‘মৌখিক অনুমতি নিয়ে’ শহরে বদলি হয়ে যাচ্ছেন শিক্ষকরা, গ্রামের স্কুলে সংকট

নেত্রকোনা প্রতিনিধি |

গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগ দিয়ে কয়েকদিন পর তদবির করে নিজের পছন্দের বিদ্যালয় বা শহরে ‘মৌখিক অনুমতি নিয়ে’ বদলি হয়ে যাচ্ছেন সহকারী শিক্ষক। ফলে শিক্ষার্থীর বিপরীতে নির্দিষ্ট সংখ্যক শিক্ষক সংকটে ভুগছে গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো। এতে পাঠদানে ঘটছে বিঘ্ন। এমন চিত্র নেত্রকোনার মোহনগঞ্জের অধিকাংশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সেইসাথে একজন সহকারী শিক্ষককে বিদ্যালয় থেকে এনে উপজেলা শিক্ষা অফিসে দীর্ঘদিন ধরে অফিস সহকারীর কাজ করানো হচ্ছে।

মোহনগঞ্জের বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, শহরে প্রাইভেট কোচিং বাণিজ্য রমরমা থাকায় অনেক শিক্ষক গ্রামের কোনো বিদ্যালয়ে যোগদান করেই তদবির করে শহরে চলে আসতে চান। বদলি বন্ধ থাকায় ঘুষ বা বিভিন্ন মহলের তদবির করে পছন্দের বিদ্যালয়ে বদলি হয়েছেন অনেক শিক্ষক। ফলে এ সংকট তৈরি হয়েছে। এতে শহরের বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকের সংখ্যা বেশি থাকলেও গ্রামের বিদ্যালয়ে এ সংখ্যা কোথাও কোথাও প্রয়োজনের চেয়ে অনেক কম। শিক্ষক সংকটে পাঠদান চালিয়ে যাওয়াই কষ্টসাধ্য সরকারি প্রাইমারি স্কুলগুলোর জন্য। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে উপজেলার হরিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন সুমি আক্তার। যোগদানের ১৪ দিন পর মৌখিকভাবে বদলি হয়ে চলে যান পশুখালী বিদ্যালয়ে। বর্তমানে ২১৭ জন শিক্ষার্থীকে পাঠদানে রয়েছে মাত্র তিনজন শিক্ষক। ফলে কষ্টে পাঠদান চালিয়ে যাচ্ছেন প্রতিষ্ঠান প্রধান। 

এছাড়া করাচাপুর সরকারি বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মরিয়ম বেগম চার বছর আগে মৌখিক অনুমতিতে বদলি হয়েছেন অন্যত্র। এখন ২৪০ জন শিক্ষার্থীকে পাঠদান করছেন মাত্র পাঁচজন শিক্ষক। 

এদিকে পশুখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সুব্রত চক্রবর্তী বিদ্যালয় ফেলে রেখে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে। কাগজে কলমে সহকারী শিক্ষক হলেও তিনি শিক্ষা অফিসে সহকারীর কাজ করেছেন। ওই বিদ্যালয়ে বর্তমানে মাত্র ৪ জন শিক্ষক মিলে ১৭৩ জন শিক্ষার্থীর পাঠদান করছেন। 

অন্যদিকে মানশ্রী সরকারি প্রাথমিক বিদালয়ের সহকারী শিক্ষক মাহমুদা আক্তারও মৌখিকভাবে বদলি হয়ে পৌরশহরের একটি বিদ্যালয়ে যোগদান করেছেন। ফলে শিক্ষক সংকটে ভুগছে ওই বিদ্যালয়টি।  

তবে মিয়াশি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আবুল কাসেম মৌখিক অনুমতি নিয়ে বাখরপুর বিদ্যালয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চলে গিয়েছিলেন। পাশাপাশি পাবই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে সহকারী শিক্ষক সীমা চৌধুরী চলে যান কাজিহাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বিতর্ক উঠার পর তাদের দুজনকেই আগের কর্মস্থলে পাঠানো হয়েছে। 

এবিষয়ে হরিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এ এইচ টি কবিন্দ্র কর দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, সহকারী শিক্ষক সুমি আক্তার এখানে যোগদানের ১৪ দিন পর পশুখালী বিদ্যালয়ে চলে যান। কিভাবে ওখানে যোগ দিলেন তার কোনো লিখিত কোনো কাগজ পাইনি।

করাচাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আনোয়ার হোসেন চৌধুরী দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, আমি এখানে যোগদান করেছি দুই বছরের কম হবে। আর মরিয়ম আক্তার চলে গেছেন প্রায় ৪ বছর হবে। তিনি প্রেষণে গিয়েছেন শুনেছি, তবে এসবের কোন কাগজপত্র দেখিনি। 

মানশ্রী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মু. রানা আসিফ দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, আমি ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ জানুয়ারি এই বিদ্যালয়ে যোগদান করেছি। যোগদানের অনেক বছর আগে থেকেই বিদ্যালয়ে নেই সহকারী শিক্ষক মাহমুদা আক্তার। যোগদানের পর শুনেছি মাহমুদা আক্তার নামে একজন সহকারী শিক্ষক আছেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত তাকে বিদ্যালয়ে দেখিনি। অন্য কোথাও প্রেষণে গিয়েছে কিনা জানি না। গিয়ে থাকলেও তার কোনো কাগজপত্র আমার কাছে পৌঁছায়নি। 

পশুখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শহীদুল ইসলাম দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, এই বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সুব্রত চক্রবর্তী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসেই নিয়মিত কাজ করেন। দাপ্তরিক কাজকর্ম ভাল বোঝার কারণে কর্মকর্তারা তাকে অফিসেই রাখেন। এছাড়া মৌখিকভাবে বদলি হওয়া সুমি আক্তার নামে একজন শিক্ষক হরিপুর থেকে এখানে যোগদান করেছেন। 

উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা দিপালী সরকার দৈনিক শিক্ষাডটকমকে জানান, আমার আগে যিনি শিক্ষা কর্মকর্তা ছিলেন, তিনি এসব সমস্যা তৈরি করে গেছেন। ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে আমি যোগদান করার পর অনেক শিক্ষককে তাদের আগের কর্মস্থলে পাঠিয়েছি। বর্তমানে যারা বিভিন্ন বিদ্যালয়ে মৌখিক অনুমতিতে রয়েছেন, ক্রমে তাদেরকেও পাঠানো হবে। আর সহকারী শিক্ষক মাহমুদা আক্তারের স্বামী মারা যাওয়াতে এমপি ম্যাডামের সুপারিশে তাকে শহরের একটি বিদ্যালয়ে বদলি করা হয়েছে। এখানে আমাদের কিছু করার নেই। 

তিনি আরও বলেন, সহকারী শিক্ষক সুব্রত চক্রবর্তী শিক্ষা অফিসে কাজ করছেন। এই বিষয়টা আমাদের ডিজি অফিস থেকেই বলা আছে যে, কম্পিউটার বিষয়ক কাজে পারদর্শী একজন শিক্ষক শিক্ষা অফিসে কাজ করাতে হবে।
 
তবে তার বক্তব্যের সাথে ভিন্নমত পোষণ করেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) ছাব্বির আহমেদ আকুঞ্জি। তিনি দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, অফিসে কাজ করার জন্য তো অফিস সহকারী থাকবে, এ কাজ সহকারী শিক্ষক করবেন কেন। তবে পুরো বিষয়টি নিয়ে শিক্ষা কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলবেন বলেও জানান তিনি।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
নতুন শিক্ষাক্রমের ৩১ পাঠ্যবইয়ে ১৪৭ ভুল - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রমের ৩১ পাঠ্যবইয়ে ১৪৭ ভুল বজ্রপাতে মাদরাসার ২১ ছাত্র আহত, হাসপাতালে ১১ - dainik shiksha বজ্রপাতে মাদরাসার ২১ ছাত্র আহত, হাসপাতালে ১১ যতো লিখেছি, ছিঁড়েছি তার বেশি - dainik shiksha যতো লিখেছি, ছিঁড়েছি তার বেশি তত্ত্বাবধায়ককে বাধ্য করে ঢাবি শিক্ষকের পিএইচডি - dainik shiksha তত্ত্বাবধায়ককে বাধ্য করে ঢাবি শিক্ষকের পিএইচডি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই কবির জন্মবার্ষিকী পালনের নির্দেশ - dainik shiksha সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই কবির জন্মবার্ষিকী পালনের নির্দেশ শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই - dainik shiksha শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই বিদ্যালয়ের ক্লাস থামিয়ে ভোট চাইলেন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী - dainik shiksha বিদ্যালয়ের ক্লাস থামিয়ে ভোট চাইলেন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.005763053894043