সম্প্রতি কপালে টিপ পরা নিয়ে এক পুলিশ সদস্য একজন শিক্ষিকাকে হেনস্তা করেন।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান - dainik shiksha সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! - dainik shiksha শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! হিটস্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু লিখিততে প্রক্সি দিয়ে পার, মৌখিক পরীক্ষায় এসে ধরা - dainik shiksha লিখিততে প্রক্সি দিয়ে পার, মৌখিক পরীক্ষায় এসে ধরা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষক কেনো বদলি চান - dainik shiksha শিক্ষক কেনো বদলি চান ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে - dainik shiksha ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0067141056060791