‘হিরার খনির মালিক হয়ে কানাকড়ি নাই’

দৈনিক শিক্ষাডটকম ডেস্ক |

দৈনিক শিক্ষাডটকম ডেস্ক : আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণ প্রান্ত জুড়ে রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা দেশটি। তার এক দিকে আটলান্টিক মহাসাগর, এক দিকে ভারত মহাসাগর এবং এক দিকে কুমেরু বা দক্ষিণ মহাসাগর। এই দেশটিকেও দীর্ঘ সময় বিদেশি শক্তির উপনিবেশ হিসাবে কাটাতে হয়েছে। ব্রিটিশরা দক্ষিণ আফ্রিকাকে মু্ক্তি দেয় বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে।

তবে শুধু দীর্ঘ ঔপনিবেশিক পীড়ন নয়, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপন্নতার মূলে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে দামি পাথর— হিরা। এই পাথরের খনি দক্ষিণ আফ্রিকা।

১৮৬৬-৬৭ খ্রিষ্টাব্দে দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম হিরা আবিষ্কৃত হয়। এই আবিষ্কারের পর দক্ষিণ আফ্রিকার কপাল খুলে যাবে বলে মনে করেছিলেন অনেকে। কিন্তু তা হয়নি। বাস্তবে এই হিরাই দেশটির সর্বনাশ ডেকে এনেছে।

প্রথমে ডাচ, তার পর ব্রিটিশ— দক্ষিণ আফ্রিকা দেশটি পর পর দু’বার উপনিবেশিক শাসনের শিকার হয়েছিল। তবে প্রথম দিকে উপনিবেশ হিসাবে দক্ষিণ আফ্রিকার তেমন গুরুত্ব ছিলো না। হিরা কাহিনির মোড় ঘুরিয়ে দেয়।

হিা আবিষ্কার হওয়ার আগে পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকা দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার মাঝে ইউরোপীয় বণিকদের বিশ্রামের জায়গা ছিলো। হিরে খুঁজে পাওয়ার পর রাতারাতি দেশটি শিল্পক্ষেত্রে পরিণত হয়। একে দক্ষিণ আফ্রিকার খনিজ বিপ্লবও বলা হয়ে থাকে।

দক্ষিণ আফ্রিকার হিরাতে সেখানকার সাধারণ মানুষ, আদি বাসিন্দাদের কোনো অধিকার ছিলো না। বিদেশিরাই হিরার খনি কাজে লাগিয়ে শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলে। কারখানায় ব্যবহার করা হয় স্থানীয়দের শ্রম। তবে তাঁরা তার উপযুক্ত পারিশ্রমিক পেতেন না।

একাধিক বিদেশি সংস্থা দক্ষিণ আফ্রিকার হিরা শিল্পের দখল নিয়ে ফেলেছিল। তাঁরা নামমাত্র পারিশ্রমিকে স্থানীয়দের দিয়ে কাজ করিয়ে নিতো। এভাবে একসময় বিশ্বের ৯০ শতাংশ হিরার জোগানদার হয়ে ওঠে দক্ষিণ আফ্রিকা।

যতো দিন গেছে, দক্ষিণ আফ্রিকার আদিবাসীদের উপর বিদেশি শক্তির অত্যাচার বেড়েছে। হিরা পাচারের সন্দেহে শ্রমিকদের উলঙ্গ করে তল্লাশি চালানো থেকে শুরু করে বেধড়ক মারধর, বাদ ছিলো না কিছুই। এই সময় থেকেই সাদা এবং কালো চামড়ার বিভেদ, বৈষম্য গাঢ় হয়ে ওঠে আফ্রিকার ওই দেশটিতে।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণাঙ্গ এবং শ্বেতাঙ্গদের বৈষম্য দক্ষিণ আফ্রিকার সমাজে ক্ষত আরও গভীর করেছে। বিদ্রোহ, লড়াই, আন্দোলন এবং যুদ্ধের পর ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে অবশেষে ‘ইউনিয়ন অফ সাউথ আফ্রিকা’র তকমা পায় দেশটি।

এর কয়েক বছর পরে দক্ষিণ আফ্রিকায় একটি আইন পাস হয়, যাতে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়, কৃষ্ণঙ্গেরা সেই দেশে কোনও সম্পত্তির অধিকারী হতে পারবেন না। সমাজকে গায়ের রঙের ভিত্তিতে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়— কৃষ্ণাঙ্গ, শ্বেতাঙ্গ ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত।

কৃষ্ণাঙ্গ, শ্বেতাঙ্গের বিভেদ দক্ষিণ আফ্রিকাকে অন্দর থেকে দুর্বল করে দিয়েছিল। দেশটির অর্থনীতির মাজা ভেঙে গিয়েছিল। আর সব কিছুরই সূত্রপাত হয়েছিল হিরাকে কেন্দ্র করে।

বিপুল হিরার ভান্ডারের মালিক হওয়া সত্ত্বেও দক্ষিণ আফ্রিকার সাধারণ মানুষ কখনও ওই ভান্ডারের সুবিধা ভোগ করতে পারেননি। তাঁরা চিরকাল বিদেশি শাসনের নীচে ছিলেন।
১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে বিদেশি শক্তিকে সরিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় ক্ষমতায় আসে আফ্রিকান ন্যাশানাল কংগ্রেস (এএনসি)। এর পর সমাজে সাম্য ফিরবে বলে আশা করা হয়েছিল। কিন্তু ছবিটা বদলায়নি।

বর্তমানে দক্ষিণ আফ্রিকায় বেকারত্বের হার ৩৫ শতাংশেরও বেশি। দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ তরুণ কর্মহীন। অপরাধমূলক কাজ সেখানে এতটাই বেশি যে, প্রশাসনের উপর ভরসা করে থাকা যায় না। ঘরে ঘরে চুরি-ডাকাতি ঠেকাতে কাঁটাতারের জাল বিছিয়ে রাখতে হয়।

বিদ্যুতের অপ্রতুলতা দক্ষিণ আফ্রিকার অন্যতম বড় সমস্যা। প্রতি বাড়িতে দিনে অন্তত ১২ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। গ্রামীণ এলাকায় পরিস্থিতি আরও খারাপ। দেশটিতে বিদ্যুতের চাহিদা বেশি, কিন্তু জোগান কম।

এ সকল সমস্যার সমাধানের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে দুর্নীতি। দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার বিদ্যুৎ থেকে শুরু করে শিল্প, বাণিজ্য, শিক্ষা প্রভৃতি নানা খাতে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ করে। কিন্তু তাতে লাভ হয় না। কারণ দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিকরা দেশটিকে শোষণ করে চলেছেন আজও।

হিরার দেশ হয়েও তার ঔজ্জ্বল্য নেই দক্ষিণ আফ্রিকায়। উপনিবেশিক শাসন, বিদেশি ঔদ্ধত্য, বর্ণবৈষম্যের বিষ ঠেলে কখনও আলোয় মাথা তুলতেই পারেনি এই দেশ। তাই অনেকে বলেন, দক্ষিণ আফ্রিকার বর্তমান অবস্থার নেপথ্যে দায়ী তারই সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ— হিরা।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
বর্তমানে ছাত্রদের নেতৃত্ব দেয়ার কেউ নেই: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী - dainik shiksha বর্তমানে ছাত্রদের নেতৃত্ব দেয়ার কেউ নেই: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী শিক্ষাখাতের নতুন তদবিরবাজ তিতাস! - dainik shiksha শিক্ষাখাতের নতুন তদবিরবাজ তিতাস! শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভাজন তৈরির চেষ্টা চলছে: সমন্বয়ক হান্নান - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভাজন তৈরির চেষ্টা চলছে: সমন্বয়ক হান্নান তদন্ত রিপোর্ট না দিয়েই সটকে পড়ছেন শিক্ষা পরিদর্শকরা - dainik shiksha তদন্ত রিপোর্ট না দিয়েই সটকে পড়ছেন শিক্ষা পরিদর্শকরা বরখাস্ত হচ্ছেন শিক্ষা বোর্ডের সেই সচিব নারায়ণ নাথ - dainik shiksha বরখাস্ত হচ্ছেন শিক্ষা বোর্ডের সেই সচিব নারায়ণ নাথ আমরা চাই না ছাত্রদের কঠোর হয়ে দমন করতে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা - dainik shiksha আমরা চাই না ছাত্রদের কঠোর হয়ে দমন করতে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0026421546936035