লাল পাসপোর্ট-বাড়ি-গাড়ি কিছুই নিইনি : মাশরাফি

নিজস্ব প্রতিবেদক |

বাংলাদেশে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন তোলাই বাহুল্য। আর ক্রিকেটে জাতীয় দলের অধিনায়কের পদ? বিশাল ব্যাপার। দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের লোকের মর্যাদা পেয়ে থাকেন অধিনায়কেরা। দীর্ঘ সময় নেতৃত্ব দিলে এই মর্যাদার মোহে পড়া অস্বাভাবিক কিছু না। কিন্তু মাশরাফি বিন মুর্তজা সে ধাতের মানুষ নন। জাতীয় দলের নেতৃত্ব ছাড়ার সংবাদ সম্মেলনে মাশরাফি বুঝিয়ে দিলেন, এসব বিষয় তাঁকে স্পর্শ করেনি, করে না, করবেও না। 

মাশরাফি শুধু ক্রিকেটেরই নন, ক্রীড়াঙ্গনের মহানায়ক। নায়কেরা সময়ে সময়ে আর্বিভূত হন। তবে এদের মধ্যে মহানায়ক হতে পারেন কমই। মাশরাফি আমাদের সেই মহানায়কদের একজন, যাঁরা আমাদের পরিচিত করিয়েছেন বিশ্ব ক্রিকেটে। 

মাশরাফি শুধু ক্রিকেট দলের নেতা নন জাতীয় সংসদের সদস্যও। কিন্তু এসব ক্ষমতার মোহ থেকে দূরে থাকতেই পছন্দ করেন তিনি। ‘অধিনায়কত্ব মিস করবেন কি না’—বৃহস্পতিবারের সংবাদ সম্মেলনে এমন প্রশ্নে মাশরাফি বলেন, ‘অধিনায়কত্ব শুরুর সময়ও মনে করিনি আমি অনেক বড় কিছু। এখন আমার আরেকটা পরিচয় আছে, এমপি; এখনো ও রকম (নিজেকে বড় কিছু) ভাবি না। লাল পাসপোর্ট নিইনি, বাড়ি নিইনি, গাড়ি নিইনি। অধিনায়ক হিসেবে আমি এই চেয়ারটা (প্রেস কনফারেন্সের চেয়ার দেখিয়ে) পাওয়ার আগ পর্যন্ত চেয়ারটা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ছিল।’

বাংলাদেশে ক্রিকেটের দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা । ছবি : সংগৃহীত

কোনো দায়িত্ব পেলে মাশরাফি সব সময়ই তার প্রয়োগ ঘটাতে চান। কিন্তু দায়িত্বের গণ্ডির বাইরে ক্ষমতার প্রভাব খাটানোর কথা তিনি ভাবেননি। নিজের কথাতেই তা বুঝিয়ে দেন মাশরাফি, ‘যখনই আমি এই চেয়ারটা পেলাম তখনই ওখানে (আকাঙ্খার) শেষ লেখা হয়েছে। এই চেয়ার পাওয়ার আকাঙ্খা আমার কাছে নাই। এই চেয়ারটার সর্বোচ্চ প্রয়োগ আমার করা উচিত। বরং এটার প্রভাবটা আমি অন্যভাবে খাটাতে চাই না। আমি জিনিসটা এভাবে দেখি, যে জিনিসটা আমি অর্জন করব বা অর্জন করতে যাচ্ছি। তা পাওয়ার পর ওটার মূল্য আর নাই। তখন সেটার মূল্যায়ন হবে আমি কীভাবে এটার প্রয়োগ করেছি।’

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজ শেষে ওয়ানডে দলের অধিনায়কত্ব পুর্নবিবেচনা করা হবে, জানিয়েছিল বিসিবি। তার আগেই নেতৃত্ব ছেড়ে দিলেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে চলতি ওয়ানডে সিরিজের শেষ ম্যাচই অধিনায়ক হিসেবে তার শেষ ম্যাচ।

সিলেটে বৃহস্পতিবার দুপুরে ম্যাচ পূর্ববর্তী নির্ধারিত সংবাদ সম্মেলনের শুরুতেই নিজে থেকে এই ঘোষণা দেন মাশরাফি।

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে শেষ ম্যাচটি জিতলে বাংলাদেশের প্রথম অধিনায়ক হিসেবে ওয়ানডেতে ৫০ জয়ের স্বাদ পাবেন তিনি। সেই মাইলফলক ধরা দিক বা না দিক, দেশের হয়ে টস করতে নামছেন শুক্রবারের ম্যাচেই শেষবার।

নেতৃত্ব ছাড়ার ঘোষণাটি সোজাসাপ্টাই দিয়েছেন মাশরাফি। কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন নেতৃত্বের এই পথচলায় পাশে থাকা সবাইকে।

“কালকে আমার শেষ ম্যাচ অধিনায়ক হিসেবে। আমার প্রতি এত দীর্ঘ সময় আস্থা রাখার জন্য বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডকে ধন্যবাদ জানাই। আমার নেতৃত্বে যত ক্রিকেটার খেলেছে বাংলাদেশ দলে, সবাইকে ধন্যবাদ জানাই। আমি নিশ্চিত এই প্রক্রিয়াটা সহজ ছিল না, গত ৪-৫ বছরের ভ্রমণ সহজ ছিল না।”

“ধন্যবাদ জানাই টিম ম্যানেজমেন্ট যারা ছিল, যাদের কোচিংয়ে খেলেছি। নির্বাচক ও বোর্ডের কর্মকর্তা যারা আছেন, বোর্ডের প্রতিটি স্টাফ, সবাইকে ধন্যবাদ সহযোগিতার জন্য। মিডিয়ার যারা আছেন, সবাই সহযোগিতা করেছেন, আপনাদের ধন্যবাদ জানাই। সবশেষে সমর্থকেরা, যারা বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রাণ, আপনাদের সমর্থন ছাড়া সম্ভব হতো না।”

এটুকু বলার পর ছোট্ট লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান মাশরাফি।

“আজকে আমি আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ ওয়ানডে দলের অধিনায়কত্ব থেকে সরে যাচ্ছি। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে শেষ ম্যাচটি অধিনায়ক হিসেবে আমার শেষ ম্যাচ। খেলোয়াড় হিসেবে আমি চেষ্টা করব, আমার সেরাটা দেওয়ার, যদি সুযোগ আসে। শুভ কামনা থাকবে পরবর্তী অধিনায়কের জন্য।”

মাশরাফির ঘোষণা শেষের পর শুরু হয় প্রশ্নোত্তরের পালা। ৩৫ মিনিটের দীর্ঘ সংবাদ সম্মেলনে উঠে এসেছে তার নেতৃত্বের নানা অধ্যায়।

বাংলাদেশের ক্রিকেটে মাশরাফির নেতৃত্বের অধ্যায় শুরু হয়েছিল ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে। অধিনায়ক হিসেবে গিয়েছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজে। কিন্তু প্রথম টেস্টের তৃতীয় দিনেই চোট পেয়ে ছিটকে যান সফর থেকে। ওয়ানডেতে সেবার আর নেতৃত্বে দেওয়া হয়নি।

লম্বা বিরতির পর আবার অধিনায়ক হিসেবে ফেরেন ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের ইংল্যান্ড সফরে। সেখানেই রঙিন পোশাকে নেতৃত্বের সূচনা। শুরুর পথচলা ছিল ঝলমলে। দ্বিতীয় ম্যাচেই পান জয়ের স্বাদ, প্রথমবার ইংল্যান্ডকে হারায় বাংলাদেশ। কিন্তু আবার চোটের থাবা। দেশের মাটিতে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতেই বোলিংয়ের সময় চোট পেয়ে আবার যান মাঠের বাইরে।

ওই দফায় ৭ ওয়ানডেতে তার নেতৃত্বে জয় ছিল ৩টি।

এরপর অনেক ঝড়-ঝাপ্টা পেরিয়েছেন ক্যারিয়ারে। দেশের মাটিতে ২০১১ বিশ্বকাপ খেলতে পারেননি, মাঠের বাইরে লড়াই করতে হয়েছে অসংখ্য প্রতিকূলতার সঙ্গে। অধিনায়ক হিসেবে স্মরণীয় অধ্যায়ের শুরু ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে। দেশের ক্রিকেটের চরম দুঃসময়ে সীমিত ওভারের ক্রিকেটের অধিনায়ক করা হয় তাকে। শুরু হয় বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায়ের।

মাশরাফির নেতৃত্বে ২০১৫ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার-ফাইনাল খেলে বাংলাদেশ। ওই বছর দেশের মাটিতে সিরিজ জয় ধরা দেয় ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে, হোয়াইটওয়াশড হয় পাকিস্তান। চলতে থাকে অধিনায়ক মাশরাফির জয়রথ। আফগানিস্তান-জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রত্যাশিত সিরিজ জয় তো ছিলই।

যে সংস্করণে পায়ের তলায় জমি খুঁজে ফিরছিল বাংলাদেশ, সেই টি-টোয়েন্টিতে ২০১৬ এশিয়া কাপ ফাইনালে ওঠে দল। ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে অবশ্য আচমকাই ছেড়ে দেন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট। সেই সময়ের কোচ চন্দিকা হাথুরুসিংহে ও বোর্ড কর্তাদের চাপের গুঞ্জন অবশ্য ছিল।

সেই ধাক্কা সামলে ওয়ানডেতে রচনা করতে থাকেন সাফল্যগাঁথা। ইংল্যান্ডে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে বাংলাদেশ পৌঁছে যায় সেমি-ফাইনালে। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে সিরিজ জিতে ফেরে বাংলাদেশ। ক্যারিবিয়ানদের বিপক্ষে জয় আসে দেশের মাটিতেও। ওই বছরই এশিয়া কাপে ভাঙাচোরা দল নিয়ে ফাইনালে ওঠে বাংলাদেশ।

আয়ারল্যান্ডে তার নেতৃত্বেই প্রথম কোনো শিরোপা জিতে বাংলাদেশ। ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে হারায় ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। তবে ছন্দপতনের শুরু এরপরই। বিশ্বকাপে প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি বাংলাদেশ। চোটের কারণে অধিনায়কের নিজের ফর্মও ছিল বাজে। শুরু হয় সমালোচনার ঝড়। বিশ্বকাপের পরপর শ্রীলঙ্কা সফর থেকে চোটের জন্য ছিটকে যান সফর শুরুর আগের দিন। 

এরপর বাংলাদেশর ওয়ানডে ছিল না দীর্ঘদিন। কিন্তু মাশরাফি ছিলেন আলোচনায়। তার অধিনায়কত্ব নিয়ে, তার ক্যারিয়ারের ভবিষ্যৎ নিয়ে চর্চা ছিল দেশের ক্রিকেটে নিত্য। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে চলতি সিরিজের আগেও এসব নিয়ে ছিল তুমুল আলোচনা। শেষ পর্যন্ত এটিই হয়ে থাকছে শেষ।

সব মিলিয়ে দেশের রেকর্ড ৮৭ ওয়ানডেতে নেতৃত্ব দিয়েছেন, রেকর্ড ৪৯টি জয়ও এসেছে তার অধিনায়কত্বেই।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা - dainik shiksha মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা - dainik shiksha দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0021839141845703